Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্কালোনির হাত ধরেই বাজিমাত

স্পোর্টস ডেস্ক
১১ জুলাই ২০২১ ১৪:০৪

এই তো সেদিনের কথা। দিনের পর দিন ব্যর্থতার বোঝা ভারী হচ্ছে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের। ২৫ বছর জেতা হয়নি কোনো ট্রফি। ৫, ১০, ১৫, ২০ করে বিশ্বকাপ জেতার গল্পও ৩২ বছরের পুরনো। লিওনেল মেসি, আনহেল ডি মারিয়া ও সার্জিও এগুয়েরোর মতো তারকারা ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে। রক্ষণে এখন পর্যন্ত সময়ের শেষ তারকা হ্যাভিয়ের মাশচেরানো— তারও বিদায়বেলা। এমনই এক ভাঙা তরীর দায়িত্ব পড়লো মাত্রই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করা এক তরুণের ওপর। সিজার লুইস মেনত্তি, কার্লোস বিলার্দো, ড্যানিয়েল প্যাসারেলা, মার্সেলো বিয়েলসা, হোসে পেকারম্যানের মতো বাঘা বাঘা ম্যানেজার যে দলকে সামলেছেন, সেই দলের দায়িত্ব কি না এক অখ্যাত তরুণের ওপর! তিন বছর আগের সেই সময়টিতে আরও দীর্ঘ সময়ের জন্য আর্জেন্টিনা ফুটবলের শেষ দেখে ফেলেছেন ভক্তরা। আর কোনো আশা নেই!

বিজ্ঞাপন

সবার দৃষ্টিতে যখন শেষের বার্তা, তখনই যে নতুন গল্পটা মাত্র শুরু হতে যাচ্ছে— তখন তা কেউই বুঝতে পারেনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই তরুণ ম্যানেজারের হাত ধরেই প্রাণ ফিরল আর্জেন্টিনা দলে। দীর্ঘ তিন দশকের আক্ষেপ ঘুচাতে জয়ের জন্য কতটা মরিয়া হয়ে খেলতে হয়, সেটিই বুঝিয়েছিলেন দলকে। তার ডাকেই সাড়া দিয়ে চার চারটি ফাইনালের ব্যর্থতা ঘুচিয়ে মারাকানার মহারণে স্বাগতিক ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা দলের হাতে তুলে দিলেন। মাঠে লিওনেল মেসি, আনহেল ডি মারিয়া বা এমিলিয়ানো মার্টিজেনের যে বীরত্বগাঁথা— তার পেছনের কারিগর হয়ে আলো ছড়ালেন লিওনেল স্কালোনি।

বিজ্ঞাপন

২০১৮ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সঙ্গে জর্জ সাম্পাওলির সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর বড় প্রশ্ন ছিল— কে পাচ্ছেন সেমি-আগুয়েরোদের দায়িত্ব। সাম্পাওলির সময়ে তার সঙ্গে সহকারী ছিলেন লিওনেল স্কালোনি নামের এক তরুণ। লা লিগায় দেপোর্তিভো লা করুনায় খেলেছেন ২৫৮ ম্যাচ। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলেও ছিলেন ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা স্কোয়াডেও ছিলেন। তবে নাম ধরে চেনার মতো তারকা হয়ে উঠতে পারেননি। অবসর নেওয়ার পর কোচিংয়ে মনোযোগী হন। সেই সুবাদেই সাম্পাওলির সহকারীর দায়িত্ব ওঠে কাঁধে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাম্পাওলির অবসরের পর তাকেই দেওয়া হয় আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব! স্কালোনির বয়স তখন ৪০, যে বয়সে অনেকেই ফুটবল খেলাই চালিয়ে যান!

আরও পড়ুন-

জাতীয় দলে দায়িত্ব নিয়ে স্কালোনির শুরুটা নিয়ে সবারই ছিল সংশয়। ইউরোপের মাঠজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মুক্তোদানাগুলো তুলে আনতে থাকলেন খাঁটি জহুরির মতো। একজন একজন করে বাজিয়ে দেখলেন সবাইকে। সবাই বললেন, হায় হায়… এই কোচ চায় কী! কিন্তু নিজের পথ থেকে এতটুকু সরলেন না। বল পায়ে রেখে নান্দনিক ফুটবলা খেলা আর্জেন্টিনাকে শেখালেন নতুন কৌশল। আগের মতো তারকাভর্তি দল না পেলেন না। কিন্তু সেই অল্প সম্পদকেই কাজে লাগাতে লাগলেন নিজের কৌশলে। ছন্দময় ফুটবলের জন্য পরিচিত আর্জেন্টিনা দলকে বিশ্বাস করাতে লাগলেন, খেলায় জয়-পরাজয়ও অনেক বড় বিষয়।

স্কালোনির এমন কৌশলে ফলও আসছিল অল্প স্বল্প। কিন্তু এত অল্পে তো আর সন্তুষ্ট নয় ভক্তরা। তারা বললেন, এই কোচ আর্জেন্টিনাকে ডোবাবে। স্কালোনি তখনো চুপ। কোপার শুরু থেকেও একটা করে গোল দিয়েই খোলসবন্দি তার দল। কখনো জয়, কখনো ড্র— এভাবেই আর্জেন্টিনাকে ১৯ ম্যাচ রাখলেন অপরাজিত! আরও একবার ফাইনালে পৌঁছে গেল মেসিদের আর্জেন্টিনা। ভক্তরা বললেন, এবারও ফাইনালে হারবে। এই কোচের এই ট্যাক্টিসে হবে না!

কিন্তু দলের ওপর আস্থা হারাননি স্কালোনি, খেলোয়াড়রাও আস্থার প্রতিদান দিতে শুরু করলেন স্কালোনিকে। তার সহকারী হিসেবে ছিলেন একদিকে ছিলেন পাবলো আইমার, যিনি খোলোয়াড় হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেও প্রতিষ্ঠা না পাওয়া মধ্যমাঠের এক কুশলী কারিগর। তার সঙ্গে ছিলেন রবার্তো আয়ালা, গত দুই দশকে যিনি সম্ভবত আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগের সবচেয়ে বড় তারকা। এই টিম নিয়ে স্কালোনি একদিকে রক্ষণে গড়ে তুলছিলেন দুর্গ, অন্যদিকে মেসিকে ঘিরে মধ্যমাঠজুড়েও আক্রমণের কৌশলে শান দিচ্ছিলেন। দলের আস্থা অর্জন করে নেওয়া স্কালোনি তার ফলও পেলেন হাতেনাতে।

একযুগে কোপা আমেরিকার তিন ফাইনালে পরাজয়ের স্বাদ নেওয়ার পর চতুর্থ ফাইনাল। ভেন্যু ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়াম। প্রতিপক্ষ স্বাগতিক ব্রাজিল, যারা নিজেদের মাটিতে কোনো কোপার শিরোপা বঞ্চিত হয়নি! ব্রাজিলের সঙ্গে সবশেষ সাক্ষাৎগুলোর ফলও প্রতিকূলে। সবকিছুর বিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে মুন্সিয়ানা দেখানোর সুযোগটা পেয়ে ছাড়েননি স্কালোনি। শুরুতেই চমকে দিয়েছেন ম্যাচের একাদশে।

ফাইনালের এক ঘণ্টা আগেও দলের একাদশ নিয়ে চলতে থাকলো নানা গুজব। শেষমেষ যে স্কোয়াডের দেখা মিলল, তাতে অনেকেরই মনে হতে পারে— এতদিন ধরে এই কম্বো লুকিয়ে রেখেছিলেন লিওনেল স্কালোনি! হাঁটুর চোট কাটিয়ে ফেরা ক্রিস্টিয়ান রোমেরো আছেন একাদশে। দুই ফুলব্যাকেও এনেছেন বদল। জায়গা করে দিলেন গঞ্জালো মন্টিয়েল ও মার্কোস আকুনাকে। তবে সবচেয়ে বড় চমক— প্রথম একাদশেই আনহেল ডি মারিয়া, যিনি আগের ম্যাচগুলোতে ৬৫/৭০ মিনিটে নেমে টুর্নামেন্টের সুপার-সাবের খ্যাতি পেয়েছেন।

একাদশে চমক থাকলেও খেলা চললো স্কালোনির গতিতেই— শুরু থেকেই প্রতিপক্ষকে চেপে ধরার প্রচেষ্টা। ফল এলো তাতেও। সুপার-সাব ডি মারিয়া প্রথম একাদশে নেমেই ম্যাচের ২২ মিনিটে আদায় করে নিলেন এক দর্শনীয় গোল। এরপর সুযোগ এসেছিল আরও, কাজে লাগেনি। মেসি নিজেও শেষের দিকে শতভাগ নিশ্চিত গোল মিস করেছেন। ব্রাজিল আক্রমণ শানানোর চেষ্টা করলে আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগ ‘যেভাবেই হোক প্রতিহত করতে হবে’ নীতি নিয়ে লড়াই করেছে জানপ্রাণ দিয়ে। এরপরও যে দুয়েকটি সুযোগ নেইমাররা পেয়েছেন, আগের ম্যাচেই তিন পেনাল্টি ঠেকিয়ে নব্বইয়ের সার্জিও গয়াকোচিয়ার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা এমিলিয়ানো মার্টিনেজ ফের প্রচীর হয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত করেছেন ক্লিনশিট। অভিজ্ঞ ব্রাজিল ম্যানেজার তিতের কৌশলকে ব্যর্থ করে দিয়ে নিজের কৌশলে শিরোপা নিশ্চিত করেছেন স্কালোনি। শেষ বেলায় লিও মেসি, ডি মারিয়া ও আগুয়েরোদের হাতে উঠলো পরম আরাধ্য জাতীয় দলের জার্সিতে একটি মেজর ট্রফি। তরুণ লিওনেল স্কালোনিই রূপকথার নেপথ্যের নায়ক হয়ে বাজিমাত করলেন।

১৯৯৩ সালের কোপার পর থেকেই শিরোপা খরায় ভুগছে আর্জেন্টিনা। ড্যানিয়েল প্যাসারেলা, মারসেলো বিয়েলসা, হোসে পেকারম্যান, আলফিও বাসিলে তো বটেই, আর্জেন্টিনার ফুটবল কিংবদন্তী দিয়াগো ম্যারাডোনা পর্যন্ত দলের দায়িত্ব নিয়ে পারেননি। চেষ্টা করেছেন আরেক তারকা সার্জিও বাতিস্তাও। সবচেয়ে কাছাকাছি আলেহান্দ্রো সাবেলা দলকে বিশ্বকাপ ফাইনালে তুলেছিলেন। এরপর জেরার্ড টাটা মার্টিন, এদার্দো বাওজা এবং জর্জ সাম্পাওলির মতো প্রতিষ্ঠিত ম্যানেজাররাও ব্যর্থ হয়েছেন শিরোপা খরা কাটাতে। এত তারকার ভিড়ে মেসি-মারিয়া-আগুয়েরোর শেষ বয়সে লাটিনের সর্বোচ্চ আসর কোপা আমেরিকা দিয়ে সেই শিরোপার আক্ষেপ ঘুচালেন তরুণ তুর্কি স্কালোনি। এর আগ পর্যন্ত সংশয়-শঙ্কা থাকলেও ভক্তরা এবার নিশ্চয় বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন তার ওপর। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও সম্ভবত তার ওপরই ভরসা রাখতে যাচ্ছে। সামনের বছর যে বিশ্বমঞ্চের লড়াই, মেসি-মারিয়ার শেষ বিশ্বকাপ। কোপার ভেলকি সে পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবেন স্কালোনি?

সারাবাংলা/এএম/টিআর

আর্জেন্টিনা ফুটবল দল আর্জেন্টিনার ম্যানেজার কোপা আমেরিকা টপ নিউজ লিওনেল মেসি লিওনেল স্কালোনি শিরোপা খরা