Wednesday 02 Apr 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হামজা যেভাবে বাংলাদেশের ফুটবলে

স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট
৩১ মার্চ ২০২৫ ১৭:২৫ | আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৫ ২২:৩৭

সময় সকাল ১১টা ৫২ মিনিট, ১৭ মার্চ। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার থেকে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে ল্যান্ড করল বিমান বাংলাদেশের একটা ফ্লাইট। সেই এক ফ্লাইটের জন্যই বিমানবন্দরের ভিআইপি গেটের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন ভক্ত-সমর্থক আর সংবাদকর্মীরা। কারণ দীর্ঘ ১১ বছর পর দেশে ফিরেছেন হামজা চৌধুরী। তার আগমন কিংবা প্রত্যাবর্তন, যাই বলুন না কেন; দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবার নজর সকাল সেদিকেই।

বিজ্ঞাপন

হামজা চৌধুরী ও জামাল ভুঁইয়া

এই সফরের মাধ্যমেই হামজাকে নিজের করে পেয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল। তার গায়ে উঠেছে বাংলাদেশের লাল সবুজ জার্সি। গত ২৫ মার্চ ভারতের বিপক্ষে হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেকও। সেই ম্যাচ কেমন গেল তার, এতক্ষণে আপনার জানা হয়ে গেছে হয়তো। ম্যাচ দেখে থাকলে ফলাফলও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু কীভাবে বাংলাদেশের হয়ে খেলার অনুমতি পেলেন হামজা? এই প্রশ্নের উত্তরই খুঁজব এই প্রতিবেদনে। তবে এর আগে চলুন আরও একটাবার ঘুরে আসা যাক, সেই ১৭ মার্চে, সেখানে হামজাকে বরণ করা হয়েছিল বীরের বেশে। যিনি বলে একটা লাথি না দিয়েও পেয়েছেন ন্যাশনাল হিরোর ট্যাগ।

বিজ্ঞাপন

ন্যাশনাল হিরো

১৭ মার্চ নিরাপত্তা বলয়ে থেকে বাফুফের কর্মকর্তাদের সাথে নিজের বাবা ও চাচাকে নিয়ে ভিআইপি গেটের সামনে হামজাকে দেখা যেতেই শুরু হলো ক্যামেরাপার্সন, ফটোগ্রাফার আর মাল্টিমিডিয়া জার্নালিস্টদের হুড়োহুড়ি। কে কার আগে ছবি নেবেন, কার ফ্রেমে আগে বন্দী হবেন হামজা। হৈ-হট্টগোলের মধ্যে কে কী বলছেন, বোঝার উপায় নেই। এর আগে থেকেই মূল ফটকের কাছে ‘হামজা! হামজা! স্লোগান তুলে অপেক্ষা করছিলেন সমর্থকগোষ্ঠী ‘বাংলাদেশ ফুটবল আল্ট্রাস’।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন হামজা চৌধুরী

বাফুফের কর্মকর্তারা মিনিট দুয়েকের চেষ্টায় সাংবাদিক-ক্যামেরাপার্সনদের শান্ত করার বৃথা একটা চেষ্টা করলেন বটে। তবে সেটা কাজে এলো না আদৌ। সেই হৈ-হল্লাতেই শুরু হলো মিনিট খানেকের সংবাদ সম্মেলন। ইংরেজি আর সিলেটি ভাষার মিশ্রণে কথা বললেন হামজা। অল্প কথাতেই জানিয়ে দিলেন ভারতকে হারাতে চান। এর আগে তাকে বরণের আয়োজন দেখে হামজা বলেছিলেন, ‘আমার হৃদয় আজ পূর্ণ।’

ছোট্ট সেই সংবাদ সম্মেলনের পর সানরুফ সংযুক্ত একটা গাড়িতে উঠেছেন হামজা, সপরিবারে রওনা দেন হবিগঞ্জ জেলার বাহুবলে অবস্থিত নিজ গ্রাম স্নানঘাটের পথে। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সানরুফ খুলে দুই হাত প্রসারিত করে দিলেন দুই পাশে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে সাধারণ ভক্ত; সবাই ছুঁয়ে দেখলেন হামজাকে। ভক্তদের ভালোবাসার কেবল শুরু তখন।

