নতুন দল গঠনে প্রতিক্রিয়া
নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও নতুনভাবে সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে প্রশ্ন
১ মার্চ ২০২৫ ১৮:১৬ | আপডেট: ১ মার্চ ২০২৫ ১৯:১৯
ঢাকা: গত বছর জুলাইয়ে সংঘটিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে। নতুন এ রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশে দলটিকে কেন্দ্র করে সাধারণ জনগণ ও রাজনৈতিক মহলের যেমন কৌতূহল ও প্রত্যাশা রয়েছে, তেমনি শোনা যায় কিছু সমালোচনাও।
এ প্রেক্ষিতে শনিবার (১ মার্চ) সারাবাংলার পক্ষ থেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এর সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদ এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ এবং গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান ও গণতন্ত্র মঞ্চের রফিকুল ইসলাম বাবলু প্রমুখের কাছে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র নেতাদের অভিনন্দন জানিয়ে তারা বলেছেন, দেশের প্রতিটি নাগরিক, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনীতি করার এবং প্রয়োজনে নতুন দল গঠনের অধিকার রয়েছে। তবে নতুন দলের মঞ্চ থেকে নতুনভাবে সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণায় দেশ ও জাতির মনে প্রশ্ন জেগেছে। এছাড়া দলটি বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয়েছে। এতে করে আসন্ন নির্বাচন কতটুকু নিরপেক্ষ হবে- এমন প্রশ্ন উঠতে পারে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) নতুন দলকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, নতুন দল গঠন হয়েছে এতে কোনো সমস্যা নেই। জাতীয় পার্টি বহু দলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক দল গঠন হয়েছে, তারা দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য তাদের কার্যক্রম চালাবে -এটাই জনগণের প্রত্যাশা। তবে সমস্যা হচ্ছে, দেশের জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে এমন আলোচনা চলছে যে, নতুন এ দলটি গঠনের পিছনে সার্বিকভাবে বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে। তার দৃষ্টি থাকবে সমান। এখানে সেটি অনুপস্থিত। কারণ এ রাজনৈতিক দলটি আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। যেহেতু অন্তবর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দলটি গঠিত হয়েছে, সেহেতু নির্বাচনের সময় এই দলের প্রতি সরকারের সহানুভূতি বা সমর্থন থাকবে। কিন্তু নির্বাচনের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকা দরকার। এতে সরকার কতটুকু নিরপেক্ষ থাকতে পারবে- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তিনি আরও বলেন, দেশের জনগণ ভোটাধিকারের ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জীবন দিয়েছে। সেই নিরপেক্ষ নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত না হয়, তাহলে দেশের জনগণ অবশ্যই একটা কিছু করবে।
সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পরে দেশে প্রায় দেড় ডজনের বেশি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ হয়েছে। আরো সমসংখ্যক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটবে। অতীতেও এরকম রাজনৈতিক দলে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। এগুলো আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখি। তবে নতুন দলগুলোর মধ্যে যারা সংগ্রামের শেষের দিকে এসে আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল, তাদের একাংশ যে রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটালো- সেটি নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। জনগণের ওইসব আলোচনা আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখছি। তবে নতুন দলকে জনগণ গ্রহণ করে এবং নতুন রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র এবং ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষা এগিয়ে নিতে তরুণ প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে অবশ্যই এটি ভালো খবর।
তিনি বলেন অনেকে রাজনীতি করে সাময়িক লাভের জন্য। সেটিকে সামনে রেখে কেউ যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে -তা জনগণ গ্রহণ করবে না।
রুহীন হোসেন প্রিন্স বলেন, নতুন দলের সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র ঘোষণাপত্রসহ বিস্তারিত জনগণ এখনো জানতে পারেনি। তবে তাদের সম্পর্কে ইতিমধ্যে দেশব্যাপী আলোচনা হচ্ছে সরকারি ছত্রছায়ায় এই রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়েছে। সরকারের আনুগত্য পেয়েই তারা রাজনৈতিক দল গঠন করেছে, একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে। এটা যদি ঠিক হয়, তাহলে জনগণের কাছে তারা সাময়িক গ্রহণযোগ্য পাবে, কিন্তু ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না- বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, তাদের সভা থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, নতুন স্বাধীনতা, নতুন সংবিধান প্রণয়ন ইত্যাদি। তাদের এই ঘোষণা জনগণ মেনে নেয় নি। কারণ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অর্জন হয়েছে- সেটি চিরন্তন সত্য। তাদের ওই ঘোষণা থেকে জনগণের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে যে, নতুন স্বাধীনতা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা মানে মুক্তিযুদ্ধকে বেজ্জতি ও নাকচ করা। দেশের জনগণ তাদের দাবি বা ঘোষণা মেনে নেবে না। তবে বাহাত্তরের সংবিধানে অনেক অসম্পূর্ণতা রয়েছে, তা দূর করার পক্ষে আমরা বলেছি এবং লিখিতভাবেও জানিয়েছি।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, ছাত্ররা একসময় রাজনীতিকে ঘৃণা করত। কারণ দেশে বি-রাজনৈতিকরণ চলছিল। তা থেকে তরুণ প্রজন্ম এবং সাধারণ মানুষ বলতো যে, তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। এর থেকে বেরিয়ে এসে ছাত্ররা যে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় আকৃষ্ট হয়েছে, সেজন্য তাদেরক ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, নতুন দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। আমরা প্রত্যাশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিদ্বেষের মনোভাব, সেটা পরিহার করে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বজায় রেখে নতুন দল সামনে এগিয়ে যাবে।
আমরা তাদের রাজনীতিক কার্যক্রম, আদর্শ ও জনগণের স্বার্থে তারা কতটুকু গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে শামিল হচ্ছে- সেগুলো দেখবো।
বজলুর রশিদ ফিরোজ বলেন, এর পাশাপাশি বলতে চাই, গণপরিষদের নির্বাচন ও নতুন সংবিধান -এটা তাদের প্রধান লক্ষ্য বলে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, তাদের এই ঘোষণা নিয়ে মানুষের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ সেকেন্ড রিপাবলিক আবার কেন? ১৯৭১ সালের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে গঠন হয়েছে। এখানে যে দুর্বলতা ও সমস্যা আছে- সেটা দূর করা যেতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। ইতোধ্যে নতুন সংবিধান প্রনয়ণ করার বিষয়টি প্রত্যাহিত হয়েছে। সংবিধানে সংকট এবং সাংঘর্ষিক বিষয়গুলো সংস্কার হতে পারে।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান নতুন দলকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, যারা নতুন দলের নেতৃত্বে থাকবে, তাদের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা। আমি আশা করি, দলটি জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রত্যাশা পূরণ করবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখবে।
তিনি বলেন, তবে নতুন দলের মঞ্চ থেকে যে ঘোষণাটি এসেছে অর্থাৎ ‘নতুন দেশ নতুন সংবিধান’ প্রণয়ন- এ ঘোষণা দেশ ও জাতিকে হতাশ করেছে। সকলের মনে রাখতে হবে যে, একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের হটিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। সেই রাষ্ট্রে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ে ভিন্নতা রয়েছে। দুটোই ভিন্ন জিনিস। তাদের এই ঘোষণার সঙ্গে কেউ একমত নয়।
গণতন্ত্রমঞ্চের অন্যতম নেতা ভাষানী পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিনন্দন জানাই। আশা করি, তারা দেশ ও জাতির কল্যাণে এবং দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের কার্যক্রম অব্যহত রাখবে। তবে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বিরাট অর্জন দেশ ও জাতি পেয়েছে, তা বিসর্জন দেওয়া যাবে না। ৭১ এর অর্জন বিসর্জন দিতে গেলে দেশের জনগন তা মেনে নেবে না।
তিনি বলেন, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, বিপ্লব হয়নি। এটাকে বিপ্লব বলা হলে তা ভুল হবে।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/আরএস