Saturday 28 Dec 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের করণকৌশল (পর্ব-০২)

ফাহিম ফেরদৌস
৭ মে ২০২৩ ২৩:২৫ | আপডেট: ৮ মে ২০২৩ ১৮:০৯

প্রথম পর্বের পর

মানুষ পরিচয়ের পর আমার পরিচয় আমি একজন বাঙালি। আমারও তোমাদের মতো বুক ভরা স্বপ্ন। তবে এই স্বপ্নের জন্য আমি গর্বিত নই। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর একজন ও পিছিয়ে পড়া চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আমার দর্শন ও পরিচয় দেওয়ার মতো হাতে এখনো কিছু নেই। নিজেকে নির্মাতার চেয়ে তাই কর্মী ভাবতে ভালোবাসি। ২০০১ সালে ২০ বছর বয়সে মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রয়াত চাষী নজরুল ইসলামের নির্দেশনায় এবং প্রয়াত নাট্যজন ও লেখক মমতাজ উদ্দিন আহমদের চিত্রনাট্যে ‘হাসন রাজা’ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে ষষ্ঠ সহকারী পরিচালক পদের মাধ্যমে আমার পেশাদার সিনেমাকর্মীর হিসেবে হাতেখড়ি ঘটে। চিত্রনাট্য তৈরির পর্ব থেকে কাজ শুরুর কারণে এই দুই মহিরুহুর একান্ত সান্নিধ্য পাই এবং মূলধারা চলচ্চিত্র নির্মাণের ইহজাগতিক-মনোজাগতিক সমস্ত ইন্টেনশন আত্মস্থ করি বিদ্যুতের গতিতে। তবে শুটিং পর্বে আমাকে প্রচুর র‌্যাগিংয়ের মুখে পড়তে হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, আমার সিনিয়র সহকারীরা এতোই সিনিয়র ছিলেন যে, সেসময় তাদের প্রত্যেকের পকেটে অন্তত দু’টি করে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিল।

বিজ্ঞাপন

র‌্যাগিং কাজে দেয়নি। আমিতো সামাদ স্যারের মিশনে রয়েছি। সমস্ত ট্রেনিং নিয়েই যোগ দিয়েছি। তাছাড়া চাষী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে আমার খালু। আমার আরেক খালু প্রয়াত মিশুক মনির চৌধুরী। এদের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই এক ঘরে আড্ডা দিয়ে বিভিন্নভাবে আমার গ্রুমিং হয়েছে। তাই ছোটোখাটো ব্যাপার আমি এড়িয়ে চলতাম। আমরা ছোটবেলাতেই চাষী’র সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলাম। রুনা লায়লাকে নিয়ে শিল্পী সিনেমার জন্য আমরা তাকে ক্ষ্যপাতাম। তার প্রথম দুই চলচ্চিত্র ‘ওরা এগারো জন’ আর ‘সংগ্রাম’ আমার মায়ের পরিবার ‘চেওড়া হাউস’ থেকেই প্রোডিউস হয়েছে। আমাদের প্রিয় খালুদের একজন হওয়াতে তাকে অদ্ভুত ভালোবাসতাম। আর বেশি ভালোবাসতাম মিশুক মনির চৌধুরীকে (আমরা মিশুক বলে ডাকতাম)। আমাদের সব কাজিনদের মদ্যপান ও পর্নফিল্ম দেখার হাতেখড়ি হয়েছিল মিশুককে দিয়ে। সম্পর্কের গভীরতা বোঝাতে এ তথ্য ফাঁস করলাম। কিন্তু মিশুকের সঙ্গে আমার কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই। আমি কখনো টেলিভিশনের জন্য কাজ করিনি। ইটিভিতে অল্প কয়েকদিন কাজ করেছিলাম, তখন কিছুটা পাগলামি দেখেছি মিশুকের। যদিও বাল্যবন্ধু খালুর কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। প্রায়ই আম্মুকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতাম, তোমাদের পরিবারে যতোগুলো ট্যালেন্ট আছে তারা বাইরের পরিবার থেকে এসেছে। যেমন চাষী, মিশুক অথবা আমি।

বিজ্ঞাপন

তবে পরিবারসূত্রে আমি এফডিসিতে যাইনি। এটা ছিল আমার সিনেমার শিক্ষা গুরু সিনেমাটোগ্রাফার এম আব্দুস সামাদের নির্দেশ। এম আব্দুস সামাদ, চাষী নজরুল ইসলাম এর ‘ওরা এগারো জন’ ও ‘সংগ্রামের’ চিত্রগ্রাহক। তিনি লন্ডন ফিল্ম স্কুল থেকে ১৯৫৮ সালে সিনেমাটোগ্রাফিতে পড়তে শুরু করেন। স্কুল শেষে তিনি ‘ব্রিজ অন দ্যা রিভার কাওয়াই’ বা ‘গানস অব নাভারন’ ইত্যাদি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফি টিমে ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দেন। তারপর ’৬২ সালের দিকে দেশে ফিরে আসেন এবং বাংলা চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন। ২০০১ সালে তার নির্দেশেই আমি বিশেষ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে চাষীর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। সামাদ স্যার বলেছিল তিনটি মূলধারার ছবিতে কাজ করার কথা। নির্দেশকও ঠিক করে দিলেন তিনি। ‘হাছন রাজার’ পরে আমি চাষী আংকেলের সঙ্গে পর পর চারটি ছবিতে প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। ২০০৫ এর দিকে আমার মনে হলো গুরুবাক্য যথেষ্ট পালন হয়েছে, আরেকটু হলে নাভিশ্বাসে দম বন্ধ হবে।

এফডিসিতে আমার একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল তখন। আমি চাইলেই ডিরেক্টর-প্রোডিউসার এসোসিয়েশনের মেম্বার হয়ে সিস্টেমকে মেনে নিয়ে অনেক কাজ করতে পারতাম। তৎকালীন এফডিসিতে একজন নির্মাতার কাজ করার বাস্তবিক প্রয়োজনগুলো অনুসন্ধান করে দেখা যাক। কেন একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী চলচ্চিত্র নির্মাতা এফডিসির সঙ্গে যুক্ত হবেন?

১. ছবির নাম গেজেটভুক্ত করা ২. কারিগরি ও কলাকুশলীদের অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করা ৩. সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র ৪. ক্যামেরা ও পরিস্ফুটন সুবিধা ৫. সর্বোপরি ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত হয়ে সারাজীবন ব্যবসা করে যাওয়ার বাসনা।

যে ধরণের সিনেমার স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম সেখানে এই উদ্দেশ্যগুলোর একটারও প্রয়োজন অনুভব হলো না। মূলত সেন্সরবোর্ড ধারণা আমার বড় বড় সিনেমা বানানোর স্বপ্নকে আকাশপাতাল ঘুরিয়ে দিল। স্বপ্ন স্তিমিত হতে থাকল। আস্তে আস্তে সাহস হারিয়ে গেল স্থায়ীভাবে। আমি এফডিসিকেন্দ্রিক চিন্তা মুছে ফেললাম।

শাহবাগের বন্ধুরা আমাকে ম্লেচ্ছ অভিধায় অভিহিত করতে থাকতেন যে একজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী এবং একজন শিল্পরসিক  আমি কি করে এফডিসিতে কাজ করিতে পারি। এবার সবাই শান্তি পেল। আমি এবার সাংবাদিক হয়ে গেলাম। গরিবের গন্তব্য হলো ‘দৈনিক আমাদের সময়’। যদিও আমার মেইনস্ট্রিম অভিজ্ঞতা আমাকে বার বার ঋদ্ধ করেছে। এফডিসি কাজ করার আগে থেকেই আমি চলচ্চিত্র সংসদ কর্মী। চাষী আংকেল এগুলো পছন্দ করতেন না। বিকেল পাঁচটা বাজলেই শাহবাগ আসার জন্য মন আকুপাকু করত। আমাকেও আমার সঙ্গ অদ্ভুত ভালোবাসতেন চাষী আংকেল। শাহবাগে আসতে দিতেন না বলে লুকিয়ে বা মিথ্যা বলে আসতাম। টের পেলে বলতেন, ‘ফাহিম, বলে দিচ্ছি, সাবধান! শাহবাগ যাবি না। শাহবাগ গেলে কিন্তু তোর জীবনে কিচ্ছু হবে না। ওখানে সব গাঁজা খায়, কিচ্ছু জানে না। মোরশেদুল ইসলামরা তোদের মাথা খারাপ করছে। ওকে সামনে পেলে আমি মারব।’

যদিও আমি নিজেই ছোটবেলা থেকে গাঁজা খাই এবং মোরশেদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই বা তার কোনো প্রভাব আমার উপর ছিল না। আমার হিরো মোরশেদ ভাইও না, চাষি আংকেলও না। কারণ ‘আমি হিমালয় দেখিনাই, মহম্মদ খসরু দেখেছি’। আমি ম্যাজিক দেখিনাই, নুরুল আলম আতিকের ‘চতুর্থ মাত্রা’ দেখেছি। খসরু ভাই বা আতিক ভাইয়ের সঙ্গে আমার গভীর কোনো ভাব ছিল না। তবুও এরা দূর থেকে আমাকে মোহিত করেছিল। যে স্বপ্ন লালন করে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, এরা যেন সেই স্বপ্নের বীজ বোনা কৃষক। বলা বাহুল্য হতে পারে যে পাবলিক লাইব্রেরীতে ২০০০ সালে আশিক মোস্তাফার ‘ফুলকুমার’ এর প্রিমিয়ার, তারও আগে তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’ প্রিমিয়ার এবং তারও আগে মোরশেদুল ইসলামের ‘চাকা’র প্রদর্শনীতে আমি উপস্থিত ছিলাম। তাই যেভাবেই হোক নিজেকে এখনো চলচ্চিত্র আন্দোলন অনুপ্রাণিত ফসল মনে করি।

স্কুল জীবন থেকে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হওয়ার করণে ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন ও প্রদর্শনী আমার নিয়মিত বিষয় ছিল কলেজজীবন জুড়েই। বাড়িতে মামার লাইব্রেরিতে সিনেমার বড় বড় বই ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়া আর পড়ব না এমন পাগলাভাব ক্ষণে ১৯৯৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার হল থেকে পালিয়ে আমি দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছি। ক্লান্ত হয়ে বেনাপোলে খালার বাড়িতে গিয়েছি। খালু সেখানে একটি ব্যাংকের ম্যানেজার। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে, ফিল্ম ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ এর আয়োজনে ছয়মাসব্যাপী ফিল্ম মেকিং কোর্স। খালাকে পটিয়ে টাকা নিয়ে ঢাকা এসে ভর্তি হয়ে গেলাম। ভর্তি হতে অনেক কষ্ট হলো। সার্টিফিকেট নাই আমার। আমি বললাম আমি আগে ভর্তিতো হই। উচ্চমাধ্যমিক যেদিন পাশ করব, তার পরেই না হয় সার্টিফিকেট নেব।

আসলে সার্টিফিকেটের প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। মূলধারার সঙ্গে আমার যুদ্ধতো শুরুই হয়ে গিয়েছে যেদিন পরীক্ষার হল থেকে পালিয়েছি সেদিন থেকেই। এখন আমাকেই আমার বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হবে, সার্টিফিকেট দিলেও আমাকেই দিতে হবে। আমার হিসেব ছিল যে, সামনে দিয়ে সিনেমা সম্পর্কিত কোনো কিছু গলে যেতে দেব না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছকে বিদেশি ফিল্ম স্কুলে পড়তে যাওয়ার সাধ আগেই উবে গিয়েছে। আমি পর পর দু’বছর সামদ স্যারের দাসত্ব গ্রহণ করলাম। ঢাকায় বাড়ি থাকা সত্ত্বেও আমার ঘরে জায়গা নেই। বস্তিতে থাকি, হাতে তৈরি গ্রিটিংস কার্ড বানিয়ে ঝোলায় নিয়ে ঘুরি, বিক্রি হলে খাদ্য মিলতো নইলে উপোস। এসময় শিক্ষক হিসেবে সঙ্গ পাই নির্দেশক শেখ নিয়ামত আলী, তানভীর মোকাম্মেল, মশিউদ্দিন শাকের, গবেষক অনুপম হায়াতসহ এফডিসির অনেকের। এখানে এফডিসি এবং বিকল্পধারার একটা সুন্দর সংমিশ্রণ ঘটেছিল। সামাদ স্যারের পরিকল্পনা অনেক বিশাল ছিল। অসম্ভব ভালোবাসতেন তিনি সিনেমাকে এবং আমাদের।

আরসিসিতেই সের্গেই বন্দারচুক ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে আমার চলচ্চিত্র সংসদকর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয়। কোনো একটা পোস্ট দেওয়া হয়েছিল, মনে পড়ছে না। কিন্তু আমাদের যেহেতু নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ আছে, আছে এমবাসি ব্যাকআপ, ৩৫ মি.মি. প্রোজেক্টর আর বিশাল রাশিয়ান এবং মিত্র দেশগুলোর ফিল্ম আর্কাইভ। রাশিয়ান ফিল্ম আর্কাইভের একটি ছবিও বাদ দেইনি। সামাদ স্যারের কারণে আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’ আমরা দেখেছি ৭০ বারের বেশি। ক্লাসিক দেখার প্রতিযোগিতা তখন। সপ্তাহ আগে থেকে শিডিউল প্যাক থাকত বিভিন্ন কালচারাল সেন্টার আর অ্যামবাসিগুলোতে। পাঁচ বছরে পাঁচ হাজার সিনেমা আমরা নিশ্চয়ই দেখেছি। কেউ কেউ বাদ পড়তে পারে এই সংখ্যার বিচারে। এসময় সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়। বায়েজিদ কামাল কমন পড়েছে প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে। এছাড়া রহমান লেনিন, জাহিদুল ইসলাম সুমন, বিবেশ রায়, কাওসার মাহমুদ, শিরিন সুলতানা অণুসহ আরও অনেকের নাম এখন মনে পড়ছে না। প্রত্যেককেই সিনেমার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে গিয়ে কিছু না কিছু ছাড়তে হয়েছে, স্বপ্ন বাংলা সিনেমাকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে হবে।

তখন আমি চিনি মাত্র জহির রায়হান ফিল্ম সোসাইটি আর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ। ২০০১ সালের দিকে পরিচয় হলো বিপ্লব মোস্তাফিজ, জহিরুল ইসলাম কচি, মহম্মদ খসরু, সলিমুল্লাহ খান, টোকন ঠাকুর, কবি সমুদ্র গুপ্ত, শর্ট ফিল্ম ফোরামের জাহিদুর রহিম অঞ্জন, জুনায়েদ হালিমদের সঙ্গে। আরও অনেকগুলো সংসদ সম্বন্ধে ধারণা হলো যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, জাহাঙ্গীরনগর চলচ্চিত্র সংসদ, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি, চলচ্চিত্রম ইত্যাদি সংসদগুলোর সঙ্গে। ফেডারেশন পলিটিক্স তখন তুঙ্গে। চোখের সামনে ফেডারেশন ভাগ হতে দেখলাম। এসেই নোংরামি দেখে ভক্তি কমে যায়।

যদিও খসরু ভাইয়ের সামনে ওইসব চুনোপুঁটিরা কিছু না। ২০০২ এ খসরু ভাইয়ের ফেডারেশনের পক্ষে বিপ্লব মোস্তাফিজের অনুপ্রেরণায় আমরা বন্ধুরা সংগঠন করলাম বাংলা চলচ্চিত্র সংসদ। সভাপতি সুমন খান মজলিস আর সাধারণ সম্পাদক রহমান লেনিন। সাইয়েদা, জনি, অঞ্জন—ওদের কথাও মনে পড়ছে। আমি চাষী আংকেলের বাসায় থাকি, নিয়মিত তাকে এসিস্ট করি, চিত্রনাট্য প্রস্তুত করি আর এদিকে ফিল্ম সোসাইটি করতে শুরু করলাম। পুরাই কন্ট্রাস্ট। এসময় ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে শাহাদুজ্জামান এর ‘ক্যলাইডোস্কোপ’ নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। ৫০০ টাকার ক্যাম্পেইন করে ১০০০ টাকা উঠেছিল। বাস্তবতায় তা আর সম্পন্ন হয়নি। ফিল্ম ফান্ড রেইজ করার যে যোগ্যতা তা তখনো পারিনি, এখনও পারি না। আমাদের স্বপ্ন হলো ঘুম ভাঙার পর কেউ এসে বলবে, ‘কিরে ফাহিম শুইয়া আছিস কেন? তাড়াতাড়ি ওঠ। সবাই দাঁড়াইয়া আছে, শুটিং!’

একজনের কথা বাদ পড়ে যাচ্ছে, মানজারে হাসীন মুরাদ। আমরা এতো খুঁটিয়ে সিনেমা দেখতাম যে সিনেমার ইতিহাস নিয়ে আমাদের জ্ঞানের অহংকার ছিল। নরওয়ের ফান্ডে স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নন ফিকশন ওয়ার্কশপে মুরাদ ভাইয়ের সান্নিধ্য পেয়ে দেখি উনি বিশেষ করে নন ফিকশন ফিল্মমেকারদের আত্মীয়দের খবরও জানেন। মুরাদ ভাইকে ফিল্মমেকার হিসেবে চার্মিং লাগে না আমার কিন্তু তার জ্ঞান ও পড়ানর স্টাইল আমাকে অভিভূত করল। ফিল্ম ফান্ডের প্রতি আগ্রহ বাড়ল। আর উপলব্ধি করলাম নন ফিকশন আর ফিকশনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

প্রোপোজাল রাইটিংয়ে আমার বিশেষ সুনাম রয়েছে, তারপরও নিজের জন্য পাহাড় ঠেলতে আমার বাঁধে। ধারণা ছিল অন্যের জন্য যদি নিবেদিত না হই তাহলে আমার জন্য কেউ নিবেদিত হবে কী করে! আমি চলচ্চিত্র অনুদান ও ফেস্টিভ্যাল সংস্কৃতিতে জ্ঞান অর্জন শুরু করলাম। আমার পছন্দ হলো না আবার। এখানেও একধরণের কাগজপত্রের জটিলতায় আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ফান্ড রাইজিং কালচার আমাকে বিরক্ত করল। আমি বুঝতে পারলাম সিনেমা বানাতে হলে প্রথমে নিজের আত্মপরিচয় জানা লাগবে। স্বরূপ চিনতে হবে। আমার কন্টেন্ট এলজিবিটি না এন্টি মুসলিম ঘরানার মধ্যে পড়লো সেটা না, আমার কন্টেন্ট আমার কিনা সেটা আবিষ্কার করা জরুরি। আমি দেখলাম দেশটা ৭১ এর হেজিমনিতে আটকে আছে। আত্মপরিচয় সংকটে ভুগছে। কারো কাজে নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের সন্ধান নেই। এদেশে ভালো সিনেমা মানে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। ওই সময় বিএনপি ক্ষমতার নিদর্শনে অনুধাবন করলাম মুক্তিযুদ্ধর ইতিহাস ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে ঐতিহাসিকভাবে আমরা ফাঁদে পড়ে গিয়েছি। আমাদের শুরু করতে হবে আবার শুরু থেকে। আবিষ্কার করতে হবে আমাদের ভূতাত্ত্বিক পরিচয়। নইলে এদেশে কোনোদিন সিনেমা প্রস্ফুটিত হবে না। এখানে বলা দরকার, ইতোমধ্যে হুমায়ুন সাধুর বদৌলতে বাংলাদেশের একাংশ বাউলের সঙ্গে আমার সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং মেহেরপুরের ফতেহপুরের দরবেশ দৌলত ফকিরের ভক্ত হয়ে পড়ি এবং বাংলা মানবতাবাদী দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করি।

এসময় দেখতে পেলাম চলচ্চিত্র মেজাজের বিপরীত কিছু মানসিকতার লোকরাই চলচ্চিত্র ঝাণ্ডা বহন করতে শুরু করল। নাটক থিয়েটারের লোকরা সংস্কৃতি চর্চার নামে সিনেমার চেয়ারগুলো দখল করছে। চলচ্চিত্র আন্দোলন স্তিমিত হতে শুরু করেছে। খসরু ভাইয়ের প্যাটার্ন আমার সেকেলে লাগতে শুরু করে। এতো কান্নাকাটি আর গরীব সংস্কৃতি ভালো লাগল না। দেখলাম আমার জন্য কেউ ভাবছে না। দিন শেষে খসরু ভাইও বইয়ের গাদায় শুয়ে থেকে তার নিজের ইন্টেলেকচুয়াল স্বার্থই চরিতার্থ করছেন। আমাদের জন্য ভাবছে না কেউ।

এরমধ্যে জাহিদ ভাইয়ের নেতৃত্বে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ফিল্ম ডিপার্টমেন্ট চালু হচ্ছে। অতি সমারোহে এম আব্দুস সামাদকে চেয়ারম্যান করে খোলা হলো ফিল্ম মেকিং এন্ড স্টাডি ডিপার্টমেন্ট। সামাদ স্যার মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে এটি টেলিভিশন এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ এ রূপান্তর হয়। বিষয়টি স্যার মেনে নিতে পারেননি। তিনি প্রচণ্ড আহত হয়েছিলেন। এসময় স্যার আমাকে বলেছিলেন, ইন্টারমিডিয়েট পাশ না করে যাতে তার সামনে না যাই। আমি নিরুপায় হয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। হঠাৎ স্যার চলে গেলেন আর আমার সঙ্গে দেখা হলো না, পড়াও হলো না।

আমি আর জাহিদ ভাই আবার ট্র্যাক চেঞ্জ করে ‘আলোর মিছিল’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার কাজ শুরু করি। এরকম অনেক ঘটনার সাক্ষী আমাদের ম্যাচুর করে। ঠিক করলাম সিনেমা বানাতে হবে নিজের টাকায়। কারো তাবেদারি নয়। তাছাড়া বাড়ি ফিরে গেছি ইতোমধ্যে। অনেকদিন পর নিজ ঘরে এসিরুমে ঘুমিয়ে আমার প্রোডিউসার স্বত্বা জেগে উঠল। ভাবলাম বাসা থেকে কিছু একটা নিশ্চয়ই করবে। শহিদুল জহিরের ‘কার্তিকের হিমে জ্যোৎস্নায়’ এসময় আমার নজরে আসে। চিত্রনাট্য তৈরি করে ঘুরলাম, কোনো সাড়া পেলাম না। সবাই সেন্সর বোর্ডের ভয় দেখায়। আর আমার সিনেমা পাগল মা কখনো কিন্তু চায়নি তার ছেলে ফিল্মমেকার হোক। কারণ সে চাষীর জীবনের টানাপোড়ন দেখেছে। এবার আমার সাহস পুরোপুরি ভেঙে গেল। আমাদের সবার নাকউঁচু ভাবগুলো এসময় একত্রিত হলো। বন্ধুরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, কেউ চাকরি, কেউ টেলিভিশনে, কেউ এজেন্সিতে আর কেউ বিজ্ঞাপনের নয়া বাতাসে ভাসতে লাগল। কেউ হারিয়ে গেল স্মৃতির অতল গহ্বরে।

এসময় বন্ধু হিসেবে পেলাম পুনে ফেরত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সম্পাদক সামির আহমেদকে। রাজীব আশরাফ, রনি মাহার, জুনায়েদ মিতুল, পলাশ চৌধুরী, ফুয়াদ নাসেরসহ আরও একটি গ্রুপ ‘কালনেত্র’, ‘মাঞ্জাসূতা’ নামে ছোট কাগজ করত। সবার সঙ্গে আমার প্রাণসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরা সবাই সিনেমা তৈরিতে, গল্প বলতে এবং সিনেমার মানুষ হয়ে উঠতে প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছে। ফিল্ম সোসাইটির সঙ্গে এদের কোনো সম্পর্ক নেই। সার্কেলের শর্টফিল্ম বানাতে গিয়ে আমরা প্রায়ই এক হয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আমাকে এ-ও ডেকে নিয়ে যায় সহকারী পরিচালকের দায়িত্বে কাজ করাতে। আমরা একে ওপরের কাজে সাহায্য করতে গিয়ে একটা খতরনাখ টিম হয়ে উঠলাম। সামির আহমেদের নেতৃত্বে আমরা গাঁও প্রোডাকশন তৈরি করলাম। আমাদের স্কিল আমাদের ক্রমে বিজ্ঞাপনের দিকে ঠেলে দিল। আমাদের ভালো লাগতো প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি হতে। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনচিত্রের মান উন্নয়নে আমরা নিবেদিত হয়ে পড়লাম। যদিও আত্মনির্ভরশীল চলচ্চিত্রে আমরা পাশাপাশি আমাদের স্কিল সার্ভ করতে থাকলাম। সামির তো প্রচুর ইনডিপেনডেন্ট কাজে সহায়তা করে। এসময় আমরা অবারিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেদের স্কিল ডেভেলপমেন্টের চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। পাঁচ-সাত বছরে কমপক্ষে ৩০০ বিজ্ঞাপন নির্মাণ করেছি। এসময় আমি, রাজীব, রনি অনেকগুলো শর্টফিল্ম বানিয়েছি, যেগুলো এডিটিং টেবিলে নিজেরা দেখে আত্মতৃপ্তি নিয়েছি। আলাদা করে রিলিজ করার প্রয়োজন মনে করিনি। এগুলো বড্ড ভুল ছিল।

যতোই কাজ করি না কেন, স্বপ্নতো বিজ্ঞাপন নির্মাতা হব এমন ছিল না। হতাশা আবার চেপে বসল। দেখলাম চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে ভর করে বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রি নয়, বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রিকে ভর করে চলচ্চিত্র সমাজ তৈরি হচ্ছে। পত্রিকা টেলিভিশনে ফিল্ম মেকারদের চেয়ে এড মেকারদের জৌলুস বেশি। সেই সময় আমি একটি ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে আবার বিজ্ঞাপন থেকে বিরতি নিলাম। বললাম, ২০২৫ এর আগে বাংলা সিনেমার কোনো স্বরূপ ধরা পড়বে না। দুই একটি দুর্বল দৈব ঘটনা ছাড়া এখন পর্যন্ত বাংলা সিনেমার কোনো উদাহরণ নেই। তবে মানতেই হবে যে দেশে প্রচুর বোধহীন দক্ষ কর্মী তৈরি হয়েছে এই বিজ্ঞাপন ইন্ডাস্ট্রির উপর নির্ভর করেই।

এরমধ্যে আমি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ট্রাস্ট এর একটা ড্রামা প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ পাই। এই প্রোজেক্ট কাজের মধ্য দিয়ে জাতিগতভাবে এই প্রথম একটি বহুজাতিক ক্রুর সংমিশ্রণে পাশ্চাত্য ধারার সিনেমা নির্মাণ এবং আধুনিক কর্ম পদ্ধতি অনুধাবন করি। পূর্ব পরিচয় থাকলেও এখানে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এশা ইউসুফ ও শিমুল ইউসুফের সঙ্গে। বাচ্চু ভাইয়ের ‘গেরিলাতে’ কাজ করার জন্য আমি ও এশা বিবিসির কাজ ছেড়ে দেই। কিন্তু ছবির তৎকালীন প্রধান সহকারী পরিচালক নুরুল আলম আতিক ভাই ততক্ষণে বিবিসির উপর মারাত্মক চটা। তাছাড়া বিবিসির অতিবাহুল্য কর্মযজ্ঞ হয়তো তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। আমি আর এশা চেয়েছিলাম বিবিসিতে আমাদের সার্বিক ইনিস্টিটিউশনাল ম্যানেজমেন্ট অভিজ্ঞতা ‘গেরিলাতে’ সফলভাবে প্রয়োগ করতে। কিন্তু আতিক ভাই আমাকে ‘কমফোর্ট সিকার’ খেতাবে ভূষিত করে রিজেক্ট করে দিলেন। তাতে যে গেরিলার কোনো ক্ষতি হয়েছে সে কথা বলছি না। তবে আমি ও এশা হতাশ হলাম। সর্বোপরি আতিক ভাইয়ের ‘লাল মোরগের ঝুটি’ জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত হয়েছে তাছাড়া ‘পেয়ারা সুবাস’ আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতে যাচ্ছে। তার প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভকামনা করছি।

২০১০ এ সামির আহমেদের পরিচালনায় আমারা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘হুসেল পপ পপ’ নির্মাণ এর প্রস্তুতি নেই। এখানেও যুক্তরাজ্য, ভারত ও বাংলাদেশের একটি পরিক্ষিত টিমের সংমিশ্রণে মেথোডিকাল কাজ করার জন্য মাঠে নেমে পড়ি। ক্রিয়েটিভ আসপেক্টের কথা এখানে বলছি না। ছবিটি প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদীকে কেন্দ্র করে ডিজাইন করা হয়েছিল। শুটিংয়ের দশ দিন আগে তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নেওয়ায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। টিম ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এরপর আমরা আর কোনোদিন স্বপ্ন দেখিনি। সবাই যার যার জায়গায় জীবনকে মেনে নিয়ে আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, যার যার মতো কাজ করে যাচ্ছি। ২০১৩তে আমি নেসন হাট লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে করোনার আগ পর্যন্ত চালিয়ে গেছি। মাঝখানে করপোরেট এজেন্সিকে সার্ভ করেছি। বর্তমানে আইআরসিতে ডিজিটাল মার্কেটিং এবং কন্টেন্ট ডেভেলপমেন্টের কাজ করি। এখন কোনো সোসাইটি নেই, কোনো আন্দোলন নেই, কোনো চাহিদা নেই। আমাদের অস্থি মজ্জা সব শুকিয়ে গেছে। এখন যেন অপেক্ষা শুধু মৃত্যুর। আমাদের ব্যর্থতার গল্প বললাম ভবিষ্যতের অংকটা নতুন করে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য। আমার দায়িত্ব কেউ নেয়নি তাই বলে কি আমার কোনো দায়িত্ব নেই নাকি! আমার কাছে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত দায়িত্ব অর্পিত আছে। আপনার কাছে সে দায়িত্ববোধ নাইবা থাকতে পারে। আমার প্রতিটা পদক্ষেপ তো পরবর্তী প্রজন্মের জন্যই। আমি জানি এই কথা আপনাদের জন্যও সত্য।

বাংলা ফিল্ম সোসাইটি মরতে মরতে আবার জেগে উঠতে চায়। তাই আজকের মিলন। ২০৪৫ নাগাদ বিশ্বে যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাতে নতুন করে না ভাবতে চাইলে এসবের আর দরকার নেই। আমার বিশ্বাস আমার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল নয়। হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে। তাই নতুন প্রযুক্তি ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অভ্যুত্থানে আবার অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নিজেদের দিকে সমষ্টিগতভাবে তাকান দরকার। কারণ সিনেমা একটি সমষ্টিগত বিষয়। সিনেমা একটি জাতির বুদ্ধিমত্তার মানদণ্ড। সেই মানদণ্ডে আমরা আবার পিছিয়ে যাব, যদি তরুণ প্রাণের কথায় কর্ণপাত না করি।

ফিল্ম সোসাইটি চলচ্চিত্রকে একটি শিল্প মাধ্যম হিসেবে অনুধাবন এবং আত্মস্থকরণে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আত্মনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য প্লাটফর্ম হিসেবে তাদের কাজগুলো সিনেমা অনুরাগী ও সচেতন সংস্কৃতিবানদের নজরে এনে একটি বাগবিতণ্ডার সুস্থ চর্চা তৈরি করা চলচ্চিত্র সংসদগুলোর প্রথম কাজ। বোম্বে ফিল্ম সোসাইটি স্থাপনের মাধ্যমে সাউথ এশিয়াতে চলচ্চিত্র সংসদ সংস্কৃতি ক্রমে বাড়তে থাকে ১৯৪০ এর দশক থাকে মূলত সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবনাগুলোকে প্রকাশের উদ্দেশ্যে। কিন্তু চলচ্চিত্র সংসদের ভূমিকা আরও বিস্তৃত। এটা একটা সংস্কৃতি কেন্দ্র, রাষ্ট্রের কোণায় কোণায় জমে থাকা ক্ষুদ্র, মহতী ও বিকল্প চিন্তাগুলোকে এটা সংবদ্ধ করতে পারে। সিনেমা নিয়ে কথা বলার জায়গা করে দিতে পারে। বিশ্ব সিনেমাকে জানার ও বোঝার সুযোগ করে দিতে পারে অঞ্চল-দেশ-ঐতিহ্যের বিচারে, সিনেমার ক্রম বিবর্তনের রূপকল্পে। মূলত এটিকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবেই আখ্যা দেওয়া যায়। যদিও গত একশো বছরে আমরা কোনো শিল্প জাগরণের সামান্য রেখাও আঁকতে পারিনি এদেশে।

আমি মনে করি বাংলা ভাষায় প্রথম সাংস্কৃতিক জাগরণ চর্যাপদের কবিদের দিয়ে। তারপর চৈতন্য মহাপ্রভুর হাত ধরে ১৫ শতকে বৈষ্ণব দর্শনের বিস্তার এবং ১৭ শতকে লালন ফকিরের নেতৃত্বে বাংলার ভাব ও আধ্যাত্মবাদ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাংলায় মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, বস্তুবাদী দর্শনের পূর্ণ জাগরণ হয়েছে। বঙ্গীয় আত্মদর্শনের জন্য এই ইতিহাসকে উপলব্ধি করতে পারা এ অঞ্চলের প্রগতিশীলদের অবশ্য কর্তব্য বলে বোধ হয়। যদিও ১৯ শতকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ-বঙ্কিম পর্ব গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাকি যা কিছু আসবে তা বিচ্ছিন্ন চিন্তার গুরুত্বে জায়গা করে নিলেও নৃতাত্ত্বিক মুলের সন্ধান দেয় না। যদিও দর্শন শাস্ত্রের বাইরেও বাংলায় বিশাল এক ফোক শিল্প ও সাহিত্য সম্ভার রয়েছে। যেগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেও আমাদের এক জীবন পেরিয়ে যাবে।

এখন সময় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, যেটিকে বাদ দিয়ে সামনে কিছুই করা যাবে না বলে মনে হচ্ছে। মানে প্রযুক্তির সাহায্য যেমন নিতে হবে তেমনি মেশিনকেও আঞ্চলিক জ্ঞান দিয়ে এমনভাবে তৈরি করতে হবে যে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও মাটির কাছাকাছি সৃষ্টি করতে পারে। নাহলে এলোমেলো তথ্যের ভিত্তিতে আজেবাজে বাংলা কন্টেন্টে ভরে উঠবে নেট জগত। আর এ অঞ্চলের মেশিন লার্নিংয়ের উপজীব্য যে আধ্যাত্মবাদ দিয়ে করতে হবে তা বলতে আর বাধা থাকা উচিত নয়। সনাতনী শিক্ষার আলোকে তেমনি ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, সাধক, বৈরাগী, যোগী-সন্ন্যাসী, বাউল, ফকিরদের অনুসরণ করলে যে সাংস্কৃতিক ইতিহাস পাওয়া যাবে আমাদের সেদিকে নজর থাকা দরকার। সেই বিচারে অধ্যাত্মবাদী সিনেমা ও সিনেমা নির্মাণে আধ্যাত্মবাদ আমার বর্তমান আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। আমার কিছু ছোট ছোট কাজে এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্যাবহারিক প্রয়োগ করেছি। এই বিষয়ে পরবর্তী একটা লেখা তৈরি করব বলে মনঃস্থির করেছি। সেখানে আরও বিস্তারিত বলা যাবে আশা করি।

পাঠকদের ভাবনা নিশ্চয়ই আরও গভীর। আমার এই লেখা শুধুই একটি অনুসর্গ মাত্র। আমরা চাই যে, সবার কথাগুলো এক জায়গায় করে অচিরেই একটি আধুনিক সমাধানের দিকে যাত্রা করব এবং পরবর্তী সময়ের জন্য দিশা তৈরি করব।

চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের করণকৌশল

আমারা জানি অনুন্নত দেশগুলোতে সিনেমা সংস্কৃতিকে বেগবান করতে বা লোকাল কমিউনিটিকে চলচ্চিত্র সচেতন করে তুলতে চলচ্চিত্র সংসদগুলো নানা ধরণের উদ্যোগ নিতে পারে। যুগের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে আমাদের অগ্রযাত্রাকে সমন্বিতভাবে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে এবং চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করে তুলতে হবে। এখানে কিছু নয়া আঙ্গিক উত্থাপন করা হলো যা আপনাদের ছোঁয়ায় আরও পরিপুষ্ট হয়ে উঠবে আশা করি—

১। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও প্রেক্ষাগৃহ: আমরা জানি চলচ্চিত্র সংসদ নিয়মিত দেশ ও সংস্কৃতি অনুসারে ক্লাসিক এবং কনটেম্পোরারি সিনেমার প্রদর্শনী আয়োজন করে থাকে। যেটা এক শ্রেনির সচেতন দর্শককে বিস্তৃত সিনেমাটিক অভিজ্ঞতার মধ্যে যাত্রা করায়।

ছোটবেলায় আমাদেরও সিনেমা নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষাজনিত হতাশার মুল কারণ ছিল প্রেক্ষাগৃহের অভাব। আর বিকল্প সিনেমার জন্য দরকার ছিল ছোট ছোট থিয়েটার। পরবর্তীতে টেলিভিশনের সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে ওটিটি প্লাটফর্ম বিকল্প হিসেবে এখন নির্মাতাদের কাছে জনপ্রিয় মাধ্যম। সেন্সর বোর্ডের খবরদারি এড়িয়ে এটা নির্মাতাদের অনেক স্বাধীন করে দিয়েছে। দেশ-কালের বেড়াজাল ছিন্ন করে এটি অসাধারণ বিপ্লবের হাতিয়ার। তাই একটি সমকালীন সংসদ নিশ্চয়ই ভাববে না যে সিনেমা দেখানোর নামে প্রেস রিলিজ-পোস্টার-প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া করে লোক দেখানো জনসমাবেশ করে মিডিয়া আকর্ষণ বা রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে। এখনকার ছেলেপেলেরাও এই ওভার ট্রাফিক শহরে নিজের হোম থিয়েটার ছেড়ে কেনইবা বাইরে যাবে? তাই বিকল্প পথ খোঁজা আবশ্যক নয় কি? তাছাড়া অগমেন্টেড বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সামনে সিনেমার মুল স্ক্রিন হয়ে উঠবে। এমন অবস্থায় কন্টেন্টের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে। আমরা কি সেই পরিবর্তনগুলো দেখতে পাচ্ছি? সেই অনুযায়ী আমাদের তেমন কোনো প্রস্তুতি আছে কি?

২। চলচ্চিত্র উৎসব ও পুরষ্কার: চলচ্চিত্র সংসদ উৎসবের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সিনেমার আনন্দরস ও অভিজ্ঞান উপভোগ করতে পারে। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের দর্শন ও সংস্কৃতি ভাবনাগুলো প্রদর্শনের জন্য এটা প্লাটফর্ম হিসেবে শক্তিশালী মাধ্যম।

ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল যে শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রের সিনেমা দেখায় তা নয়। নির্মাতাদের সঙ্গে নির্মাতাদের একটা সংযোগস্থল এটি। এটি আয়োজকদের দার্শনিক ও রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা দেয়। উৎসব একটি মার্কেটপ্লেসের মতো আবার একটা বাহাস পয়েন্টও। একটা সোশ্যাল মিটিং পয়েন্ট। যেখানে নির্মাতা ও দর্শক একে অপরের সঙ্গে মুখোমুখি হয়। যেটাকে এই মুহূর্তেই সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে রিপ্লেস করা যায়। ফিল্ম এক্টিভিস্টদের একটি নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম থাকলে এবং সেটা ওটিটির সঙ্গে সংযুক্ত করে দিলে আন্দোলন দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠবে।

৩। চলচ্চিত্র নির্মাণ কর্মশালা ও ইনস্টিটিউট: প্রতিশ্রুতিশীল নির্মাতাদের দক্ষতা বিনির্মাণে চলচ্চিত্র সংসদ বিভিন্ন পরিসরে চলচ্চিত্র কর্মশালা আয়োজন করে। এতে করে আঞ্চলিক সিনেমার উন্নয়ন ও দক্ষ কর্মীবাহিনী তৈরির সুযোগ হয়।

এখনকার বাস্তবতায় একটি ফিল্ম সোসাইটির পক্ষে নিয়মিত কর্মশালা আয়োজন করা দুঃসাধ্য। তাছাড়া ফ্রি অনলাইন এক্সেস ও ইউটিউব কন্টেন্টের যুগে আপনার লেকচার শোনার জন্য টাকা খরচ করে ভর্তি হয়ে ৩০০ টাকা সিএনজি ভাড়া দিয়ে একজন তরুণ সময় নষ্ট করবে কেন? যেমন অনেকদিন পর বন্ধুদের এক জায়গায় করার বাসনা না থাকলে বা বন্ধুদের সায় থাকলে এই সভাটিও অনলাইনে করা যেত। যদিও অতটা ডিসকানেক্টেড হওয়ার কথা আমি বলছি না। পরিকল্পিতভাবে ইউটিউব এডুকেশনাল কন্টেন্ট তৈরির মাধ্যমে ফিল্ম সোসাইটি তার নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারে সহজেই, শুধু সেই কথা বলছি। তাছাড়া আগে যেমন আমরা সার্চ ইঞ্জিনগুলো ব্যাবহার করেছি পড়াশোনা করার জন্য বা জানার জন্য সেরকম আর নেই। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স জায়গাটা দখল করে নেবে। এখন যেমন এআই স্ক্রিপ্ট লিখে দিচ্ছে, আর্কাইভ থেকে শট পিক করে এডিট করে দিচ্ছে, ধারণা করতে পারছেন না অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ নির্মাতারা কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাবে?

৪। চলচ্চিত্র সমালোচনা ও প্রকাশনা: চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন আর কিছু না হোক নিয়মিত আলোচনা, সেমিনার, গোলটেবিলের মাধ্যমে সিনেমাকে ভেঙেচুরে দেখতে পারে। এর মাধ্যমে সিনেমার শৈল্পিক আঙ্গিকগুলো দর্শকের অনুধাবনের সুবিধা হয়। বিশেষ করে চলচ্চিত্র সমালোচনা অনুপ্রাণিত হয়। আর সর্বোপরি বিষয়গুলোকে নিয়মিত প্রকাশনার আওতায় আনতে পারলে কমিউনিটি যোগাযোগ ও অগ্রসরতা বা পশ্চাতমুখিতা নথিবদ্ধ হয়।

প্রকাশনা বা ক্রিটিক্সের ক্ষেত্রেও আমাদের ভ্লগ, ব্লগ বা ই-পেপারের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। তাছাড়া কাউন্টার মতামতগুলোও এখানে তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়। সহজেই ব্যবহারযোগ্য একটা সংগঠিত অনলাইন প্রকাশনা আমাদের জরুরি ভিত্তিতে দরকার। ডিজিটাল উপস্থিতির অভাবে বাংলা ভাষা এখনও বিগ ডাটা বিপ্লবে প্রভাব ফেলতে পারছে না। মনে রাখা দরকার, মানুষ বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী হিসেবে যে গৌরব করে, অচিরেই তা প্রযুক্তির কাছে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এই মুহূর্তে এসব গৌরব থেকে আমাদের রেহাই দরকার।

৫। ফিল্ম আর্কাইভ ও লাইব্রেরি: ফিল্ম আর্কাইভ ও লাইব্রেরি স্থাপন অগ্রসর সংসদের গুরুদায়িত্ব। আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে আর্কাইভ সাহায্য করে।

শুরু থেকেই খসরু ভাই একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। এতো কষ্ট করে গড়ে তোলা লাইব্রেরি আমার কিংবা আমার বন্ধুদের কোনো কাজে লাগেনি। বইগুলো কোথায় কে জানে! ফিল্ম আর্কাইভের জন্য কঠোর আন্দোলন করে আমরা ব্যয়বহুল একটি ভবন ছাড়া কোনো গণসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। তাই আমাদের ই-বুক আর ডিজিটাল আর্কাইভের দিকে আধুনিক সমাধান খোঁজা দরকার। পরনির্ভরশীলতা বা রাষ্ট্রের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে কেন?

৬। চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রযুক্তি-উপকরণ সরবরাহ ও প্রযোজনা: উদীয়মান সংশ্লিষ্ট নির্মাতাদের অল্প খরচে নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করতে পারলে তাদের জন্য কণ্টকাকীর্ণ এই পথ চলা সহজ হয়। হাতের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসটা পেলে নির্মাতার সাহস বাড়ে। তাছাড়া নিজেদের প্রযোজনা করার পরিবেশ হয়। কো-প্রোডিউসার বা প্রোডিউসার হিসেবে একটা রেজাল্ট নেওয়া যায়। নিজেদের সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র শিল্পে অবদান রাখার সুযোগ তৈরি হয়।

যদিও আমার বন্ধুদের অনেকেই বলতে পারেন প্রযোজনা ফিল্ম সোসাইটির কাজ নয়। এক্ষেত্রে আমি বলতে পারি নির্মাণ না থাকলে এ যাত্রা সম্পূর্ণ হয় না। সিনেমাকে চর্চার মধ্য দিয়ে গভীরভাবে না দেখলে এমন মতামত আসতে পারে। সর্বোপরি চলচ্চিত্র সংসদ যখন ফিল্ম প্রডিউসার হয়ে ওঠে এবং আবার প্রদর্শনীতে গিয়ে শেষ হয় তখন তার যাত্রার একটা পরিক্রমা ঘটে। এভাবেই ফিল্ম সোসাইটি দেশের চলচ্চিত্র সংস্কৃতি উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখতে পারে।

তাছাড়া ফিল্ম ফান্ডের জন্য একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে আমাদের কাজ করা দরকার যাতে এই সময়ে আমার মতো একজন অলস উদাসীন নির্মাতাও তার মেধাবিকাশের এবং প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো কিছুকেই বাধা হিসেবে না দেখে। বাচ্চাদের হাতে তুলে খাইয়ে দিতেও আমাদের সচেষ্ট হতে হবে প্রয়োজনে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এটাতো একটা সার্কেল মাত্র। সিনেমার আসল বিষয় হলো কন্টেন্ট এবং সেটা হতে হবে আমাদের কন্টেন্ট। এখানে আমাদের কাজ করতে হবে সীমাহীন। বিশ্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতির, অর্থনীতি নিয়ে যেমন নতুনদের সচেতন করে তুলতে হবে তেমনি বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভাবদর্শন, সাহিত্যগুণ, গান, মনোজগত অনুভব করে দেখতে হবে নিজেদেরও। বিদেশি দর্শনের ভক্ত হওয়ার আগে দেখতে হবে এই ভূখণ্ডের নিগড় বিষয়গুলো যদি ফিল্মমেকাররা খুঁজে না দেখে তাহলে পিছিয়ে পড়তে হবে তরুণদের কাছে। হয়তো সামনে কৃত্রিম বুদ্ধি আমার চেয়ে ভালো গল্প বলতে শিখে যাবে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের চলচ্চিত্র সমাজে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলা সিনেমার শৈল্পিক আত্মপরিচয় অনুসন্ধিত হবে।

জয় বাংলা ।। জয়গুরু ।। আলেক সাইঁ

সমাপ্ত

লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক

সারাবাংলা/আইই

ফাহিম ফেরদৌস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর