Thursday 16 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অবৈধ সিম, ভূয়া একাউন্ট এরপর হুন্ডি

আজহার মাহমুদ
১০ নভেম্বর ২০২২ ১৬:১৫

আমাদের অর্থনীতিতে বড় একটি অংশ যোগ হয় রেমিট্যান্স। এই রেমিট্যান্সের মাধ্যমেই আমাদের রিজার্ভ বৃদ্ধি পায়। তবে এটি সাম্প্রতিক সময়ে অনেক কমে গেছে। যদিও কোনো কালেই আমরা আমাদের সম্পূর্ণ রেমিট্যান্স পাইনি। এর কারণ হচ্ছে হুন্ডি। এই হুন্ডির প্রকোপে আমাদের দেশের রেমিট্যান্স আমরা হারিয়ে ফেলছি।

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের নাজুক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশও হিমশিম খাচ্ছে। বর্তমানে দেশের একটি আলোচিত এবং নিয়মিত ইস্যু হচ্ছে রিজার্ভ। এই রিজার্ভ নিয়ে আবার দু’রকেমর আলোচনা হয়। একটা রির্জাভ সংকট, আরেকটা পর্যাপ্ত পরিমাণ রিজার্ভ থাকার গল্প।

বিজ্ঞাপন

তবে আমি সেই আলোচনা কিংবা গল্পে যাবো না। আমার বিষয় হচ্ছে আমাদের রিজার্ভ হারানোর সেই রাস্তা হুন্ডি নিয়ে। দেশ থেকে টাকা পাচার ও বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে টাকা পাঠানোর বিষয়টিই এখন মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার এবং বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে রেমিট্যান্স ঢুকছে মূলত হুন্ডির মাধ্যমে। এর ফলে দেশ একদিকে বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে। পাশাপাশি প্রবাসীরা তাদের আয় দেশে পাঠালেও হুন্ডির কারণে তা যোগ হচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই হুন্ডির দৌরাত্ম্য কোনো ভাবেই থামানো যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের নানা রকম পদক্ষেপ থাকলেও কোনো পদক্ষেপেই থামছে এটি। বরং প্রযুক্তির সহায়তা এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ফাঁকফোকরে দিন দিন আরও ফুলে ফেঁপে উঠছে হুন্ডির কারবার। এই কলামটি লিখার জন্য এমনই একজনের সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ হয়েছে আমার। আর সেখান থেকে কেঁচো খুড়তে বেরিয়ে এলো সাপ। নিরাপত্তার স্বার্থে তার নাম প্রকাশ করা যাবে না। মূলত এই কাজগুলো করে থাকেন বিভিন্ন অপারেটরের সিম বিক্রেতা এবং এজেন্টরা।

বিজ্ঞাপন

এই প্রসেসটা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে কামাল (ছদ্মনাম) বলেন, “আমরা মূলত সিম এক্টিভেট করি। এক্ষেত্রে আমরা একজন কাস্টমারের নামে অনেকগুলো সিম এক্টিভ করে ফেলি।”

তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সিম তো এখন একসাথে দুইটা রেজিস্ট্রেশন করা যায় না। আপনারা কীভাবে এতোগুলো করেন?”

উত্তরে কামাল বলেন, “রবি এবং এয়ারটেলে সিমের ক্ষেত্রে মালিকানা পরিবর্তন করার সুবিধা আছে। আমরা প্রথমে নিজেদের এবং নিজেদের পরিচিতদের নামে সিমগুলো এক্টিভ করে রাখি। এরপর সুযোগ বুঝে কাস্টমারদের উপর সেগুলোর মালিকানা পরিবর্তন করে দিই।”

একজন কাস্টমারকে কয়টা সিম দিয়ে দেওয়া হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা কাস্টমরা বুঝে এই কাজটা করি। কখনও ২/৩ টাও করি কখনও ১৫ টা ফুল করে ছেড়ে দিই।”

কামালের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে আরও নানান বিষয় জানা যায়। তারা এই অবৈধ সিম আরও এক উপায়ে রেজিস্ট্রেশন করে থাকেন। বর্তমানে আমাদের এনআইডি কার্ডের দুইটা করে নম্বর থাকে। উভয় নম্বর দিয়েই সিম রেজিস্ট্রেশন করা যায়। একজন কাস্টমার যখন তার স্মার্ট এনআইডি নিয়ে আসেন তখন তাদের পূর্বের এনআইডি সংখ্যাটাও তারা বের করে নেন খুবই দ্রুত। এইসব তথ্য বের করা তাদের কাছে খুবই সহজ কাজ। এভাবে একসাথে দুইটা সিম রেজিস্ট্রেশন করে কাস্টমারকে একটা দিয়ে নিজেদের কাছে একটা রেখে দেয়। এছাড়াও মালিকানা পরির্বতনের সিমগুলোতো থাকে। এভাবে প্রতি মাসে একেক জনের কাছে প্রায় কয়েকশ সিম জমা থাকে যা অন্যজনের নামে রেজিস্ট্রেশন হয়। এবার এসব সিম দিয়ে খোলা হয় ভুয়া রকেট, বিকাশ এবং নগদ। এগুলোও তারা করে থাকেন। আর এভাবেই তারা জড়িয়ে পড়েন হুন্ডি ব্যবসায়।

হুন্ডি বলতে আমরা বুঝি প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির বাইরের অর্থ লেনদেনের একটি উপায়। একে বাণিজ্যিক আদান প্রদান ও লেনদেনের অনানুষ্ঠানিক দলিলও বলা যেতে পারে। যার মাধ্যমে দুই পক্ষ বা ব্যক্তির মধ্যে টাকা লেনদেন হয়। বিশ্বের প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির অনুসরণ হয় না বলে হুন্ডির লেনদেনে দেশের সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।

এই হুন্ডির ব্যবসা করতে গেলে বেশ কয়েকটি বিকাশ একাউন্ট লাগে। আর এইজন্য এতোগুলো সিম প্রয়োজন। অনেক অনেক ক্ষেত্রে তারা একই বিকাশ একাউন্টের আরও একটা ভুয়া একাউন্ট খুলতে পারেন বলে জানায়। এতে করে তারা প্রসাশনের কাছে ধরা খাওয়ার সম্ভবনা অনেক কম।

এই একাউন্টগুলো থেকে মোটা অংকের টাকা তারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাঠায়। বিদেশ থেকে তাদের এজন্টে যে নম্বরে বিকাশ করতে বলবে তারা সে নম্বরে বিকাশ করে দেয়। অন্যদিকে বিদেশে সে পরিমাণ টাকা সেখানে দিয়ে দেয়। আবার এদিক থেকে বিদেশে টাকা পাঠাতে হলে তারা টাকা রিসিভ করে নিয়ে সে পরিমাণ টাকা সেখানকার এজেন্টকে বললে তারা সেখান থেকে দেয়। এভাবেই মূলত তাদের কাজ চলে।

দেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিমযয়ের জন্য দেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক, দেশের মানি এক্সচেঞ্জ, বিদেশি ব্যাংক ও হুন্ডির রেট ভিন্ন ভিন্ন। ব্যাংকের বিনিময় হারের তুলনায় হুন্ডিতে ভালো বিনিময়মূল্য পান বলেই প্রবাসীরাও হুন্ডিতে টাকা পাঠান। এমনকি সরকার ঘোষিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনার পরও হুন্ডিতে অনেক বেশি বিনিময় মূল্য পান প্রবাসীরা।

এছাড়াও বিদেশগামী ছাত্র, ব্যবসায়ী, রোগী কিংবা পর্যটক সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে ডলার কিনতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হন। বিদেশ থেকে আনা মুদ্রা বিক্রি করতে গেলে ব্যাংকে অনেক সময়ই বিনিময়মূল্য কম পাওয়া যায়। তাছাড়া ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। এতে ডলার কিনতে আগ্রহী গ্রাহকদের সময় ও কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। বিপরীতে হুন্ডি এজেন্টদের গ্রাহকরা ফোন দিলে তারা গ্রাহকের বাসায় টাকা ও বিদেশি মুদ্রা নিয়ে আসে, পাশাপাশি তাদের দেয়া রেটও ব্যাংকের থেকে ভালো। গ্রাহকদের কাছে ব্যাংকের থেকে হুন্ডির সেবা তাই সহজ, দ্রুত এবং নিরাপদ। এছড়া গ্রামে বা শহরে একেবারে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়েও হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেন হুন্ডির কারবারিরা। এছাড়াও হুন্ডি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত বলা যায়। লেনদেনকারীদের জন্যও এটা এখন ঝাঁমেলা মুক্ত।

শুধু তা-ই নয়, হুন্ডি ছাড়া টাকা পাঠাতে পারেন না অবৈধ হয়ে পড়া প্রবাসীরা। বিদেশে বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী শ্রমিকেরই বৈধ কাগজ নেই। ফলে তারা নিজেদের ডকুমেন্ট দিয়ে ব্যাংকে লেনদেন করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে দেশে টাকা পাঠাতে তাদের সহজ সমাধান হুন্ডি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বা সিআইডি সম্প্রতি জানিয়েছেন, বিভিন্ন মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত পাঁচ হাজার এজেন্ট অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোয় জড়িত। তাদের মাধ্যমে চার মাসে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার প্রবাসী আয় বিতরণ হয়। এভাবে দেশ বছরে প্রায় ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৭৫ হাজার কোটি টাকার রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি বা জিএফআই এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকার মতো।

এছাড়াও হুন্ডিতে অবৈধ অর্থের সাথে সাথে বৈধ অর্থও পাচার হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ এবং ব্যবসায়ীরাও তাদের উপার্জিত অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার করতে হুন্ডির সহায়তা নেয়। তবে শুধু অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থই বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে না। বৈধ অর্থও বিদেশে পাঠানোর জন্য হুন্ডির সহায়তা নিচ্ছেন অনেকেই। অনেক প্রবাসীই স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার জন্য দেশে থাকা সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার হচ্ছে বিদেশে। যা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে সবসময়।

অন্যদিকে দিন দুপুরে এই ধরনের জালিয়াতি করে এই সিন্ডিকেট করে যাচ্ছে ব্যবসা। এতে করে বিপাকে পড়ছে সাধারণ মানুষ। অবৈধ সিম দিয়ে অবৈধ একাউন্ট এরপর অবৈধ টাকা পাচার। এই লম্বা প্রসেসে অনেক বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। কিন্তু এদের যোগসূত্র এক জায়গায়। আর এইসব কিছুর সূত্রপাত হয়ে থাকে অবৈধ সিম থেকে।

তাই আইনশৃংখলা বাহিনির উচিত আরও গভীরভাবে এইদিকটাতে নজর দিয়ে এর মূল হোতাদের বের করা। সেইসাথে সরকারের এই বিষয় নিয়ে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তবেই আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল থাকবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অবৈধ সিম- ভূয়া একাউন্ট এরপর হুন্ডি আজহার মাহমুদ মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আইসিইউতে সাইফ আলী খান
১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৩৭

আরো

সম্পর্কিত খবর