Thursday 23 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনার ‘বিষে’ নীল ২০-এর ক্রিকেটবিশ্ব


৩১ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৩ | আপডেট: ১ জানুয়ারি ২০২১ ১০:৫৬

২০২০, বিশ বিশ। ক্রিকেটেও বছরটি হওয়ার কথা ছিল টোয়েন্টি-টোয়েন্টিময়। দুই দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপসহ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ দিয়ে ক্রিকেটীয় সূচী ছিল ঠাঁসা। কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাসের বিষে নীল হয়েছে ক্রিকেটীয় কতো আয়োজন। করোনার থাবায় ক্রিকেটের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল দীর্ঘ চার মাস। ২০২০ যাচ্ছে, ২০২১ আসবে। ২১’ও চলে যাবে, এভাবে বহু বছর আসবে-যাবে, কিন্তু ২০২০ এর মতো এতো দীর্ঘ কী মনে হবে কোনো বছরকে! বিষের ২০২০-এর শেষ সময়ে এসে চলুন ঘুরে আসি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের গত এক বছরে-

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ স্তব্ধ ক্রিকেট:

ঠাঁসা ক্রিকেটীয় সূচি নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২০। সময়ের সঙ্গে সূচী ঘন হচ্ছিল। ভারত, পাকিস্তান সফরের হতাশা ছাপিয়ে জিম্বাবুয়েকে ঘরের মাঠে নাস্তানাবুদ করল বাংলাদেশ। ওদিকে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলতে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে অনুশীলন শুরু করে দিয়েছিল ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ভারতে ওয়ানডে সিরিজ শুরু হয়ে গিয়েছিল বিরাট কোহলিদের। আর তাসমান সাগরের পাড়ে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল নিউজিল্যান্ড। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) নিয়ে আনাগুনা চলছিল, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) চলছিল। মহামারী করোনাভাইরাস সেই সময়ে হঠাৎ দপ করে নিভে দিল ক্রিকেটের সব বাতি।

১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আসে সেই মহামারীর ঘোষণা। এরপর ঘণ্টায় ঘণ্টায় আসতে থাকে একটার পর একটা সিরিজ স্থগিতের ঘোষণা। পিএসএল বন্ধ হয় মাঝপথে। মাঠ থেকে উঠে দেশে ফিরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটাররা। দ্রুত দেশে ফিরেন ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটাররাও।

স্থগিতের মিছিল:

২০২০ হওয়ার কথা ছিল ক্রিকেটের ব্যস্ততম বছর। কিন্তু করোনার থাবায় সেই মার্চে সিরিজ, টুর্নামেন্ট স্থগিতের যে ঢেউ শুরু হলো তা চলছে এখন অবদি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আলোচনা আসবে সবার আগে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে আইসিসি। স্থগিত বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে আগামী বছর ভারতে। পাশাপাশি এশিয়া কাপসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট গেছে করোনার পেটে। স্থগিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বহু সিরিজ।

বিজ্ঞাপন

আতঙ্ককালে ক্রিকেটীয় পরিবেশ:

এপ্রিল, মে, জুনে করোনাভাইরাস আতঙ্কিত করে রেখেছিল পুরো বিশ্বকেই। আতঙ্কে স্থবির ছিল ক্রিকেটের সব ধরনের কার্যক্রমও। লকডাউনের সময়ে ঘর থেকে বেরুনোর অবস্থা ছিল না। তবে ক্রিকেট বন্ধ থাকলেও ক্রিকেটাররা ফিটনেস নিয়ে কাজ করে গেছেন। বাড়ির বাড়ান্দায়, ড্রয়িংরুমে, গ্যারেজে ফিটনেস নিয়ে কাজ করতে দেখা গেছে অনেককে। এদিকে করোনার কঠিন সময়ে অসহায়দের কাঁধে সাহায্যের হাতও ছিল ক্রিকেটারদের। কেউ ক্রিকেটীয় স্মারক নিলামে তুলে অসহায়দের সহায়তা করেছেন, কেউ নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ প্রদান করেছেন, কেউ ফান্ড গঠন করে সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছেন। মাশরাফি বিন মুর্তজা, নাজমুল ইসলাম অপু, শহিদ আফ্রিদির মতো কয়েকজন তারকা ক্রিকেটাররা করোনা মোকাবিলায় কাজ করেছেন স্ব-শরীরে।

ভার্চূয়াল আড্ডায় মেতে থাকতেও দেখা গেছে ক্রিকেটারদের। করোনা আতঙ্কের কঠিন সময়ে সমর্থকদের একটু আনন্দ দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে ভার্চূয়ালী আড্ডায় যুক্ত হতে দেখা গেছে ক্রিকেটারদের। বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন, ডেভিড ওয়ার্নার, ফাফ ডু প্লেসি, রোহিত শর্মা, তামিম ইকবাল, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের মতো তারকা ক্রিকেটাররা নিয়মিত লাইভ আড্ডায় ভক্ত-সমর্থকদের ক্রিকেট বন্ধের সময়ে ক্রিকেটীয় আনন্দ দিয়েছেন।

চাপা আতঙ্কে ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তন:

একে একে স্থগিত হতে থাকল ভবিষ্যৎ সব সিরিজ, টুর্নামেন্ট। এই বড় ধাক্কা গিয়ে পড়ে ক্রিকেট অর্থনীতিতে। সংবাদমাধ্যমে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের বড় অর্থনৈতিক বিপদে পড়ার খবর প্রচার হচ্ছিল। এসব কাটিয়ে উঠতেই স্বাস্থবিধি মেনে করোনাকালে প্রথমে ক্রিকেট মাঠে ফেরানোর উদ্যোগ নেয় ক্রিকেটের জন্মদাতা দেশ ইংল্যান্ড। এগিয়ে আসে আইসিসিও। বলে থুতু লাগানোসহ বেশ কিছু ক্রিকেটীয় নিয়মে পরিবর্তন এনে ক্রিকেট প্রত্যাবর্তনের কাজটা সহজ করে দেয় আইসিসি। জুনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল করোনাকালের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। ইংল্যান্ডে সিরিজ খেলতে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু জৈব-সুরক্ষা বলয়ে সিরিজটি গড়ায় জুলাইয়ে।

১১৭ দিন পর ক্রিকেট ফেরার সময়ে আনন্দের চেয়ে আতঙ্কই বেশি ছিল। কোনো ক্রিকেটার আক্রান্ত হয়ে পড়বে না তো! আক্রান্ত হলে কী হবে, ইত্যাদি। তবে দিনে দিনে সেই আতঙ্ক কেটেছে। ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ এতটাই জমল যে করোনা আতঙ্ক চলে যায় একপাশে। পরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান ও অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড সফর করে ক্রিকেট ফেরার রাস্তা পাকা করেছে। সেই রাস্তায় চড়ে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ আর আফগানিস্তান বাদে সবাই কিছু না কিছু ম্যাচ খেলেছে। বিগ ব্যাশ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগ হয়েছে। পিএসএলের বাকি অংশ শেষ করা হয়েছে। শঙ্কা নিয়ে শুরু হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জাকজমক টুর্নামেন্ট আইপিএলও হয়েছে।

শঙ্কা শেষে সফল আইপিএল:

আইপিএলের শুরুতে বড় শঙ্কাই দেখা যাচ্ছিল। টুর্নামেন্ট খেলতে দলগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেতেই যে চেন্নাই সুপার কিংসের দশ সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়েও ফিরে এলেন চেন্নাইয়ের বড় তারকা সুরেশ রায়না। হরভজন সিংসহ বেশ কয়েকজন নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন আগেই। সব মিলিয়ে ভারতীয় বোর্ডের জোড়াজোড়ির পরও মনে হচ্ছিল, আইপিএল হবে তো!

তবে শঙ্কা কাটিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জাকজমক আসরটি বেশ জমে উঠেছিল। কারা খেলবে শেষ চারে সেটা নির্ধারণ হয়েছে প্রথম পর্বের শেষ ম্যাচে। দাপুটে শিরোপা জিতেছে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। মাঠের বাইরেও করোনাকালের আইপিএল ছিল বেশ আলোচিত।

ফের ক্রিকেট ব্যস্ততা, অস্ট্রেলিয়া-ভারত সিরিজ:

ক্রিকেট এখনো স্বাভাবিক নয়। দর্শকরা ‘নিষিদ্ধ’ই আছেন। বলে লালা লাগানোর অনুমতি পাননি বোলাররা। তবে ক্রিকেট সূচী কিন্তু বেশ জমে উঠেছে। কদিন পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্যান্য দেশগুলো ধীরে ধীরে ঠাঁসা সূচিতে ডুবে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি চলছে এই মুহূর্তে। সিরিজের প্রথম টেস্টে ৩৬ রানের লজ্জা পাওয়া ভারত ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় টেস্টে দারুণ জয় তুলে নিয়েছে। বিরাট কোহলি ছুটি নিয়ে দেশে ফিরলেও হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের উত্তেজনা চলছে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে।

অবসরে ধোনি, আমির, রায়নারা:

করোনার বছরে যে কয়েকজন ক্রিকেটার ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি তার অন্যতম। গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকেই ক্রিকেটের বাইরে ছিলেন। ধোনির কাছের জনরা বলছিলেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলে অবসরে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন ইতিহাসের অন্যতম সফল অধিনায়ক। কিন্তু বিশ্বকাপ পিছিয়ে গেল। অনেকটা নিভৃত্বেই ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিয়েছেন ভারতের সফলতম অধিনায়ক। বোর্ডের সঙ্গে অভিমান নিয়ে বছরের শেষভাগে এসে বিদায় নিয়েছেন পাকিস্তানের আলোচিত পেসার মোহাম্মদ আমির। বিদায় বলেছেন বিদায় নিয়েছেন ভারতের তারকা অলরাউন্ডার সুরেশ রায়না, অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়াটসন, ইংল্যান্ডের ইয়ান বেল, জিম্বাবুয়ের এলটন চিগুম্বুরা, পাকিস্তানের নারী তারকা ক্রিকেটার সানা মীর।

বিষের বছরে ক্রিকেট হারাল যাদের:

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক সফল ব্যাটসম্যান ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ডিন জোন্স আইপিএল চলাকালে হঠাৎ হার্ড অ্যাটাকে মারা যান। আইপিএলে একটি টিভির বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে সবাইকে কাঁদিয়েছেন জোন্স। বিষের বছরে না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের বিখ্যাত থ্রি ডব্ল’র একজন এভারটন উইকস, ইংল্যান্ডের সাবেক তারকা পেসার ও ধারাভাষ্যকার রবিন জ্যাকম্যান, ইংল্যান্ডে কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান জন এডরিচ, নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক জন রিড, ইংল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার ও বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের সাবেক কোচ ডেভিড ক্যাপেল, ভারতের সাবেক ওপেনার চেতন চৌহান, পাকিস্তানের অভিষেক টেস্ট দলের সদস্য ওয়াকার হাসান।

২০২০ সালে ছেলেদের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছে মাত্র ১৬১টি। তার মধ্যে টি-টোয়েন্টিই ৯৫টি। এমন বছর নিশ্চয় আর চাইবে না ক্রিকেট। নিপাদ যাক করোনা, ক্রিকেট চলুক স্বাভাবিকভাবে, দর্শক ফিরুক মাঠে, ক্রিকেট ফিরে পাক হারানো বিষয়গুলো। এই প্রত্যাশায় ২০২১ এর অপেক্ষা।

আইপিএল ২০২০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট করোনাভাইরাস টপ নিউজ তামিম ইকবাল মহেন্দ্র সিং ধোনি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর