Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কপ-২৯: বিশাল সমুদ্রে এক বিন্দু জল

অলোক আচার্য 
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৪৮ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৫০

বাকুর কপ-২৯ সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিশ্বনেতাদের একাংশ। ছবি: ইন্ডিপেন্ডেন্ট

অবশেষে প্রতিবারের মতোই একগুচ্ছ আশা সামনে রেখে শেষ হলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। জলবায়ু থেকে প্রতিবছরই কিছু না কিছু লাভ হয় তবে সেটি বিশাল সমুদ্রের মধ্যে এক বিন্দু জলের মতোই মনে হয়। যত দ্রুত পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তার তুলনায় মানুষের এসব সিদ্ধান্ত ও তার বাস্তবায়ন নিতান্তই ধীর গতি। আবার সবাই কথা রাখছে না।
এই বছর কপ ২৯ আয়োজিত হয়েছিল ১১ থেকে ২২ নভেম্বর, আজারবাইজানের রাজধানী বাকু শহরে। অংশগ্রহণের নিরিখে গতবছরের দুবাই ‘কপ ২৮’-এর পরে এটাই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কপ। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী ‘গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ’ হ্রাসে নিম্নআয়ের দেশগুলিকে সহায়তা করার জন্য তহবিল বাড়ানো এই কপের একটা মূল লক্ষ্য ছিল। তাই বিশেষজ্ঞেরা এটিকে ‘ফাইন্যান্স কপ’ বলেও দাবি করেছিলেন। উন্নত দেশগুলির মধ্যে কে, কত টাকা, কোন খাতে দেবে, সে সব নিয়ে আলোচনা করাই এ বারের সম্মেলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
গতবারের দুবাই কপের একটা মূল বিষয় ছিল জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কীভাবে কমানো যায়, তাই নিয়ে আলোচনা। সামনের বছর, ব্রাজিলের বেলেমে কপ ৩০ হওয়ার কথা। সেই সম্মেলন লক্ষ্য রেখে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সব দেশকে জানাতে হবে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কী ভাবে তারা ‘নেট জিরো’য় নিয়ে যেতে পারবে। আশার কথা, ভুটান, মাদাগাস্কার, পানামা এবং সুরিনাম ইতিমধ্যেই গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণে শূন্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছে। মূলত এবারের সম্মেলনে আলোচ্যসূচির শীর্ষে ছিল অর্থায়ন। উন্নত বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে কি পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয় সেটাই ছিল দেখার বিষয়। আশ্চর্য হলো চাহিদার বা প্রয়োজনের খুবই সামান্য পরিমাণ দিতে সম্মত হয়েছে দেশগুলো। এ নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নয় দেশগুলো।
কপ ২৯ এর সূত্রগুলোর কাছ থেকে জানা যায়, শুরু থেকেই অর্থায়নের বিষয় নিয়ে ব্যাপক দেনদরবার হয় দেশগুলোর মধ্যে। প্রথমে ২৫০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয় ধনী দেশগুলো। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হলে সেটি বাড়িয়ে ৩০০ বিলিয়নে যায়। আপাতত এই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে উন্নয়নশীল ও স্বল্প উন্নত দেশগুলোকে। এমনকি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এই সম্মেলনে আসেনইনি। জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এই অঙ্ককে লজ্জাজনক ও আপত্তিকর বলে মন্তব্য করে। পানামার প্রতিনিধি হুয়ান কার্লোস মন্টেরি গোমেজ গার্ডিয়ানকে বলেন, এটা কোনওভাবেই যথেষ্ট না। আমাদের বছরে অন্তত ৫ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমরা চেয়েছি ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বৈশ্বিক জিডিপির মাত্র এক শতাংশ।
১৯৯৫ সালে প্রথম কপ সম্মেলন হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বসেছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের ২৯তম আসর। সোমবার, ১১ নভেম্বর বাকুর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে দুই সপ্তাহব্যাপী এই জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়।
আজ থেকে দুইশ বছর আগে ব্রিটেনে শুরু হয়েছিল শিল্প বিপ্লব। এই শিল্প বিপ্লবের মূলে ছিল কয়লা। বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কয়লা। গতবছর জলবায়ু সম্মেলনে দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বন্ধে একটি খসড়া চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। সামনে আরেকটি জলবায়ু সম্মেলন। এর আগেই একটি চমৎকার উদ্যোগ নিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটেন থেকে যে শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়, সেখান থেকেই নতুন পথের যাত্রা শুরু হয়েছে। ২০০ বছর আগে যে দেশে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল, এর মধ্য দিয়ে সেখানে কয়লা যুগের অবসান ঘটতে চলেছে। কয়লার বদলে দেশটি প্রাকৃতিক গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। ধনী দেশগুলোর বৈশ্বিক ক্লাবের মধ্যে ব্রিটেনই প্রথম কয়লা থেকে সরে আসছে। ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ডে বিশ্বের প্রথম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গতি মন্থর করার চেষ্টায় শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম একটি মাইলফলকে পৌঁছাচ্ছে যুক্তরাজ্য। অন্য জি-সেভেন দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ২০২৫ সালের মধ্যে, কানাডা ২০৩০ সালের মধ্যে এবং জার্মানি ২০৩৮ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসার পরিকল্পনা নিয়েছে।
কয়েক বছর ধরই নতুন অর্থায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল জাতিসংঘ। উন্নয়নশীল দেশগুলো এই লক্ষ্য চূড়ান্তের অপেক্ষায় আছে। চরম আবহাওয়ার কারণে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে বলে উঠে এসেছে। বিশেষত আকস্মিক বন্যা এবং অব্যাহত খরাসহ বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত দুই বছরে ৪৫১ বিলিয়ন (৪৫ হাজার ১০০ কোটি) ডলার ক্ষতি হয়েছে। ১০ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে, যেখানে ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। এরপর চীন ও ভারত অবস্থান করছে, যেখানে যথাক্রমে ২৬ হাজার ৮০০ কোটি ও ১১ হাজার ২০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। এ কারণেই এবারের সম্মেলনে অর্থায়নকে শীর্ষ এজেন্ডা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এবারের কনফারেন্স অব দ্য পার্টি (কপ) হচ্ছে অর্থায়নের কপ। ফলে সবার দৃষ্টি ছিল কপ-২৯-এর দিকে। এই এজেন্ডা নিয়েই এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে আগ্রহ ছিল। কিন্তু শেষমেষ কাজের কাজ তেমন কিছুই হলো না।
সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী চলমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক উৎস থেকে উন্নত দেশগুলোর প্রতিবছর ৫০০ বিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এদিকে বিজ্ঞানীরা ২০২৪ সালকে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর বলেছেন। এটি এমন এক সময় যখন এই উষ্ণায়নের মাত্রা কমাতেই বিশ্ব নেতারা একত্রিত হচ্ছেন। স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট রিপোর্টে’ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এক ভয়ংকর চিত্র হাজির করেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, তাপমাত্রা রেকর্ড শুরু হওয়ার পর ২০১৫-২০২৪ সবচেয়ে উষ্ণ দশক। বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা একটানা ১৬ মাস ধরে (জুন ২০২৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪) সম্ভবত আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রায়শই ব্যবধান বাড়ছে। ২০১৫ সালের কপ ২১ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ সম্মত হয় প্যারিস চুক্তিতে। যার লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক উষ্ণতাকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে সীমাবদ্ধ করা এবং দেড় ডিগ্রিতে আটকে রাখা। ওয়ার্ল্ড মেটারোলজিক্যাল অরগানাইজেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আপাতত দেড় ডিগ্রি থ্রেশহোল্ড পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব মনে হচ্ছে না। যাকে প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা বলা যায়। দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রায় এক দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না।
আমাদের মূল লক্ষ্য তাপমাত্রা কমানো। কিন্তু সেই তাপমাত্রা আদৌ কমছে না। বরং গবেষণা আরও ভয়ঙ্কর তথ্য দিচ্ছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে শতাব্দী শেষে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ৩ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির পরিবেশ কর্মসূচির একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ ১ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধি রোধে উন্নত দেশগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ৭৭ শতাংশের জন্য উন্নত দেশগুলোর জোট জি-২০কে দায়ী করেছেন প্রতিবেদনটির প্রধান বৈজ্ঞানিক সম্পাদক অ্যান ওলহফ। তিনি বলেন, আমরা যদি ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে অগ্রগতির দিকে তাকাই, বিশেষ করে জি-২০ সদস্য দেশগুলো, তারা ২০৩০ সালের জন্য বর্তমান জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারেনি। জাতিসংঘ বলেছে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ রোধে বর্তমানে যেসব নীতি বা বিধি রয়েছে, সেগুলোর আওতায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হয়ও, তবুও ২১০০ সালে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ দশমিক ৬ থেকে ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়তে থাকলেও এখনও বিশ্বের জ্বালানির প্রায় ৮০ শতাংশই আসে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে।
জলবায়ু পরিবর্তন কোনও একক ইস্যু নয় যে তা এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। তবে এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোই বেশি। এর ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে বাংলাদেশও। এডিবির তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাবের বার্ষিক গড় ক্ষতি প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। জলাবয়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৪০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে। জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (২০২৩-২০৫০) বাস্তবায়ন ও জলবায়ুকেন্দ্রিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জনে এই ঋণ অবদান রাখবে বলে মনে করে সংস্থাটি। বিশ্বের যেসব দেশের কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাদের সেখান থেকে বেরিয়ে টেকসই পরিবেশ গড়ায় মনোযোগী হতে হবে। শিল্পের যাতাকলে পৃথিবীর অবস্থা আজ অত্যন্ত দুর্বিষহ। যদি তারা এবারও ব্যর্থতার পরিচয় দেন বা অসহযোগীতামূলক মনোভাব প্রদর্শন করেন তাহলে পৃথিবীর অস্তিত্ত্ব মূলত আরও বেশি সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাবে। যেখান থেকে ফিরে আসা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। এক কথায় বলা যায়, ব্যর্থ হলে পৃথিবী নামক এই গ্রহের ধ্বংস অনিবার্য। তখন হয়তো বিলুপ্তি খাতায় মানুষের নামও উঠে যাবে। সুতরাং ব্যর্থতা নয়, চাই ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। যদিও ৩০০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজনের তুলনায় সামান্যই। তারপরও এই পরিমাণ দিয়েই দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিষ্ট

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

কপ-২৯

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর