রোড টু চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল: পিএসজি
২০ আগস্ট ২০২০ ১৫:০৮
নেইমার ২০১৭ সালে বিশ্বরেকর্ড পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই-পিএসজিতে নাম লেখানোর আগে থেকেই ঘরোয়া লিগ নিয়মিতই জিতে আসছিল। নেইমারকে দলে ভেড়ানোর প্রধান কারণ হিসেবে পিএসজির বরাবরই জানিয়েছে এসেছে ইউরোপিয়ান সাফল্যকে। আর ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্যের জন্যই নেইমারের জন্য ২২২ মিলিয়ন এবং কিলিয়ান এমবাপের জন্য ১৮০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে ফ্রেঞ্চ ক্লাবটি।
তবে ২০১৭/১৮ এবং ২০১৮/১৯ দুই মৌসুমেই কোয়ার্টার ফাইনালের আগে থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে পিএসজিকে। অবশ্য এর আগের মৌসুমেও পিএসজির দৌড় ওই শেষ ষোল পর্যন্ত। তবে ২০১৯/২০ মৌসুমে আটঘাট বেঁধেই নেমেছিল প্যারিসের ক্লাবটি। লক্ষ্য ছিল দৃঢ় আর স্থির! চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের! নিজেদের ইতিহাসে এর আগে কখনোই চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের টিকিট পায়নি তারা। আর শেষবার সেমিফাইনালও খেলেছিল ১৯৯৫ সালে। অর্থাৎ ২৫ বছর পর নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয় সেমিফাইনালে নাম লিখিয়েছে নেইমার-এমবাপেরা। ২৫ বছর আগে হতাশ হলেও এবার হতাশ হয়নি পিএসজি। এবারে জায়গা করে নিয়েছে স্বপ্নের ফাইনালে।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক পিএসজির ফাইনালের রোড:
গ্রুপ পর্বে পিএসজির সঙ্গী হিসেবে পায় রেকর্ড ১৩ বারের চ্যাম্পিয়ন রিয়াল মাদ্রিদকে। আর গ্রুপের বাকি দুই দল বেলজিয়ান চ্যাম্পিয়ন ক্লাব ব্রাগা এবং তুরস্কের গালাতাসারে। চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজাদের সঙ্গে এর আগের রেকর্ড ভালো ছিল না পিএসজির। তবে এবার ভঙ্গুর লস ব্ল্যাঙ্কোসদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চেপে ধরে পিএসজি। গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচের একটিতে হারিয়ে দিয়ে অপরটিতে ড্র করে পিএসজি। আর গালাতাসারে এবং ক্লাব ব্রাগার বিপক্ষে দুই ম্যাচের দুটিতেই জয় পায় প্যারিসের ক্লাবটি।
গ্রুপ পর্বের ম্যাচের ফলাফল:
ঘরের মাঠ পার্ক ডে প্রিন্সেসে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ এ’র প্রথম ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদকে আতিথ্য দেয় পিএসজি। আর প্রথম ম্যাচেই লস ব্ল্যাঙ্কোসদের ৩-০ গোলে হারিয়ে দেয়। এদিন রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক আর্জেন্টাইন উইঙ্গার অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া জোড়া গোল করেন আর বাকি একটি গোল করেন থমাস মুনিয়ের। পরের ম্যাচে গালাতাসারের মাঠে আতিথ্য নেয় পিএসজি। সে ম্যাচে মাউরো ইকার্দির করা একমাত্র গোলে জয় নিয়ে ফেরে প্যারিসের ক্লাবটি।
গত আসরে রেফারিদের নিয়ে সমালোচনা করে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হন নেইমার জুনিয়র। আর তাই তো এবারের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বের প্রথম তিন ম্যাচ খেলতে পারেননি এই তারকা। এদিকে ক্লাব ব্রাগার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের তৃতীয় ম্যাচে গোলোৎসব করে পিএসজি। ডি মারিয়ার চার অ্যাসিস্ট, কিলিয়ান এমবাপের হ্যাটট্রিক আর ইকার্দির জোড়া গোলে ব্রাগাকে ৫-০ গোলে উড়িয়ে দেয় পিএসজি। এরপর ব্রাগার বিপক্ষে ফিরতি লেগে ইকার্দির এক গোলে জয় পায় লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়নরা।
তবে এই সময়ের মধ্যে নিজেদের ফিরে পেতে শুরু করে রিয়াল মাদ্রিদ। আর গ্রুপ পর্বের প্রথম চার ম্যাচে এক গোলও হজম না করা পিএসজি রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে করিম বেঞ্জেমার জোড়া গোলে ম্যাচের ৮১ মিনিট পর্যন্ত ২-০তে এগিয়ে থাকে। তবে শেষ দিকে এসে খেই হারিয়ে ফেলে স্প্যানিশ চ্যাম্পিয়নরা। ম্যাচের ৮১ মিনিটে কিলিয়ান এমবাপে এবং ৮৩ মিনিটে সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ খেলোয়াড় পাবলো সারাবিয়ার গোলে সমতায় ফেরে পিএসজি। আর শেষ পর্যন্ত ড্র করেই ফেরে তারা।
রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ড্র’য়ের শোধটাই যেন গালাতাসারের বিপক্ষে তুলেছিল পিএসজি। তুরস্কের ক্লাবটির জালে গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ ম্যাচে পাঁচবার বল পাঠিয়েছিল। ঘরের মাঠে ইকার্দি, সারাবিয়া, নেইমার, এমবাপে এবং এডিনসন কাভানির গোলে ৫-০ ব্যবধানে জয় নিয়ে গ্রুপ পর্বের চ্যাম্পিয়ন হয়ে শেষ ষোলয় নাম লেখায় পিএসজি।
রাউন্ড অব ১৬:
গ্রুপ পর্বের ৬ ম্যাচের মধ্যে ৫টি জয় আর একটি ড্র’র পর দুর্দান্ত ফর্ম নিয়েই শেষ ষোলয় উঠে আসে পিএসজি। আর শেষ ষোলর ড্র’তে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে খেলা পড়ে তাদের। তবে এই ম্যাচের আগেই যেন একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে পিএসজি। আর তার খেসারত দিতে হয়ে সিগন্যাল ইদুনা পার্কে এর্লিং হালান্ডের জোড়া গোলের পর নেইমারের এক গোল করলেও ২-১ ব্যবধানে হারতে হয়ে প্রথম লেগে। তবে পিএসজি আশা ছিল দ্বিতীয় লেগে ঘরের মাঠে ১-০ গোলের ব্যবধানের জয়ও তাদের নিয়ে যাবে কোয়ার্টারে।
আর দ্বিতীয় লেগে নেইমার জুনিয়রের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ভর করেই কোয়ার্টারে নাম লেখায় পিএসজি। এদিন একটি গোল করেন নেইমার আর বাকি এক গোল করেন পাবলো সারাবিয়া। ঘরের মাঠে ২-০ গোলের জয়ে নিশ্চিত হয় কোয়ার্টার।
আর পিএসজির কোয়ার্টার নিশ্চিত হওয়ার পরেই ইউরোপ জুড়ে করোনা মহামারি নেমে আসে। স্থগিত হয়ে যায় সব ধরনের ফুটবল। আর ওদিকে গুঞ্জন রটে বাতিল হয়ে যেতে পারে চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের আসর। তবে অবশেষে জুনে এসে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলে মাঠে গড়ায় ইউরোপিয়ান ফুটবল। আর তখনই হয়ত হাফ ছেড়ে বাঁচে পিএসজি। ইউরোপিয়ান ঘরোয়া ফুটবলের আসর শেষ হওয়ার পর আগস্টে এসে মাঠে গড়ায় চ্যাম্পিয়নস লিগের ২০১৯/২০ মৌসুমের বাকি থাকা খেলা। কোয়ার্টারের কিছু ম্যাচ এবং টুর্নামেন্টের বাকি থাকা কোয়ার্টার, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল সরিয়ে নেওয়া হয় একটি শহরে। আর সেই শহর হিসেবে নির্বাচিত করা হয় পর্তুগালের লিসবনকে। সেই সঙ্গে আসে কিছু পরিবর্তনও। কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনাল সাধারণ নিয়মে অনুষ্ঠিত না হয়ে হবে মাত্র একটি লেগে। অর্থাৎ এক ম্যাচই ভাগ্য নির্ধারণ করবে ক্লাবগুলোর।
কোয়ার্টার ফাইনাল:
কোয়ার্টার ফাইনালে পিএসজির ভাগ্যে জোটে ইতালিয়ান সিরি আ’তে দুর্দান্ত মৌসুম কাটানো আটালান্টা। সদ্য সমাপ্ত হওয়া সিরি আ’র মৌসুমে রেকর্ড ৯৫ গোল করা আটালান্টার বিপক্ষে খেলার আগে বেশ চিন্তিতই ছিল পিএসজি। আর খাতা কলমের বিচারে এগিয়ে থাকা পিএসজিকে ধরাশায়ী করেও ফেলেছিল আটালান্টা। রুপকথা গড়তে আটালান্টা ম্যাচের ৯০ মিনিট পর্যন্ত ১-০ গোলেই এগিয়ে ছিল। কিন্তু এদিন নেইমার জুনিয়র একাই ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলেছিল আটালান্টার রক্ষণ। আর কিলিয়ান এমবাপে ইনজুরির কারণে প্রথমার্ধে না খেললেও দ্বিতীয়ার্ধে নামার পরে ম্যাচের আক্রমণ আরও বাড়ে পিএসজির। তবে প্রথমার্ধে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়া পিএসজি কিছুইতেই ভাঙতে পারছিল না আটালান্টার ডিফেন্স।
অবশেষে ম্যাচের ৯০তম মিনিটে নেইমারের অ্যাসিস্ট থেকে পিএসজিকে সমতায় ফেরান আরেক ব্রাজিলিয়ান মার্কুইনেস। সকলে যখন অপেক্ষা করছিল অতিরিক্ত সময়ের খেলা দেখার জন্য। আর সেই আশায় গুড়ে বালি দিলে চুপো মোটিং। কিলিয়ান এমবাপের অ্যাসিস্ট থেকে ম্যাচের ৯৩তম মিনিটে চুপো মোটিং গোল করে আটালান্টার স্বপ্ন ভঙ্গ করে। আর ২৫ বছর পর পিএসজিকে নিয়ে যান চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে।
সেমিফাইনাল:
সেমিফাইনালে পিএসজির সামনে রেডবুল লেইপজিগ। ২০০৯ সালে ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ১১ বছর পরেই উঠে আসে নিজেদের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে। তবে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা পিএসজির সামনে যেন পাত্তায় পেল না জার্মান ক্লাবটি। এ ম্যাচে ডি মারিয়ার আগুন ঝরা পারফরম্যান্সের সঙ্গী ছিলেন নেইমার জুনিয়রও। পিএসজির করা তিন গোলের সবক’টিতেই অবদান মারিয়ার। যেখানে দুটি গোল সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আর নিজে করেছেন একটি। ৩-০ গোলের জয়ের রাতে গোল করেছেন মার্কুইনেস, ডি মারিয়া এবং নেইমার জুনিয়র।
আর জার্মান ক্লাবটিকে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো উঠে আসে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে। আর অপেক্ষা কেবল একটি ম্যাচের। ইতিহাস গড়তে পিএসজির প্রয়োজন আর একটি জয়। তবে সামনে যে জার্মান জায়ান্ট বায়ার্ন মিউনিখ। গোল করার সময় যারা প্রতিপক্ষের দিকে করুনার দৃষ্টিও দেয়না। তাই তো ২৪ আগস্টের ফাইনাল যে জমজমাট হবে তা নিয়ে কোনো সংশয়ের অস্তিত্ব নেই। বায়ার্ন মিউনিখের ষষ্ঠ অথবা পিএসজির প্রথম!
উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ টপ নিউজ পিএসজি পিএসজি বনাম বায়ার্ন মিউনিখ প্যারিস সেইন্ট জার্মেই ফাইনাল রোড টু ফাইনাল স্পোর্টস স্পেশাল