মুন্নি আক্তারের বয়স ২৬ বছর। সিলেটের একটি গ্রামে বেড়ে ওঠা মুন্নি ১৫ বছর বয়সে মামাতো ভাইয়ের বধু হয়ে নেমে পড়েন সংসার জীবনে। স্বামী রুবেল কখনোও রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা অথবা ভাঙারির দোকানে এটা ওটা বিক্রি করেন। তবে, বছরের বেশিরভাগ সময় রুবেলের কাজ করতে ভালো না লাগায়, থাকেন ঘরে বসে। অগত্যা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার খরচ বহন করেন মুন্নি। ঈদে বা যে কোন উৎসবে গৃহর্কমীর কাজ করেই ছোট দুই কন্যা শিশুর বায়না পূরণ করেন মুন্নি। এমনকি কোন কোন মাসে ৪ থেকে ৫ বাড়িতে কাজ করে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটান এই নারী।
রহিমা খুব ভালোবেসে বিয়ে করছিলেন মাহিনকে। সড়ক দূর্ঘটনায় মাহিনের মৃত্যুর পর একমাত্র সন্তান রাতুলকে ঘিরে আবর্তিত হয় রহিমার পৃথিবী। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে সেলস ম্যানজোর হিসেব কাজ করে যা আয় হয় তা দিয়ে মা-ছেলের সংসার চলে। সেই সাথে চলে ছেলের লেখাপড়ার খরচ। বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়া রহিমা দ্বিতীয়বার বিয়ের পিড়িতে না বসে আত্মনর্ভিরশীল হবার সিদ্ধান্ত নেন। স্বাবলম্বী হয়ে মাথা উচু করে বাঁচার পথ বেছে নেন।
বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান পুতুল। লেখাপড়া পড়া শেষ করে এখন পুরোদস্তুর গাইনি বিভাগের ডাক্তার। বেশ ভালো উর্পাজন পুতুলের। নিজের স্বচ্ছল জীবনের পাশাপাশি বাবা-মা’কে দেখে রাখছেন পরম যত্নে। বাবা-মার যত্নের যেনো ঘাটতি না পড়ে তাই বিয়ে করেননি পুতুল। ছেলে সন্তানদের বংশের বাতি বিবেচনা করা সমাজে পুতুল এক অনন্য উদাহরন।
নাজমা খাতুন অনলাইন রুপসজ্জা সার্ভিস রমনি ডট কমের একজন কর্মী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পার্লার সার্ভিস দেন। তিনি জানান, তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে মাইসা বিভিন্ন শো-রুমের পন্যের লাইভ করে মাসে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা র্পযন্ত আয় করনে। নিজের টাকায় পড়াশোনা করছনে মাইসা। মা-মেয়ের আয়ে দিব্যি চলে তাদের পরিবার।
মুন্নি, রহিমা, পুতুল, নাজমা আর মাইসার মতো এখন চারপাশে অনকে নারী আছেন যারা গ্রামে বা শহরে নিজ উর্পাজনরে টাকায় সংসার চালাচ্ছনে। সগৌরবে মাথা উচু করে জীবন কাটাচ্ছনে এই নারীরা। আর্থিক অবদান রাখছেন পরিবারে বাকি সদস্যদের মতো। এমন নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দেশের মাথাপছিু আয়ের অঙ্কটা বেশ শক্ত হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, যেহেতু একটা বড় জনগোষ্ঠী নারী, তাদের আয় বৃদ্ধি পেলে সবদিক থেকে তা মঙ্গল বয়ে আনবে। নারীর আয়ের একটা বড় অংশ সংসাররে উন্নয়নে ব্যয় হয়। সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে অর্থ বিনিয়োগের পাশাপাশি নারীরা সঞ্চয় করেন যা পরর্বতীতে কোন ব্যবসায় মূলধন হিসেবে কাজে আসে। সেই সাথে বেশিরভাগ নারী জমিজমা কেনায় বিনিয়োগ করেন যা পরিবারের জন্য র্দীঘময়োদী অ্যাসেট তৈরিতে সহায়তা করে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর উর্পাজন বেড়ে যাওয়ায় দেশের মাথাপছিু আয় অনেকটা ইতিমধ্যে বেড়েছে। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে কাজ করা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নারীরা দিব্যি তাদের আয়ে সংসার চালাচ্ছেন। একইসাথে তারা যে সংসারে সেবা দেন সেটার অর্থমূল্য হিসাব করলে সমাজ ও জাতি গঠনে এ অবদান খুবই গুরুত্বর্পূণ ভুমিকা রাখছেন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর আয়ে সংসার যখন চলে তখন স্বাভাবকিভাবে র্দীঘদিন ধরে চলে আসা পরিবারের কর্তাব্যক্তির আসনে পুরুষ থাকবেন, সেই ধ্যানধারনা বাধাগ্রস্থ হবার পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে নারীর চ্যালেঞ্জগুলো বেড়ে যায় বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব নারীরা উর্পাজন করেন তাদের বাহিরের কাজের সাথে সাংসারিক কাজগুলোও করতে হয়। ফলে ঘর-বাহির সামলাতে হিমশিম খান বেশিরভাগ নারী। আবার কিছুক্ষেত্রে নারীরা উর্পাজন করলেও তারা সে অর্থ নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেননা। জোর করে টাকাগুলো হাতিয়ে নেন পরিবারের লোকজন। ফলে নারীর আর্থিক সংকট থেকেই যায়। এসব সমস্যা উত্তোরণে মানসকিতা পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিকভাবে নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবার বিষয়টাকে সর্মথন দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ড. মো. মফিজুর রহমান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী-পুরুষ একই সাথে উর্পাজন করলে পারিবারিকভাবে যেমন র্অথ সংকট নিরসন করা যায়, একইসাথে দেশের মাথপিছু আয় বাড়াতে নারীরা গুরুত্বর্পূণ ভুমকিা রাখার সুযোগ পাবেন।
লেখক: সাংবাদিক