পুলিশ পাহাড়ায় বাকিটা রাস্তা তার সঙ্গী হয়ে রইল বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের গাড়ি। যারা বিমানবন্দর থেকে হামজার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তার পুরোটা সময় সরাসরি দেখানোর চেষ্টা করেছে সেই যাত্রাটা। আঞ্চলিক মহাসড়কে বানানো হয়েছে হামজার ছবি সম্বলিত অভ্যর্থণা তোরণ। গ্রামের রাস্তায় ঢোকার পথে দুই পাশে স্কুলের ছোট ছাত্র-ছাত্রীরা সারি বেধে দাঁড়িয়ে ছিল ফুলের পাপড়ি হাতে নিয়ে। হামজার গাড়িটা সরু রাস্তায় আসা মাত্রই ভিজল ফুলের বৃষ্টিতে। পেছনে ছিল বিশাল মোটর সাইকেল বহরও।

ভক্তদের সাথে হাত মেলাচ্ছেন হামজা চৌধুরী । ছবি: সংগৃহীত

হামজার বাড়িতেও এলাহি কাণ্ড। ছেলে আসবে বলে বাবা দেওয়ান মোরশেদ চৌধুরীও সাজান গেট, উঠানে বানান ছোট্ট একটা মঞ্চও। ঘর থেকে বেরিয়ে মঞ্চতে উঠতে গিয়ে সে আরেক কাণ্ড। মানুষের ভিড়ে পা ফেলা দায়, তবুও হাসিমুখে মঞ্চে উঠেছেন হামজা, নিজের ফোনে ছবিও তুলেছেন তাকে এক নজর দেখতে আসা মানুষদের। কারণ হামজা নিজেও জানেন, দেশের গ্রামাঞ্চলে ফুটবলের ক্রেজটা কেমন, কতটা আগ্রহ নিয়ে সবাই এসেছেন তাকে দেখতে।

তাই কথা বলতে এসে হামজা অল্প কথায় জানান, ভক্তদের ভালোবাসা ছুঁয়ে গেছে তাকে। ফেসবুকে প্রকাশিত এক ভিডিওতে হামজাকে বলতে দেখা যায়, ‘আসসালামু আলাইকুম এভ্রিওয়ান, আমার খুব ভালা লাগসে যে আফনারা সব যে আইসো আমারে দেখবার লাগি।’

ধন্যবাদ পর্ব শেষে হামজার কন্ঠে শোনা গেল বাংলাদেশ নিয়ে স্লোগানও। অথচ বিমানবন্দর থেকে স্নানঘাটে নিজের বাড়ির সেই মঞ্চ পর্যন্ত পুরোটা সময়ই শোনা গেছে ‘হামজা! হামজা!’ স্লোগান। আর হামজা নিজে বললেন, ‘বাংলাদেশ! জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ! বাংলাদেশ!’

হামজার বেড়ে ওঠা

হামজার জন্ম ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যের লেস্টারশায়ারে। পুরো নাম হামজা দেওয়ান চৌধুরী। তার মা বাংলাদেশি, জন্মদাতা বাবা গ্রেনাডিয়ান হলেও বেড়ে উঠেছেন সৎ বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরীর ঘরে। জন্মের প্রথম বছরেই পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে পা পড়েছিল হামজার। এরপর এসেছেন অনেকবারই। তবে এবারের ফেরাটা সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। 

ফুটবলে হাতে খড়ি

হামজার ফুটবলে বেড়ে ওঠা লেস্টার সিটি একাডেমিতে। ৭ বছর বয়সে একাডেমিতে ভর্তি হওয়া হামজা পেশাদার ফুটবলে প্রথম ম্যাচ খেলেন বার্টন আলবিয়নের হয়ে। ২০১৬ সালে লেস্টার সিটি তাকে লিগ ওয়ানের ক্লাবটিতে ধারে পাঠিয়েছিল। ইংল্যান্ডের ক্লাব ফুটবল কাঠামোয় লিগ ওয়ান তৃতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা। তবে পরের বছরই লেস্টার সিটি হামজাকে দলে ফিরিয়ে আনে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে লিগ কাপে লিভারপুলের বিপক্ষে বদলি নেমে লেস্টার সিটির মূল দলে হামজার অভিষেক হয়।

পেশাদার ফুটবলে পথচলা

টটেনহামের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে হামজার অভিষেক হয়। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্লাব প্রতিযোগিতাটিতে এখন পর্যন্ত ৬ মৌসুমে মাঠে নেমেছেন হামজা। এছাড়া ৪ মৌসুম অংশ নিয়েছেন চ্যাম্পিয়নশিপে, ইংল্যান্ডের ফুটবলে যা দ্বিতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা। পেশাদার ক্যারিয়ারের পুরো সময় ধরে হামজা লেস্টার সিটির খেলোয়াড়। তবে আরও তিনটি দলের জার্সি তার গায়ে উঠেছে। ২০১৬-১৭ মৌসুমে অ্যালবিয়ন, ২০২২-২৩ মৌসুমে ওয়াটফোর্ড এবং বর্তমান মৌসুমে শেফিল্ড ইউনাইটেডে ধারে খেলছেন তিনি।

হামজা  ইংল্যান্ডের বয়সভিত্তিক দলে খেলেছেন। ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব-২১ জাতীয় দলের হয়ে চীন অনূর্ধ্ব-২১-এর বিপক্ষে অভিষেক হয় তার। পরের বছর জায়গা পান উয়েফা ইউরোপিয়ান অনূর্ধ্ব-২১ চ্যাম্পিয়নশিপেও। ২০১৯ সালের জুনে ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলের হয়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে খেলেন হামজা। ইংল্যান্ডের ২-১ ব্যবধানে হেরে যাওয়া ম্যাচটিতে লাল কার্ড দেখেছিলেন তিনি। যদিও বাংলাদেশের জন্য সেটাই হয়তো শাপেবর হয়েছে বলা যায়।

পেশাদার ক্লাব ফুটবলে লিগ, এফএ কাপ, লিগ কাপ, উয়েফা ইউরোপা লিগ এবং উয়েফা কনফারেন্স লিগ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ২০৩টি ম্যাচ খেলেছেন হামজা। এর মধ্যে ২০২১ সালে লেস্টারের হয়ে জিতেছেন এফএ কাপ। গোল করেছেন দুটি।

বাংলাদেশের লাল সবুজে যেভাবে মিশে যাওয়া

ছোটবেলা থেকে বাংলাদেশে যাতায়াত এবং বাংলাদেশি পরিবারে বড় হওয়ার সুবাদে হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশ ফুটবল দলের হয়ে খেলার সম্ভাবনা ছিল সব সময়ই। তবে লম্বা একটা সময় পর্যন্ত ইংল্যান্ডের হয়েই খেলতে চেয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তা না হওয়ায় নিজের আগ্রহ, পরিবারের চাওয়া ও বাংলাদেশের ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগ মিলিয়ে হামজা বাংলাদেশের হয়ে খেলার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কাজী সালাহউদ্দিন সভাপতি থাকতেই বাফুফের দিক থেকে হামজা ও তার পরিবারের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়।

হামজা চৌধুরী

হামজার বাংলাদেশের হয়ে খেলার পথ খুলতে কিছু শর্ত পূরণ হওয়া দরকার ছিল। সবার আগে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেওয়া, এরপর মা-বাবার যেকোনো একজনের বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী হওয়া। এ ছাড়া ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এফএ) ছাড়পত্রসহ আরও কিছু বিষয় ছিল। 

২০২৪ সালের আগস্টে হামজা বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে পান, পরের মাসেই হামজাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলার অনাপত্তিপত্র দেয় এফএ। সেই অনাপত্তিপত্রসহ প্রাসঙ্গিক নথি ফিফার কাছ থেকে পাঠিয়ে দেয় বাফুফে। ১৯ ডিসেম্বর বাফুফে জানায়, হামজাকে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতি দিয়েছে ফিফার প্লেয়ার স্ট্যাটাস কমিটি। একই দিন এক ভিডিও বার্তায় হামজা বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের হয়ে খেলতে যাচ্ছি। আশা করি, দ্রুতই দেখা হবে।

সারাবাংলা/জেটি

বাফুফে বাংলাদেশ ফুটবল দল হামজা চোধুরী