Sunday 12 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাপ ও ঘোড়া নিয়ে গবেষণা — বাঁচবে মূল্যবান জীবন

প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন
১২ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:২৯

সাপ শব্দটি শুনলে অনেকেই আঁতকে ওঠেন। সাপ বলতেই যেন কোনো ভয়ঙ্কর বিষাক্ত একটি প্রাণীর চেহারা আমাদের চোখে ভাসে। বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী সাপ Chordata পর্বের Vertebrata উপ পর্বের Reptilia শ্রেণীর সদস্য। সাপের সর্বমোট ১৫টি পরিবার, ৪৫৬টি গণ এবং ২৯০০টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সকল মহাদেশেই কম-বেশি সাপের উপস্থিতি দেখা যায়। Hydrophis নামের সামুদ্রিক সাপ সমুদ্রের ৮০৩ ফুট গভীরতায় সাঁতার কাটতে পারে আবার হিমালয়ান পিট ভাইপার পর্বতের ১৬ হাজার ফুট উচ্চতায়ও বাস করতে পারে। বিভিন্ন আকৃতির সাপ রয়েছে তবে সবচেয়ে ছোট আকৃতির সাপ হলো বারবাডোজ থ্রেড স্নেক যার দৈর্ঘ্য ৪.১ ইঞ্চি এবং ওজন ০.৬ গ্রাম এবং সবচেয়ে বড় আকৃতির সাপ হলো এক ধরণের মালয়ান পাইথন যার দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট এবং ওজন ১৫৯ কেজি। সাপের অসংখ্য প্রজাতির মধ্যে অল্প কয়েক প্রজাতির সাপ বিষধর। ড: আলী রেজা খান তার বই ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রানী’তে উল্ল্যেখ করেছেন যে বাংলাদেশে ৭৯ প্রজাতির সাপের মধ্যে ৫২টি বিষহীন আর ২৭টি বিষধর প্রজাতির সাপ। জীব চক্রে সাপ কখনও নিজে শিকারি অথবা কখনও অন্যের শিকার উভয়ই হতে পারে। কারণ সাপ যেমন অন্য প্রাণী খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে তেমনি সাপও অন্য প্রাণীর খাদ্য হয়ে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে।

বিজ্ঞাপন

সাপ পরিবেশের বন্ধু হলেও সাপের সাথে মানুষের সম্পর্ক গভীর বন্ধুত্বের নয়। সাপের কামড়ের বিষে শুধু মানুষ নয় অনেক গবাদি পশুরও প্রানহানি ঘটে। সাপের বিষ হল প্রোটিন, পেপটাইড এবং অন্যান্য যৌগের একটি জটিল মিশ্রণ যা কোষ এবং টিস্যুর জন্য বিষাক্ত। সাপের চার ধরণের বিষ রয়েছে যেমন-(১) হেমোটক্সিক বিষ যা হার্ট এবং রক্ত সহ কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। (২) নিউরোটক্সিক বিষ যা মস্তিষ্ক সহ স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে। (৩) সাইটোটক্সিক বিষ যা কামড়ের স্থানে একটি স্থানীয় প্রভাব রয়েছে এবং (৪) প্রোটিওলাইটিক বিষ যা কামড়ের স্থানের চারপাশে আণবিক গঠন ভেঙে দেয়। সাপে কামড়ালে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাপের কামড়ে প্রাণহানি না ঘটলেও মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। World Population Review এর Snake Bite Deaths by Country 2024 মতে ২০২টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান সবার শীর্ষে সেখানে প্রতিবছর প্রতি ১ মিলিয়ন বা ১০ লাখ লোকের মধ্যে সাপের কামড়ে মারা যায় ৪০৪২ জন আর ৩২ নং অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে মারা যায় ৭৬৭ জন। মাত্র ০১ জন করে মারা যায় এমন দেশের তালিকায় রয়েছে কুয়েত, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসহ আরো ৯টি দেশ। মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড এবং মাদাগাস্কারসহ আরো ৩০টি দেশে সাপে কামড়ে মারা যাবার কোন রেকর্ড নেই। এ ছাড়াও বাংলাদেশে সাপের কামড়ে প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার গৃহপালিত পশু আক্রান্ত হয় এবং এর মধ্যে ২৫০০ পশু মারা যায়। সাপের কামড়ে কেউ বেঁচে গেলেও নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগে থাকে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর ৪ লাখেরও বেশি মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন। সরকারি গবেষণায় দেখা গেছে, সাপের কামড়ের ঘটনাগুলোর ৯৫ শতাংশই গ্রামাঞ্চলে ঘটে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১০ দশমিক ৬ শতাংশ পরে শারীরিক এবং ১ দশমিক ৯ শতাংশ মানসিক সমস্যায় ভোগেন। সাপে কাটা রোগী নিয়ে কবিরাজি ঝাঁড়ফুকের চিকিৎসায় মানুষের আস্থা থাকলেও বিজ্ঞান সম্মতভাবে বিষধর সাপের ক্ষেত্রে অবশ্যই এন্টিভেনম ছাড়া আর কোন বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা ভাবা মানেই মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে আসা। তাই মানুষ আবিস্কার করেছে এন্টিভেনম। সময়মতো এন্টিভেনম না নিয়ে কবিরাজ ওঝার পিছনে সময় ক্ষেপন করলে রোগী মৃত্যু নিশ্চিত। গোখরা সাপ কামড়ালে ৮ ঘন্টা, কেউটে কামড়ালে ১৮ ঘন্টা এবং রাসেল ভাইপার সাপ কামড়ালে ৭২ ঘন্টার মধ্যে এন্টিভেনম নিতে হয়। কিন্তু সাপে কাটা রোগী নিয়ে এখনও জনসাধারণের মাঝে সচেতনতার অভাব রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ ইন্দো-মালয়ান, ইন্দো-চাইনিজ এবং ইন্দো-হিমালয় অঞ্চলের সঙ্গমস্থলে অবস্থিত, তাই দেশের বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেমে সাপসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর বসবাসের বা টিকে থাকার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাপের কামড়কে পেশাগত স্বাস্থ্যের ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করা হয় কারণ মানুষ যখন কৃষিকাজ, মাছ ধরা, চাষাবাদ, বন থেকে কাঠ আহরণ ও মধু সংগ্রহ অথবা ফসলি জমি বা বাগানের যত্ন নেওয়ার মতো কাজে নিযুক্ত থাকে তখন প্রায়শই সাপে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে বিশ্বজুড়ে ৪৮টি অ্যান্টিভেনম তৈরীর পাবলিক ল্যাবরেটরি রয়েছে। তন্মধ্যে ৪টিই ভারতে এবং ভারত সবচেয়ে বড় অ্যান্টিভেনম উৎপাদনকারী দেশ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তত্ত্বাবধানে পাঁচটি বিষধর সাপ নিয়ে শুরু হয়েছে সাপের কামড়ের ওষুধ অ্যান্টিভেনম তৈরির কাজ।

সাপের কামড়ে যে শুধু মানুষ বা গবাদি পশু মারা যায় এমন নয়। সাপ ছাড়াও বিষাক্ত মাকড়সা, এসকারিডস, ইনসেক্ট, স্করপিওন, জেলিফিশের আক্রমনেও প্রতি ১০ লাখে বাংলাদেশে ৮২ জন মানুষ মারা যায়। উইকিপিডিয়ার সূত্র মতে বিশ্বব্যাপী এন্টিভেনম তৈরীর ল্যাবরেটরি রয়েছে বিষাক্ত মাকড়সার জন্য ০৯টি, এসকারিডসের জন্য ০১টি, ইনসেক্ট-এর জন্য ০১টি, স্করপিওন-এর জন্য ১২টি তন্মধ্যে ভারতে ০৩ টি, জেলিফিশের জন্য রয়েছে ০২টি। উল্লেখিত অন্যান্য প্রাণীগুলোর আক্রমণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ ও গবাদি পশু মারা যায় এবং এগুলোর ভ্যাকসিন তৈরীর কারখানা বাংলাদেশসহ ভারতেও নাই বললে চলে সেক্ষেত্রে সচেতনতা ও সাবধানতাই জীবন বাঁচার একমাত্র অবলম্বন।

সাপের যেমন রয়েছে পরিবেশতাত্বিক গুরুত্ব তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। উন্নত দেশগুলোকে অনুসরণ করে সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কিছু বিষাক্ত সাপের খামার। মূলত সাপ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ, বিষ সংগ্রহ, রপ্তানি এবং প্রতিষেধক তৈরির উদ্দেশ্যেই গড়ে উঠেছে এসব খামার। কিছু সাহসী ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় আজ উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় থমকে আছে সম্ভাবনাময় এই শিল্প। ১ গ্রাম সোনার মূল্য ৮৬.৪৪ মার্কিন ডলার (সূত্র: Gold price today by weight and carats per gram in USD) আর ১ গ্রাম বাংলাদেশী কোবরা সাপের বিষের মূল্য ৩৫০ মার্কিন ডলার। প্রজাতিভেদে সাপের বিষের মূল্যের তারতম্য রয়েছে। সাপের বিষের সবচেয়ে কম মূল্য Agkistrodon bilineatus প্রজাতির সাপের (১ গ্রাম ২০০ মার্কিন ডলার) এবং সবচেয়ে বেশি মূল্য Pseudonaja nuchalis প্রজাতির সাপের (১ গ্রাম ৩৯৯০ মার্কিন ডলার) (সূত্র: Venom Supplies Pty Bilineates)। সঠিক পরিচর্যায় এক মাসে একটি সাপ থেকে দুবার বিষ সংগ্রহ করা যাবে যা প্রায় এক গ্রাম বিষের সমান। পরিচর্যা খরচ বাদ দিলেও মাত্র ১টি সাপ থেকে মাসে ৩০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। কোবরা সাপের বিষে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান পটাশিয়াম সায়ানাইডের পরিমাণ বেশি আছে। প্রতি বছরই দেশে শত শত কোটি টাকার বিষ উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে সাপের চাষ ও বিষ রপ্তানীর ক্ষেত্রে বৈধতা প্রদান করলে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। সাপের বিষের মাধ্যমে ওষুধ শিল্পে গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এটাকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এটি একসময় বাংলাদেশের ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’ হবে।

গ্লোবাল স্নেক অ্যান্টিভেনম বাজার ২০২৩ সালে ৩১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব তৈরি করেছে এবং ২০২৪ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে বাজারটি ৬৬১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক হয়ে। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হল থ্রম্বোসিস বা রক্তের জমাটবাঁধা। ফ্রাঙ্কফুর্টের জীবরসায়নবিদ ইয়োহানেস এব্লে সাপের বিষ থেকে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঔষধ Captropil আবিস্কার করেন। উক্ত ঔষধটি diabetic nephropathy চিকিৎসায়ও ব্যবহৃত হয়। সাপের বিষ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার নিরাময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও সাপের বিষ থেকে Ancrod, Angiotensin –converting enzyme, Eptifibatide, Tirofiban ইত্যাদিসহ Lupus & Rheumatoid Arthritis-এর মূল্যবান ঔষধ উদ্ভাবন করা হয়েছে। নতুন ওষুধের বিকাশের জন্য সাপের বিষ একটি মূল্যবান সম্পদ। বিজ্ঞানীরা অত্যধিক যত্ন ও সতর্কতা অবলম্বন করে এই উপাদানগুলি বোঝার মাধ্যমে নতুন কিছু মূল্যবান ঔষধ উদ্ভাবন করেছে। তবে এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে সাপের বিষ প্রোটিন এবং অন্যান্য পদার্থের একটি জটিল মিশ্রণ, যার অনেকগুলিই বিষাক্ত। তাই ঝুঁকি কমিয়ে সাপের বিষের উপকারী উপাদানগুলোকে বিচ্ছিন্ন ও বিশুদ্ধ করার জন্য গবেষণা চলছে।

মানুষ হেরে যাওয়ার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। পৃথিবীতে আগমনের সূচনা থেকে মানুষকে নানা প্রতিকূলতা, প্রতিরোধ,চ্যালেজ্ঞ মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। তেমনি সাপের কামড়ে মানুষ হেরে যাবার পাত্র নয়। তাই সাপের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে মানুষ আবিস্কার করেছে এন্টিভেনম। বিষাক্ত সাপের কামড়ে হাতিসহ অন্যান্য প্রাণীরা মারা গেলেও কয়েকটি মাত্র প্রাণী আছে যারা সাপের বিষে মরে না। এমন একটি প্রাণীর নাম ঘোড়া। সাপের কামড়ে ঘোড়া মরে না। তিনদিন অসুস্থ থাকে, তারপর সুস্থ হয়ে যায়। আর এই ঘোড়া থেকে আসে পৃথিবীর সব সাপের বিষের প্রতিষেধক Anti Venom। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুসারে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় কার্যকর সমাধান পেতে নিজ দেশের বিভিন্ন জাতের বিষধর সাপের বিষ থেকে এন্টিভেনম তৈরি করতে হয়। তা হলে এন্টিভেনম শতভাগ কাজ করতে পারে। আমাদের দেশে চাহিদার তুলনায় অল্প সংখ্যক এন্টিভেনম তৈরী হয় যার ফলে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে আমাদেরকে ভারত থেকে এন্টিভেনম আমদানী করতে হয়। ভারত আমাদের প্রতিবেশি হলেও একই প্রজাতির সাপের ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের সাপের বিষের তীব্রতা অনেক বেশি । তাই ভারতের এন্টিভেনম পুরোপুরি কাজ করতে পারে না। আবার ভারত থেকে এক ডোজ এন্টিভেনম আমদানী করতে খরচ পরে ৭৩ মার্কিন ডলার আবার বাংলাদেশের ইনসেপটা কোম্পানী দেশীয় সাপের বিষ থেকে যে এন্টিভেনম তৈরী করে তা একদিকে যেমন অধিক কার্যকরী তেমনি দাম মাত্র ১৩ মার্কিন ডলার।

এন্টিভেনম দুই ধরনের হয়। পলিভেলেন্ট স্নেক এন্টিভেনম, যা দুই বা ততোধিক সাপের বিষ ক্রিয়ায় কাজ করে। অন্যটি মনোভেলেন্ট স্নেক এন্টিভেনম, যা নির্দিষ্ট একটি সাপের বিষক্রিয়া নষ্ট করতে কাজ করে। দেশের হাসপাতালগুলোতে যে এন্টিভেনম ব্যবহার করা হয় তা পলিভেলেন্ট স্নেক এন্টিভেনম। বৈশ্বিক এন্টিভেনমের বাজার মূল্য হলো ১.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

১৮৯৬ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী আলবার্ট ক্যালমেট সর্বপ্রথম অ্যান্টিভেনম তৈরি করেছিলেন (কোবরার বিষের বিরুদ্ধে)। তখন ভিয়েতনাম ছিল ফ্রান্সের একটি উপনিবেশ। আলবার্ট ক্যালমেট ছিলেন পাস্তুর ইন্সটিটিউট-এর একজন ছাত্র এবং সে সময় তিনি ভিয়েতনামেই থাকতেন। তখন বর্ষাকালে নিচু এলাকা প্লাবিত হলে, গোখরা সাপের উপদ্রব খুব বেড়ে যেত এবং প্রতিদিন অনেক মানুষ সাপের কামড়ে মারা যেত। এমনই এক বন্যার পরে ভিয়েতনামের একটি গ্রামে একটি গোখরা সাপের কামড়ে প্রায় ৪০ জন মানুষের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর ক্যালমেট, সাপের বিষের প্রতিষেধক আবিষ্কারের দিকে মনোনিবেশ করলেন। ক্যালমেট দেখলেন যে, ঘোড়াকে সাপে কামড় দিলে, ঘোড়ার তেমন কিছু হয় না। আর এই আশ্চর্য বিষয় থেকেই তিনি তার প্রতিষেধক আবিস্কারের কাজ শুরু করেন। আর এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করার পর তিনি জানতে পারলেন যে, ঘোড়ার দেহে প্রাকৃতিকভাবে সাপের বিষের বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করার জন্য, হাইপার ইমিউনিটি পাওয়ার উপস্থিত থাকে। এই ইমিউনিটি পাওয়ারের কারণে ঘোড়ার দেহে সাপের বিষ ধ্বংস করার জন্য প্রচুর পরিমাণে এন্টিবডি তৈরী হয়। আর এই কারনেই সাপের কামড়ে ঘোড়া মরে না। ক্যালমেট প্রথমে গোখরা সাপ কামড় দেয়া ঘোড়ার রক্ত থেকে এন্টিবডি কালেক্ট করলেন। তারপর সেই সংগৃহীত এন্টিবডি সাপেকাটা ব্যাক্তির শরীরে প্রবেশ করালেন এবং সাপেকাটা ব্যক্তি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠলো। তবে শুধু ঘোড়া নয় ভেড়া থেকেও সাপের বিষের এন্টিভেনম তৈরী করা হয়। বেশী রক্ত এবং অনেকদিন বাঁচে আর বারবার ব্যবহার করা যায় বলে বর্তমানে বাণিজ্যিক ভাবে এন্টিভেনম উৎপাদনের জন্য ঘোড়ার ব্যবহার সর্বাধিক। তবে হাঙ্গরের ব্যবহার সবচাইতে কার্যকর হওয়া সত্তেও হাঙ্গরের চাইতে ঘোড়ার ব্যবহার বেশী করা হয় কারণ ঘোড়ার তুলনায় হাঙ্গর সহজ লভ্য নয়।

অ্যান্টিভেনম প্রস্তুত প্রনালী – সাপের বিষের তীব্রতা আলাদা আলাদা প্রজাতির ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা হয় এমনকি নিজ প্রজাতির ছোট বড় সাপের ক্ষেত্রেও আলাদা হতে পারে। সাধারণত সাপ যত বড় হবে বিষের তীব্রতাও তত বেশি হবে। সেজন্য কোন সংগৃহীত পাত্রে কোনটার বিষ রাখা হয়েছে সেটা পাত্রের গায়ে লিখে রাখতে হয়। ঘোড়ার শরীরে বিষ প্রয়োগ করার জন্য প্রথমে বিষ নিয়ে তার সাথে পরিমাণমতো পানি মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে একটি বিশেষ যৌগের সাথে মেশানো হয় যেটি ঘোড়ার প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরো উত্তেজিত করে তোলে যার ফলে ঘোড়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রভাবিত হয় ও বিষটিকে প্রশমিত করে দেয়। এক্ষেত্রে এই সলিউশনটি সাধারণত প্রয়োগ করা হয় ঘোড়ার ঘাড়ের পিছনে যেখানে Lymph nodes I immune cell থাকে। একই সাথে আরেকটি কৌশল অবলম্বন করা হয় যা হলো এক স্থানে অনেকখানি প্রয়োগ না করে ঘোড়ার দেহের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে প্রয়োগ করা হয় ফলে অনেক বেশি স্থানে স্বল্প পরিসরে বিষ প্রয়োগ করার ফলে প্রতিষেধক তৈরিও হয় বেশি আবার ঘোড়ার দেহের ক্ষতিও কম হয়। ৮ থেকে ১০ সপ্তাহ পর এদের দেহে সবচেয়ে বেশি এন্টিবডি পাওয়া যায়। এসময় তার দেহ থেকে রক্ত বের করে নেয়া হয় (সাধারণত ৩-৬ লিটার)।

দেহে বিষ ইঞ্জেক্ট করার পর থেকে প্রায় ৩ দিন পর্যন্ত ঘোড়াটি অসুস্থ থাকে । ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে ঘোড়াটি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। এই সময়ের মধ্যে ঘোড়ার শরীরে বিষের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে শুরু করে এবং সমস্ত বিষ নষ্ট হয়ে যায় । এরপর রক্ত থেকে প্লাজমা ও রক্তকণিকা আলাদা করে নিয়ে প্লাজমা রেখে রক্তকণিকা আবার ঘোড়ার দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। অপ্রয়োজনীয় প্রোটিন গুলো কে বাদ দেওয়া হয়। এটি করা হয় প্লাজমার পিএইচ অদল বদল করার মাধ্যমে বা একটু লবণ প্রয়োগ করে। এরপর একটি এনজাইমের মাধ্যমে এন্টিবডিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করা হয় ও সক্রিয় উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়। এভাবেই প্রতিষেধক তৈরি প্রক্রিয়া শেষ হয়। এ গুলোকে ছোট শিশিতে Saline solution আকারে থাকে ও শিরার মধ্যে প্রয়োগ করা হয়। সাপে কাটা ব্যক্তির রক্তে প্রবেশ করানোর পর এই এন্টিভেনাম বিষের সাথে মিশে বা বিক্রিয়া করে বিষ প্রশমিত করে দেয় ও কিডনির মাধ্যমে অতিরিক্ত কেমিক্যাল উৎপাদিত যৌগগুলো দেহ থেকে বের হয়ে যায়।

এই এন্টিভেনম সাপে কাটা রোগীর শরীরে ইনজেকট বা পুশ করলে তা শরীরে থাকা ভেনমকে অকার্যকর করে রোগীর জীবন বাঁচায়। হাজার হাজার মানুষের জীবন এই এন্টিভেনমের কারনে বেঁচে যায়। মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের CroFab নামে একটি এন্টিভেনমের এক ডোজের/ভায়ালের মূল্য ৩০০০ ডলার। একজন রোগীকে সূস্থ করতে কমপক্ষে ০৬ ডোজ প্রয়োজন। অন্য একটি এন্টিভেনম Anavip-এর এক ডোজের মূল্য ১২২০ ডলার যার ১০ টি ভায়ালের প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম আরো কয়েকটি দামি এন্টিভেনম রয়েছে যেমন Boomslang antivenom, King Cobra antivenom, Taipan antivenom, Gaboon Viper antivenom ইত্যাদি।

বিশ্বের যে কোনো বিষধর সাপের বিষকে অকার্যকর করে দেবে এমন এক অব্যর্থ ওষুধ তৈরির গবেষণায় নিজেকের উৎসর্গ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের সাবেক একজন ট্রাক-চালক টিম ফ্রেডি। দু’শরও বেশিবার তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বেচ্ছায় বিষাক্ত সাপের কামড় খেয়েছেন। আমাদের দেশেও বৃহৎ পরিসরে উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের প্রাণ ও প্রকৃতি বাঁচাতে মানুষের পাশাপাশি সাপ ও ঘোড়া নিয়ে আরো ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম

সারাবাংলা/এএসজি

ঘোড়া প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত সাপ সাপ ও ঘোড়া নিয়ে গবেষণা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর