ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৌশলগত শক্তি বৃদ্ধির সময় এসেছে
২৯ মার্চ ২০২৫ ১৭:২২
বাংলাদেশ ৫৩ বছর ধরে বিভিন্ন দেশের আধিপত্যের হুমকিতে রয়েছে। পূর্ববর্তী কিছু সরকার এই আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবেশি দেশের বাধার কারণে তা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। কিছু সরকার তাদের ক্ষমতার রাজনীতির জন্য উল্টো কর্মকাণ্ডও করেছে, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। গণমানুষও অভ্যন্তরীণ আধিপত্যের কারণে দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী হওয়ার জায়গা খুঁজে পায়নি। কিন্তু পাঁচ কোটি যুবক এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী ও আধিপত্য-বিরোধী হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল, যা ৫ আগস্ট ২০২৪ এ পরিপক্ক হয়েছে। প্রফেসর ইউনুস সরকার ‘স্বপ্নের বাংলাদেশ’ গড়ে তুলতে দায়িত্বে এসেছে এবং আমাদের মাতৃভূমি এই পথে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, এবং নতুন বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা ‘স্বপ্নের বাংলাদেশ’ যাত্রার উপাদান হিসেবে কাজ করছে। আশা করি, প্রফেসর ইউনূসের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে পাঁচ কোটি জাতীয়তাবাদী যুবক ব্যাপক সংস্কারের নতুন পথ খুঁজে পাবে।
চট্টোগ্রামের মিরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজীতে প্রস্তাবিত ‘ইন্ডিয়ান স্পেশাল ইকোনমিক জোন (আইএসইজেড)’ স্থাপিত হচ্ছে এক হাজার একর জমির উপর। ২০১৯ সালে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং ভারতের সেভেন সিস্টার স্টেটস এবং অন্যত্র রপ্তানির জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। ফেনী নদী ও বঙ্গোপসাগরের তীরে প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে।২০২৩ সালের আগস্টে দুটি ভারতীয় কোম্পানি, আদানি পোর্টস এবং স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড এবং ইন্টারন্যাশনাল সীপোর্ট ড্রেজিং প্রাইভেট লিমিটেড দরপত্র ক্রয় করে। উভয় কোম্পানি টেন্ডার কেনা সত্ত্বেও, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারির সময়সীমার মধ্যেও দরপত্রের কাগজপত্র জমা দিতে অস্বীকার করে। তারা এখন পর্যন্ত কাগজপত্র জমা দেয়নি।এতে কাজ বিলম্বিত হচ্ছে। আমি মনে করি, এটি তাদের উদ্দেশ্যমূলক বিলম্ব এবং তারা ফেনীর মুরগির ঘাড়ের মতো কৌশলগত এলাকা নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। চট্টগ্রাম ফেনী নদী দ্বারা পৃথক হয়েছে এবং ফেনী নদী একটি মুরগির গলার মতো কাজ করে; ভারতীয় সীমান্তে এর যথেষ্ট কৌশলগত এবং ভৌগোলিক প্রভাব রয়েছে।ভারত ফেনী নদীর উপর নির্মিত সেতু ধ্বংস করলে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড চট্টগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে । অনেক মিডিয়া থেকে জানতে পেরেছি যে, ফেনী নদী (চিকেন নেক) নিয়ে ভারতের একটি অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে যাতে তারা চট্টগ্রামকে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা করে অঞ্চলটি দখল করতে পারে। সরকারের উচিত অবিলম্বে ভারতের সঙ্গে আইএসইজেড চুক্তি বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া এবং নতুন করে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা।
ফেনীতে, বিশেষ করে বিলোনিয়া সীমান্তে একটি নতুন সেনানিবাস স্থাপন করা সময়ের দাবি। তাছাড়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ২১টি সামরিক ক্যাম্প খুব দ্রুত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই ২১টি সামরিক ক্যাম্প দেশের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক নিরাপত্তা সংকট যা ভারত এবং মায়ানমার থেকে উদ্ভূত হতে পারে তা মোকাবেলা করবে। সিলেট, লালমনিরহাট, যশোর, ময়মনসিংহ, এবং খুলনায় অবস্থিত সেনানিবাসগুলির শক্তি অবিলম্বে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা উচিত। এ ছাড়া মৌলভীবাজার, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, এবং চুয়াডাঙ্গায় আধুনিক প্রতিরক্ষা সুবিধাসহ নতুন সেনানিবাস নির্মাণ করা উচিত, যা ভারতীয় সীমান্ত হুমকিকে সহজতর করবে। এই জেলাগুলির সাথে ভারতের ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে। এমনকি, বাংলাদেশের সব সেনানিবাসে সামরিক সদস্য বৃদ্ধির কথা জরুরীভাবে ভাবা উচিত।
লালমনিরহাটে একটি পরিত্যক্ত বিমান বাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে, যা ছিল এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাঁটি। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ঘাঁটিটির আয়তন প্রায় ১,১৬৬ একর। ব্রিটিশ সরকার নেপাল, ভুটান এবং ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সাথে যোগাযোগ প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য ১৯৩১ সালে বেসটি প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, এটি পরিত্যক্ত হয়েছিল, যদিও, ১৯৭২ সালে, তৎকালীন সরকার পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল; কিন্তু ভারতের বাধার কারণে তা ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও ঘাঁটিটি পুনঃপ্রবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার মৃত্যুর কারণে এটি আর অগ্রসর হয়নি। লালমনিরহাট বিমান ঘাঁটি থেকে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর (চিকেন নেক) মাত্র বারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অধ্যাপক ইউনূসের সরকার প্রায় ৫৩ বছর ধরে ভারতীয় আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তার সরকার ইতিমধ্যেই ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে বেশ কিছু নীতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যা সফলও হতে চলেছে।
এ পর্যায়ে, লালমনিরহাট ঘাঁটিটি পূর্ণাঙ্গভাবে পুনরায় চালু করার জোর দাবি উঠেছে। আমরা শুনছি যে, অধ্যাপক ইউনূসের সরকার অবিলম্বে এটিকে আধুনিক প্রতিরক্ষা সুবিধাসহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। এই উদ্যোগ ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে একধাপ এগিয়ে রাখবে। ভারত ব্যাকফুটে যাবে এবং বাংলাদেশের প্রতি আগ্রাসনের আগে তাকে একবার বিবেচনা করতে হবে।এ ক্ষেত্রে আমরা চীনের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা নিতে পারি। কাতার সরকারও এই প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে বলে জানা গেছে। বেসটিতে মহাকাশ গবেষণার জন্য একটি একাডেমি, একটি প্রশিক্ষণ স্কুল এবং একটি নিয়মিত বিমানবন্দর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আশা করছি, এই সরকার কৌশলগত প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করবে, যদিও ভারত ইতিমধ্যেই প্রকল্পে বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ-ভারত বিরোধের প্রেক্ষাপটে চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সামরিক চুক্তি করা প্রয়োজন। যেমন, বাংলাদেশ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করতে পারে। কোনো দেশকে অন্য কোনো দেশ আক্রমণ করলে জোটের সমর্থনে অন্যজন সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেবে, এটাই হবে চুক্তির লক্ষ্য। বাংলাদেশের উচিত অবিলম্বে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক রসদ ও অস্ত্র উৎপাদনের চুক্তি করা। প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা ছোট ও মাঝারি আকারের অস্ত্র ও সামরিক রসদ উৎপাদনে যেতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, রাইফেল, পিস্তল, রিভলভার, গুলি, শর্টগান, পাইপগান এবং হালকা মেশিনগান। এছাড়া সামরিক যান, ট্রাক, ট্যাংক বহনকারী যানবাহন। এসব পণ্য উৎপাদনের জন্য পাকিস্তান ও চীন উপযুক্ত দেশ। তারা এই বিষয়ে আমাদের প্রযুক্তি, বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করতে পারে। এই দেশগুলি থেকে বড় আকারের সামরিক অস্ত্র এবং রসদ কিনতে হবে, কারণ সেগুলি সাশ্রয়ী। সম্প্রতি আমাদের সরকার জাপানের সঙ্গে অস্ত্র ক্রয় চুক্তি করতে যাচ্ছে, যা একটি ভালো লক্ষণ। আমরা বেসামরিক ব্যবহারের জন্য পাকিস্তানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি করতে পারি যা আমাদের জাতিকে শক্তিশালী করবে। তুরস্ক ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহী। দেশটি আমাদেরকে উন্নত ড্রোন সরবরাহ করবে এবং তাদের ড্রোন প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে।বাংলাদেশ-চীন সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে; এই চুক্তিগুলি সামরিক প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক সহায়তা, এবং সামরিক শিক্ষার জন্য একটি নতুন ভাষা পরীক্ষাগারসহ অবকাঠামো উন্নয়নের উপর ফোকাস করে। বাংলাদেশ তার সশস্ত্র বাহিনীকে শক্তিশালী করার সাথে সাথে চীনের সাথে এই অংশীদারিত্ব গভীর কৌশলগত সহযোগিতার ইঙ্গিত দেয়।
সরকারের উচিত আঠারো বছর বা তার বেশি বয়সী সকল লোককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া। অস্ত্রসহ তাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি দুই থেকে তিন মাস হতে পারে। তারা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি সমাপ্তির পর একটি প্রশংসাপত্র অর্জন করবে এবং প্রশিক্ষণের সময় তারা একটি টোকেন মানি পাবেন। প্রশিক্ষিত লোকদের রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে রাখা হবে। আমাদের দেশ অন্য দেশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে তাদের ডাকা হবে সরাসরি যুদ্ধের জন্য। প্রয়োজনে সরকার দেশে সংকটের মুহূর্তে যে কোন সময়ে যে কোন জায়গায় তাদের মোতায়েন করতে পারে।এছাড়া বিএনসিসি, আনসার ও ভিডিপিকে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যা স্থানীয় এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক শক্তি হিসেবে কাজ করবে। প্রশিক্ষিত বাহিনী হবে দক্ষ ও পেশাদার, যা তাদের ব্যক্তিগত অগ্রগতিকেও সহজতর করবে। সকল চীনা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে এক মাসের জন্য সকল নবীন স্নাতক ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। যারা নতুন স্নাতক প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছে তাদের জন্য এটি কঠোর এবং বাধ্যতামূলক একটি প্রোগ্রাম। আমাদের জাতিকে সামরিক রসদ এবং প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক জনশক্তি দিয়ে সজ্জিত করতে হবে, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এটা অনিবার্য।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এএসজি