বাংলাদেশের বিনোদন জগতে মেহের আফরোজ শাওন কোনো একক পরিচয়ে বাঁধা নন। অভিনেত্রী হিসেবে যেমন তিনি জনপ্রিয়, তেমনি সংগীতশিল্পী, নির্মাতা ও প্রযোজক হিসেবেও তার স্বতন্ত্র অবস্থান আছে। পর্দার আলো-ছায়ার বাইরেও তিনি একজন নাগরিক— এই পরিচয়টাই সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হলো শাওনের কণ্ঠে।
সাম্প্রতিক এক মামলাকে ঘিরে যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনা, অনুমান ও শিরোনাম, তখন বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাওনের বক্তব্য ছিল শান্ত, সংযত কিন্তু স্পষ্ট। তিনি বললেন— ‘আমি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নই, আমি সাধারণ একজন নাগরিক।’ এই এক বাক্যেই যেন শিল্পী-নাগরিক শাওনের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যায়।
শাওনের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলেননি। কোনো নেতা বা দলের নাম উল্লেখ করেননি। তিনি যা বলেছেন, তা একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা থেকেই বলা। কষ্ট পেয়েছেন, প্রশ্ন জেগেছে— সেখান থেকেই মত প্রকাশ।
এই জায়গাটিই বিনোদন অঙ্গনের অনেক শিল্পীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের মিল তৈরি করে। একজন শিল্পী যেমন সমাজের গল্প বলেন, তেমনি তিনিও সেই সমাজেরই অংশ। ফলে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় বিষয়ে অনুভূতি প্রকাশ করাটা অস্বাভাবিক নয়— বরং অনেক সময় সেটাই শিল্পীর মানবিক দায়।
শাওনের বক্তব্যে সবচেয়ে জোরালো যে প্রশ্নটি উঠে আসে, তা হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন— একাত্তরের পর এই ভূখণ্ডের মানুষের অন্যতম বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার।
তার কণ্ঠে সেই উদ্বেগ স্পষ্ট— সাধারণ মত প্রকাশ করলেই যদি মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয় তৈরি হয়, তাহলে বাকস্বাধীনতার জায়গা কোথায়?
এই প্রশ্ন শুধু শাওনের নয়, অনেক শিল্পী ও সাধারণ নাগরিকেরও। বিনোদন জগতের মানুষরা বরাবরই সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করেন। তাদের কথায় কখনো প্রতিবাদ, কখনো বেদনা, কখনো আশার গল্প উঠে আসে। সেই কণ্ঠ রুদ্ধ হলে সমাজও এক ধরনের নীরবতায় ঢুকে পড়ে।
এই ঘটনায় লক্ষণীয়, শাওন কোনো উত্তেজনামূলক ভাষা ব্যবহার করেননি। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যুক্তির সঙ্গে, আবেগের চেয়ে বিবেককে সামনে রেখে। নিজেকে ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা না করে তিনি বারবার নাগরিক পরিচয়টাকেই সামনে এনেছেন।
এই সংযত অবস্থানই হয়তো তাকে অন্য অনেক বিতর্কের ভিড়ে আলাদা করে তোলে। বিনোদন অঙ্গনের একজন পরিচিত মুখ হয়েও তিনি কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের ভাষায়—যেখানে ভয় আছে, প্রশ্ন আছে, আবার আশা ও বিশ্বাসও আছে।
শাওনের এই বক্তব্য আবারও মনে করিয়ে দেয়— শিল্পী মানেই কেবল বিনোদন নয়। তারা সমাজের অনুভূতির ধারক। কখনো গান, কখনো অভিনয়, আবার কখনো ব্যক্তিগত কথার মধ্য দিয়েই তারা সময়কে ধারণ করেন।
এই মুহূর্তে শাওন আলোচনায় আছেন একটি মামলাকে ঘিরে, কিন্তু তার কথার গভীরে রয়েছে বড় এক বাস্তবতা— একজন নাগরিকের কথা বলার অধিকার। বিনোদনের নরম আলোয় মোড়ানো এই গল্প তাই কেবল একজন অভিনেত্রীর নয়, বরং শিল্পী ও নাগরিকের সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
শেষ পর্যন্ত শাওনের কণ্ঠে উচ্চারিত সেই বাক্যটাই যেন সবকিছুর সারসংক্ষেপ— তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক নন, তিনি একজন সাধারণ নাগরিক।
আর সেই নাগরিকের কথাই আজ আলোচনার কেন্দ্রে।