Thursday 23 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিষেধাজ্ঞা, জরিমানা, পয়েন্ট হারানো— কী আছে ম্যান সিটির ভাগ্যে?


১১ জুলাই ২০২০ ১৫:১৬

আর্থিক স্বচ্ছতার ধারা (ফাইন্যান্সিয়াল ফেয়ার প্লে, এফএফপি) ভঙ্গ ও ইউরোপিয়ান লিগের (উয়েফা) গর্ভনিং বডির প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনের অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। তারই জের ধরে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুই বছরের জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে নিষিদ্ধ করা হয় ম্যানচেস্টার সিটিকে। শুধু তাই নয়, ৩০ মিলিয়ন ইউরো জরিমানাও করা হয় এই ক্লাবকে।

এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে উয়েফার বক্তব্য— ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ম্যানচেস্টার সিটি উয়েফার আর্থিক স্বচ্ছতার ধারা ভেঙেছে। তারা ক্লাবের আয়ের ঠিকঠাক হিসেব দেয়নি। তবে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে উয়েফার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা অনুসন্ধান শুরুর আগেই সিটিজেনদের ‘দোষী’ বলে উল্লেখ করেন এবং জানান, এর জন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে। তবে তদন্ত শুরুর আগেই তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্যের জের ধরে সিটিজেনরা বলছেন, সঠিক তদন্ত ছাড়াই পূর্বপরিকল্পনা থেকে তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

উয়েফার যে আর্থিক নীতি মূলত ফিনান্সিয়্যাল ফেয়ার প্লে বা এফএফপি নামে পরিচিত। ২০১১ সাল থেকে এই নীতি চালু হয়েছে। দলবদলের বাজারে কোনো দল যেন অসদুপায়ে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে না পারে ,সেটা দেখভাল করাই এ নীতির উদ্দেশ্য। এবং একইসঙ্গে ক্লাবের বিজ্ঞাপনদাতাদের অর্থ সঠিকভাবে হিসাব করে দেখানো হচ্ছে কি না,  তা নিয়েও কাজ করে এফএফপি।দুই বছরের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবেই আপিল করে ম্যানচেস্টার সিটি। উয়েফার কাছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি জরিমানা গুনতে হলে আন্তর্জাতিক খেলাধুলাভিত্তিক সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয় সিটিজেনরা। নিজেদের নির্দোষ দাবি করে উয়েফাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। পাঁচ মাস পর সেই আপিলের রায়ের সময় হয়েছে। আগামি ১৩ জুলাই জানা যাবে, ম্যান সিটির ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ জয় পাবে কি না।

বিজ্ঞাপন

আপিলের শুনানি যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে উদ্বেগ। তবে এ নিয়ে চিন্তিত নন ম্যানচেস্টার সিটির স্প্যানিশ কোচ পেপ গার্দিওলা। তিনি মনে করছেন তার ক্লাব সম্পূর্ণ নির্দোষ। তিন এ-ও মনে করেন, তার দল আগামী মৌসুমে অবশ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলবে।

গার্দিওলা বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত। আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী এবং আমি বিশ্বাস করি যে আমরা অবশ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলব। কারণ আমরা মাঠে থাকতে চাই আরও অনেক বছর। আমি জানি আগামি ১৩ জুলাই আমরা সব জানতে পারব। কিন্তু তারপরেও আমি আশা করি— ক্লাব, ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত কর্মী ও খেলোয়াড়সহ সকল কোচিং স্টাফদের জন্য মঙ্গলকর রায়ই আসবে।’

ম্যান সিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ছিল?

এফএফপি (ফাইনান্সিয়াল ফেয়ার প্লে) ভঙ্গ করে ম্যানচেস্টার সিটির মালিক শেখ মনসুর বিন নাহিয়ান বিজ্ঞাপনদাতাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ বেশি দেখান। অর্থাৎ নিজের ব্যক্তিগত খাত থেকে অর্থ এনে হিসেবে দেখান— বিজ্ঞাপন থেকে অর্থ আসছে। এফএফপি অনুযায়ী, এটি একটি গুরুতর অপরাধ। আর সে কারণেই উয়েফা ম্যান সিটির মতো দাপুটে দলটির জন্যও দুই বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পেরেছে।

আপিলের রায়ের পরিণতি কী?

উয়েফার এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপিলে যদি সিটিজেনরা হেরে যায়, তবে উয়েফার আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানা বহাল থাকবে। অর্থাৎ দুই বছরের জন্য ইউরোপের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়বে সিটি। আর জরিমানা তো আছেই।

অন্যদিকে যদি সিটি এই আাপিলে জিতেও যায়, তবুও কিছু না কিছু ফল ভোগ করতে হবে তাদের। কারণ সিটির বিরুদ্ধে কেবল এফএফপি ভঙ্গের অভিযোগই নয়, উয়েফার অনুসন্ধানে সহায়তা না করার অভিযোগও রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপিলে জিতলেও অনুসন্ধানে উয়েফাকে পূর্ণ সহযোগিতা না করার দায়ে হয়তো জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে তাদের।

ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে প্রিমিয়ার লিগও

উয়েফার বিরুদ্ধে আপিলে ম্যান সিটি জিততে না পারলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে মাথা ঘামাতে হবে প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষকেও। কেননা ম্যানচেস্টার উয়েফার কাছে যে হিসাব দাখিল করেছে, সেই একই হিসেব দাখিল করেছে প্রিমিয়ার লিগেও। অর্থাৎ উয়েফা’র হিসাবে এফএফপি ভঙ্গ প্রমাণিত হলে সেটার প্রভাব পড়বে প্রিমিয়ার লিগেও। প্রিমিয়ার লিগের ই-৪(২) ধারা বলে ক্লাবকে অবশ্যই তাদের হিসেব সঠিকভাবে দাখিল করতে হবে। অন্যথায় ডাব্লিউ-৩ ধারা অনুযায়ী প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবের বিরুদ্ধে তিন ধরনের শাস্তি আরোপ করতে পারে—

  • ক্লাবকে এফএ’র কাছে যাওয়ার নির্দেশনা দিতে পারে;
  • সিটির জন্য কমিশন গঠন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে;
  • সিটির দ্রুত বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ব্যবস্থার কমিশন গঠন করতে পারে।

প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষ দ্রুত বিচার ব্যবস্থার কমিশন গঠন করলে আশার আলো খুঁজে পেতে পারে সিটি। কেননা এক্ষেত্রে বোর্ডের মাধ্যমে এ ধরনের ‘কেস’ সমাধান করে দ্রুত বিচার কমিশন। আর এই বোর্ড যেকোনো ক্লাবকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা করতে পারে। তাই এই বোর্ডের ক্ষমতা ওই ২৫ হাজার ইউরো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

তবে এক্ষেত্রে লিগ কর্তৃপক্ষ কমিশন গঠন করে সিটির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের নির্দেশনা দিলে সেটি নিয়ে ম্যান সিটিতে শঙ্কিত হতে হবে। কারণ এই কমিশন এফএফপি’র ধারা ভঙ্গের প্রমাণ পেলে সিটিকে (সিনিয়র ও যুব দল) প্রিমিয়ার লিগের ডাব্লিউ (৪৯.৪.১) ধারায় লিগ ম্যাচ খেলা অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাখে।

প্রিমিয়ার লিগে সিটির পয়েন্ট কেটে নেওয়ার ক্ষমতাও রাখেই এই কমিশন। ডাব্লিউ (৪৯.৪.২) ধারা অনুযায়ী সেটা হতে পারে চলতি মৌসুমের জন্য, কিংবা ভবিষ্যতের মৌসুমের জন্যও। এই কমিশনের ক্ষমতা আছে সিটিকে পুরো প্রিমিয়ার লিগ থেকে নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দেওয়ারও। প্রিমিয়ার লিগের ডাব্লিউ (৪৯.৪.৪) ধারা অনুযায়ী কমিশন এই পরামর্শও দিতে পারে।

এদিকে বি (৭. ৩/৪) ধারা অনুযায়ী এমন পরিস্থিতিতে লিগের অন্যান্য ক্লাবকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয় যে দোষী ক্লাবটিকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না। অর্থাৎ ম্যানচেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তখন নির্ভর করবে অন্যান্য ক্লাবের ওপরেও।

বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, নিষেধাজ্ঞার মতো এত বড় এবং কঠিন সিদ্ধান্ত নেবে না প্রিমিয়ার লিগ। এর পরিবর্তে সিটিকে আর্থিক জরিমানা করা হতে পারে, সেই সঙ্গে কেটে নেওয়া হতে পারে পয়েন্ট। এ ক্ষেত্রে সিটির জন্য উদাহরণ হিসেবে দাঁড়াতে পারে ইংল্যান্ডে রাগবি ক্লাব সারান্সে। একই ধরনের অপরাধে এই ক্লাবটিকে ৫ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা এবং ৭০ পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু যদি প্রিমিয়ার লিগের কমিশন সিদ্ধান্ত নেয় যে সিটির লিগ শিরোপা কেড়ে নেওয়া হবে, তবে ২০১১/১২ ও ২০১৩/১৪ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা হারাতে হবে সিটিকে। সেক্ষেত্রে অবশ্য কপাল খুলতে পারে লিভারপুল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। কারণ এই দুই দলের মধ্যে ২০১১/১২ মৌসুমে লিভারপুল ও ২০১৩/১৪ মৌসুমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দ্বিতীয় স্থানে থেকে লিগ শেষ করেছিল। আবার নিয়ম এ-ও বলছে, ম্যান সিটির শিরোপা কেড়ে নিতে গিয়ে অন্য কাউকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা দিতেই হবে— এমন বাধ্যবাধকতাও নেই।

সবকিছু মিলিয়ে ইউরোপিয়ান ফুটবল বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ম্যানচেস্টার সিটির শাস্তিতে হয়তো কিছুটা শিথিলতাও আসতে পারে। তেমন হলে নিষেধাজ্ঞা দুই বছর থেকে একবছরে নেমে আসতে পারে। সেই সঙ্গে জরিমানাও কিছুটা কমানো হতে পারে বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।

শাস্তি হিসেবে পয়েন্ট কাটা গেলে ম্যান সিটিকে বেশকিছু সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে। পয়েন্ট জরিমানা বেশি হলে চলতি মৌসুমে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে নেমে আসতে হতে পারে ম্যান সিটিকে। এমনকি আগামী মৌসুমও ‘মাইনাস’ পয়েন্ট থেকেও শুরু করতে হতে পারে তাদের। আর এ মৌসুমের ওপর দিয়ে গেলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলার সুযোগ হারাবে। ইউরোপিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে খেলতে না পারলে ক্লাবের তারকা ফুটবলারদের কেউ কেউ ক্লাব ছাড়তে পারেন। আর্থিক ‘গণ্ডগোলে’র বিষয় যেহেতু, ভবিষ্যতে অন্য তারকাদের জন্যও এই ক্লাবটি বেছে নেওয়াটা কঠিন হতে পারে। বিজ্ঞাপনদাতারাও সিটির ওপর থেকে আস্থা হারাবে এবং বড় ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন অর্থের প্রস্তাব নিয়ে আসার আগেও দ্বিতীয়বার ভাববে তারা।

সিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হবে না— এমন সম্ভাবনা খুবই কম। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া হলে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতে পারে উয়েফাকেও। কেননা এফএফপি’র নিয়ম ভঙ্গ করে যদি পার পাওয়া যায়, তবে বিশ্বের অন্যান্য ধনী ক্লাবগুলোও তাদের ধনী মালিকের অর্থ ক্লাবের অর্থের সঙ্গে মিলিয়ে একটি অব্যবস্থাপনা তৈরি করবে। আর সেক্ষেত্রে এফএফপি’র কোনো গুরুত্বই আর থাকবে না।

মুদ্রার অপর পিঠ হতে পারে ম্যানচেস্টার সিটি সম্পূর্ণ নির্দোষ হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে এবং তাদের ওপর থেকে দুই বছরের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নিষেধাজ্ঞা উঠে যেতে পারে। আর সেই সঙ্গে জরিমানা করা ৩০ মিলিয়ন ইউরোও মওকুফ হয়ে যেতে পারে। ম্যান সিটির ম্যানেজার থেকে শুরু করে ফুটবলার, কর্মকতা-কমর্চারীরা নিশ্চয় চাইছেন, এমন কিছুই ঘটুক।

এতসব সম্ভাবনা-আশঙ্কার মধ্যে শেষ পর্যন্ত ম্যান সিটির ভাগ্যে কী জুটবে— তা জানার জন্য আরও তিনটি দিন অপেক্ষা করতেই হবে সবাইকে।

ইউনিয়ন অব ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন উয়েফা উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ টপ নিউজ দুই বছরের নিষধাজ্ঞা এবং জরিমানা নিষেধাজ্ঞা ম্যানচেস্টার সিটি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর