Sunday 19 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্টিভেন টেলর: স্বপ্নালু চোখে লারার রেকর্ড ভাঙার প্রত্যয়

জুবায়ের তানিন, চট্টগ্রাম থেকে
১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:০৮ | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:০৪

সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে টেলর

জন্ম যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু উচ্চতা-মুখচ্ছবি কিংবা বাচনভঙ্গিতে ক্যারিবিয়ান ছাপ স্পষ্ট। পৈতৃক ভিটেমাটি ৮১৪ বর্গমাইল আয়তনের জ্যামাইকার উত্তর-পূর্বের পোর্টল্যান্ডে, কিন্তু বেড়ে ওঠা ফ্লোরিডা রাজ্যের আলো-হাওয়াতে। তবুও নিজের শেকড় ভুলে যাননি স্টিভেন টেলর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেললেও, বাবা সিলভান টেলরে আস্কারায় ক্রিকেটের পোকা ফ্লোরিডার মাটিতে মাথায় ঢুকলেও; ক্রিকেটের মহাসমুদ্রে টেলর পথ খুঁজে পেয়েছেন সেই জ্যামাইকাতেই। 

বিজ্ঞাপন

টেস্ট ক্রিকেটের পাঁড় ভক্ত তিনি, ক্রিকেটের জন্য কৈশোরেই ফিরেছিলেন নিজের শেকড় গাঁথা যেথায়; জ্যামাইকা। নয় বছর বয়সে খেলেছেন সিনিয়র লেভেলের ক্রিকেট। ১৫ বছর বয়সে ডাক পেয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দলে। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে দেশটার প্রথম সেঞ্চুরিও এসেছে এই বাঁহাতির ব্যাট থেকেই। আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছেন সিপিএলে। 

গত ডিসেম্বরে রংপুর রাইডার্সের হয়ে খেলেছেন গ্লোবাল সুপার লিগে, ফাইনালে দারুণ একটা ইনিংসে দলকে শিরোপা জেতাতে রেখেছেন অনবদ্য ভূমিকা। বিপিএলে একাদশতম আসরেও তার ওপর ভরসা রেখেছে রংপুর। প্রথমবার বাংলাদেশে খেলতে এসে একান্ত সাক্ষাৎকারে সারাবাংলা ডট নেটকে টেলর জানালেন বিপিএল নিয়ে তার ভাবনা, রংপুর রাইডার্সের ক্রিকেটারদের মেলবন্ধন, ক্রিকেটে আসার গল্প, ক্যারিয়ারের লম্বা পথে সাবেক ক্রিকেটার বাবার প্রভাব কতখানি। দেখা মিলল টেস্ট খেলার স্বপ্নে বিভোর, এক ক্রিকেটারেরও, যিনি কিনা লাল বলের ক্রিকেটে ভেঙে দিতে চান ব্রায়ান লারার অতিমানবীয় ৪০০* রানের রেকর্ড! 

সারাবাংলার পাঠকদের জন্য নিচে তুলে ধরা হলো সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ-

সারাবাংলা: প্রথমবার বিপিএল খেলতে এসে এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা কেমন?

টেলর: মন্দ নয় একেবারেই। টুর্নামেন্টে দারুণ খেলছি আমরা। আমিও ব্যাটিংয়ে ভালো শুরু পাচ্ছি, কিন্তু ইনিংস বেশি লম্বা করতে পারছি না। তবে গত ম্যাচে (চিটাগং কিংস ম্যাচ) নিজের সক্ষমতা দেখানোর ভালো সুযোগ পেয়েছিলাম। খুব বড় ইনিংস খেলিনি এখনও। তবে বিপিএল উপভোগ করছি।

সারাবাংলা: টানা ৮ ম্যাচ জিতেছেন। দলের অবস্থা কী? এমন দুর্দান্ত পারফম্যান্স দলের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে? 

বিজ্ঞাপন

টেলর: দলের সবার মধ্যেই দারুণ সম্পর্ক। আমাদের হাতে যেসব অপশন আছে, ম্যাচ জেতার জন্য তার সম্ভাব্য সব কিছুই কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। দিনশেষে ক্রিকেটাররাই খেলে। তাই প্রতিদিন মাঠে নেমে নিজেদের সেরাটাই দিতে চেষ্টা করি সবাই।

সারাবাংলা: রংপুরের জার্সিতে গ্লোবাল সুপার লিগ জিতেছেন। ফাইনালে আপনার ৬৮ রানের ইনিংস, সৌম্য সরকারের সাথে ১২৪ রানের জুটি। আলাদা কোনো স্মৃতি মনে পড়ে সেই ম্যাচের?  

টেলর: সেই ফাইনালের স্মৃতিচারণ করতে গেলে প্রথম ওভারের কথাটাই আগে বলব। টিভি রিপ্লেতে দেখাচ্ছিল ব্যাটের কানায় লেগেছে বল। কিন্তু আমি আপনাকে বলতে পারি, আমার ব্যাটে একদমই লাগেনি বল। কেউ কিছু শুনতেও পায়নি। তবুও স্নিকোমিটারে দেখাচ্ছিল ব্যাটে লেগেছে। এজন্য স্নিকোকে আমি বিশ্বাসও করি না (হাসি)। 

সারাবাংলা: প্র্যাকটিসে বেশ দুষ্টুমি, হাসি ঠাট্টা করছেন সতীর্থদের সঙ্গে। বন্ধুত্ব কার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি ভালো? 

টেলর: সাইফ হাসান ও সাইফউদ্দিন। সাইফউদ্দিনকে আগে থেকেই চিনি। সাইফ হাসানের সঙ্গে জিএসএলে পরিচয় হলো। দুজনই খুব ভালো বন্ধু। ওহ হ্যাঁ! সৌম্য সরকারের কথা না বললেই নয়! সৌম্যর সাথে আমার বন্ধুত্ব বেশ আলাদা। 

সারাবাংলা: ২০১৫ সালে প্রথম ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে যদি বলতেন… 

টেলর: আমি মূলত জ্যামাইকায় যাওয়ার একটা সুযোগ খুঁজছিলাম। তখন আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) আইসিসি ডিভিশন থ্রি পর্যায়ে খেলি। সেখানে উগান্ডার কাছে হেরে বসলাম। ডিভিশন টুতে আর উঠতে পারিনি। মোটামুটি দেড় বছরের মতো বিরতি পড়ে দেশের ক্রিকেটে। তবে আমি পেশাদার ক্রিকেটটা চালিয়ে যেতে চাচ্ছিলাম। বাবা-মাকে বললাম জ্যামাইকায় যেতে চাই, মা তো কিছুতেই রাজি হননি। তবে বাবা সবসময়ই সঙ্গ দিয়েছেন। বাবা নিজেও ক্রিকেটার ছিলেন, যদিও কখনো জ্যামাইকার হয়ে খেলেননি। 

‘স্বপ্নের পেছনে ছুটতে থাকো, যা হবে দেখা যাবে।’, বাবার এই কথাতেই আসলে আমি জ্যামাইকা যাওয়ার সাহসটা পেয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে স্থানীয় লিগে বেশ কয়েকটা সেঞ্চুরি করি, নামডাক ছড়াতেও বেশি সময় লাগেনি। 

সারাবাংলা: আপনার বাবাও ক্রিকেট খেলতেন বললেন,  তার ক্যারিয়ারের গল্পটা কী?

টেলর: বাবার জন্ম-বেড়ে ওঠা জ্যামাইকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পোর্টল্যান্ডে। সেখানেই স্থানীয় ক্রিকেট খেলেছেন। বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন। পোর্টল্যান্ডের সেরা একাদশ নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন হয়েছে। সেখানে বাবার নাম দেখে আমি অবাকই হয়েছিলাম। অবশ্য আমার এখনও মনে হয়, বাবা কোনো ভালো ক্রিকেটার ছিলেন না (হাসি)। তবে সব ছাপিয়ে তিনি আমার কাছে আমার বাবা। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। অবশ্য কোর্টনি ওয়ালশের মতো কিংবদন্তি থেকে শুরু করে সাবেক ক্রিকেটাররা বাবাকে চেনেন, এটাও কিন্তু কম কিছু নয়। আর আমার ক্রিকেট শুরু করার নেপথ্যে তার অবদান-প্রভাবই সবচেয়ে বেশি। 

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ক্রিকেট জনপ্রিয় না তেমন। তবুও অন্যান্য খেলা থাকতে ক্রিকেটকেই কেন বেছে নিলেন? 

টেলর: প্রতি রোববার, ছুটির দিনে বাবা ক্রিকেট খেলতে যেতেন। আমার বয়স তখন ৩-৪ বছর হবে। সেই ছোট্ট থেকেই নিয়মিত বাবার সঙ্গে মাঠে যেতাম। মাও যেতেন তখন। তবে ধীরে ধীরে মা অবশ্য আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। আমি দেখতাম সাদা জার্সি, কেডস পরে প্রতি রোববারে বাবা ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছেন। তাকে এভাবে দেখতে দেখতেই আমি ক্রিকেটের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। স্কুলে থাকতে ফুটবল, বাস্কেটবল, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড খেলেছি নিয়মিত। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে রাজ্য দলেও খেলেছি। পরে অবশ্য সেদিকে আর কিছু করিনি। আগ্রহ, টান কিংবা ভালোবাসার পুরোটা ক্রিকেটেই ছিল কেবল। 

সারাবাংলা: মাত্র ৯ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র ক্রিকেট লিগ খেলেছেন। অবাক হতেই হয়, এত অল্প বয়সে…

টেলর: প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ক্রিকেটে আমার প্রথম ম্যাচ ছিল। অবশ্য ম্যাচ খেলার জন্য আমার কোনো সাদা জার্সিও ছিল না। ঘরে পরার সাদা টি-শার্টের সঙ্গে ধূসর রঙের প্যান্ট পরেই আইল্যান্ডার ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে মাঠে নেমে গিয়েছিলাম সেদিন। ডিভিশন টু ক্রিকেট লিগের ম্যাচ ছিল সেটা। ওই দলে আমার খুব ভালো একটা বন্ধু ছিল, বছর দুয়েক আগে মারা গেছে। ও অনেক উৎসাহ দিত আমাকে খেলতে। বাবা চাননি আমি যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলি, কিন্তু ও সবসময়ই বলতো আমাকে খেলতে দিতে। 

সারাবাংলা: আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান আপনি। সেই গল্পটা একটু শুনতে চাই…

টেলর: জার্সির বিপক্ষে। জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচ ছিল। এর আগে সাদা বলের ক্রিকেটে দুই ফরম্যাটের দুটো সিরিজো খেলেছিলাম। কিন্তু ওয়ানডে সিরিজ চলাকালীন আমার কিটব্যাগটা হারিয়ে যায় নামিবিয়াতে। এখনও জানি না, কিটব্যাগটা কোথায় যে আছে!

কিটব্যাগ হারিয়ে দিশেহারা আমি। তাই চেয়েচিন্তে কারো থেকে ব্যাট, কারো থেকে জুতা নিয়ে খেলেছিলাম। এসব দেখে জার্সির ক্রিকেটাররা ভেবেছিল আমি বুঝি দলের সবচেয়ে খারাপ মানের ক্রিকেটার, যার একটা কিটব্যাগই নেই। তবে জার্সির বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই আমি সেঞ্চুরি করি। এরপর তাদের হাবভাবটা ছিল দেখার মতো। দেখেই মনে হচ্ছিল সবাই আমাকে হালকাভাবে নিয়েছিল। অথচ পরিকল্পনা ছিল আমার দলের বাকিদের ঘিরে। 

সারাবাংলা: ক্রিকেটে আপনার আদর্শ কে?

টেলর: দুজনের নাম বলব- ব্রায়ান চার্লস লারা ও ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল।

সারাবাংলা: ক্রিকেট ভক্ত হিসেবে পুরনো কোনো স্মৃতি মনে পড়ে?

টেলর: সবচেয়ে পুরনো বললে অ্যান্টিগায় ব্রায়ান চার্লস লারার ৪০০ রান। আমি ইনিংসটা লাইভ দেখেছি। আজীবন গল্প করার মতো মুহূর্ত। লারার অনবদ্য ব্যাটিং দেখে বাবাকে সেদিন বলেছিলাম, ‘এই রেকর্ডটা ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়া ক্রিকেটার হতে চাই আমি।’

একদিন হয়তো আমরা টেস্ট ক্রিকেট খেলব। আর যদি সুযোগ পাই সেদিনই ৪০০ রানের রেকর্ড ভাঙার লক্ষ্য থাকবে। একদম প্রথম দিন থেকেই এটি আমার স্বপ্ন, লারার রেকর্ড ভাঙব।

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রের টেস্ট খেলার সম্ভাবনা দেখেন?

টেলর: অবশ্যই! আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেখি। যদি ক্রিকেটার আর বোর্ডের লক্ষ্য একই থাকলে, একটা ভালো কাঠামো গড়ে উঠবে। টেস্ট ক্রিকেটটাও আমরাও খেলতে পারব। অনেক তরুণ ক্রিকেটার উঠে আসছে। সব মিলিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে খুব ভালো ভবিষ্যত দেখতে পাই আমি। 

সারাবাংলা/জেটি/

বিপিএল ২০২৫ রংপুর রাইডার্স স্টিভেন টেলর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর