ব্যাকপেইনে বিএনপি
২৭ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:১৮
এক পা এগোলে তিন পা পেছনে পড়ে যাচ্ছে বিএনপি। ব্যাকপেইন বা ব্যাক গেয়ারের কারণে সরকার পতনের এক দফায় মার খেয়েছে। অথচ, গত বছরের ২৮ অক্টোবরের আগ পর্যন্ত মানববন্ধন-সেমিনার-রোড মার্চ ধরনের কোমল কর্মসূচিতে হয়েছে ব্যাপক অগ্রগতি । ২৮ অক্টোবরের পর থেকে কেবলই খরার টান। পুলিশ সদস্য হত্যা, প্রধানবিচারপতির বাসভবনে ভাঙচুরসহ নাশকতার মামলায় ধরপাকড়ের শিকার বিপুল নেতাকর্মী। এখনো কারান্তরীণ সিনিয়রসহ নেতাকর্মীদের অনেকে। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও অকুলান হয়ে পড়ছে। মূল দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে আন্দোলনের ব্যর্থতা নিয়ে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৮ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার হয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি জামিন পাননি। বিএনপির আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও জেলে, মির্জা আব্বাসও এখন কারান্তরীণ।
দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস- আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ বিএনপির প্রায় ২৩ হাজার নেতা-কর্মী এখনো কারাবন্দি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত এমন কোনো নেতা নেই যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। বিএনপির দাবি, সারা দেশে ১ লাখ ১১ হাজার মামলায় দলের প্রায় ৫০ লাখ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। অনেকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না, বাড়িঘরে থাকছেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপির এই পরিসংখ্যান মানতে নারাজ সরকার। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১২ হাজারের মতো হবে। কয়েক হাজার ইতিমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
একদিকে নেতারা কারাবন্দী, ফেরারি; অন্যদিকে দলের মধ্যে চলমান দোষারোপ ও যন্ত্রণার মধ্যেই কালো পতাকা মিছিল সেরেছে বিএনপি। দিয়েছে ৩০ জানুয়ারি সারাদেশে কালো পতাকা দেখানোর নতুন কর্মসূচি। আর হুঙ্কার দিচ্ছে সরকারের বিদায়ঘন্টা বাজানোর। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও অবৈধ সংসদ বাতিলের দাবি আদায় করে ছাড়বে। নতুন কোনো সাঁড়াশি আক্রমণ-মামলা না হওয়া এবং নেতাকর্মীদের কারো কারো জামিনে নির্বাচনের পর সরকারের একটি রাজনৈতিক শান্ত আবহ তৈরির গন্ধ পাচ্ছে বিএনপি। এ সুযোগে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে তারা আস্তে আস্তে রাজনীতির মাঠে নামানোর চিন্তা ঘুরছে দলের একটি অংশের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা চতুর্থ দফায় শপথের সান্ধ্য সময়েই খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে বাসায় আনার মধ্যেও রাজনীতির রসদ দেখছে তারা। ক্ষমতাসীন কারো কারোও ধারনা, কৌশলগত কারণে একটি নমনীয়তা ঘটলে বিএনপি আন্দোলনের নামে ডিস্টার্ব ক্ষান্ত দিয়ে সংগঠনিক ক্রাইসিস কাটাতে মনোযোগী হতে পারে। এমন ধারনার সঙ্গে দ্বিমতও আছে। ড.মঈন খান. নজরুল ইসলাম খানসহ কারামুক্ত থাকা কয়েবক নেতার সঙ্গে এরইমধ্যে বেগম খালেদা জিয়ার বেশ যোগজিজ্ঞাসার তথ্য ঘুরছে বিএনপি কর্মীদের মুখে মুখে। তাকে সদরে না হোক অন্দর মহলে অ্যাক্টিভ করার চেষ্টা আছে। তার নির্দেশনা মতো বিএনপিতে পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
সেই প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের চেয়ে জোর দেয়া হচ্ছে নেতাকর্মীদের কারামুক্ত করাকে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে গত বছরের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত বেশ হাকডাকেই চলেছে কর্মসূচি। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ দিলেও যথারীতি ৭ জানুয়ারি নির্বাচন তুলে নিয়ে ফের মসনদে বসেছে আওয়ামী লীগ। রাজনীতির মাঠে অনেকটা নির্ভারেই এগোচ্ছে সরকার। এর বিপরীতে বিএনপি আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা শোনাচ্ছে নিয়মিত। চালিয়ে যাচ্ছে বিদেশি মহলের সঙ্গে যোগাযোগসহ ওঠাবসাও। গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনের সড়কে আয়োজিত মহাসমাবেশ পুলিশের অভিযানে পণ্ড হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বরবাদ হয়ে যায় বিএনপির আন্দোলন। একে একে গ্রেফতারের শিকার হতে থাকেন শীর্ষ নেতারা। এরপর থেকে বিএনপি এবং সমমনাদের ১২ ধাপে ২৪ দিনের অবরোধ এবং পাঁচ ধাপে ছয়দিনের হরতালসহ ধারাবাহিক কর্মসূচি চলে। এছাড়া গত ২০ ডিসেম্বর নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি জনসাধারণের প্রতি সরকারকে অসহযোগিতার এবং তাদের আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে ‘অসহযোগ’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে জনসাধারণের মাঝে লিফলেট বিতরণ চলে। সরকার সেদিকে একটুও কেয়ার না করে সেরে নেয় নির্বাচন। নির্বাচন হয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলেও বিএনপি নেতাদের দাবি, জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে ভোটদানে বিরত ছিল।
ভোটের পর নতুন প্রেক্ষাপটে আন্দোলন-কর্মসূচির ধরন ও কৌশল ঠিক করতে এরইমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা সাংগঠনিক পর্যায়ে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক শুরু করেছেন। সমমনা কয়েকটি জোটের সঙ্গেও পৃথক মতবিনিময় হয়েছে। এসব বৈঠকে নতুন কর্মসূচির বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়। মতামত ও পরামর্শ হিসেবে সবাই বলছেন, নতুন কর্মসূচির চেয়ে এই মুহূর্তে কারাবন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্ত করতে আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে বেশি মনোযোগী হতে। সেই দৃষ্টে আলোচনা হয়েছে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। পরে তারেক রহমান ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেন দলীয় আইনজীবীদের সংগঠন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতাদের সঙ্গে। দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তির বিষয়ে একটি সমন্বয় কমিটিও করা হয়েছে। এতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিনকে। বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীদের মুক্তির জন্য নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে আইনজীবী। বিভিন্ন বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সমন্বয় করছেন জেলা নেতাদের সঙ্গে। নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীরা আটককৃত নেতাকর্মীর নথি সংগ্রহ করছেন। এসব মামলার বড় অংশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাদী পুলিশ। সাক্ষীরাও পুলিশ সদস্য। আইনজীবীদের জন্য এটি নতুন অভিজ্ঞতা। বিচার ব্যবস্থায়ও নতুন সংযোজন। এসবের বেশিরভাগ মামলাই জামিনযোগ্য বলে মত তাদের। এ উছিলায় তারা সরকার ও বিচারালয়ের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। গত তিন মাসে বিএনপি চেয়ারপারসনের দুইজন উপদেষ্টা, একজন ভাইস চেয়ারম্যান, একজন যুগ্ম মহাসচিব, চারজন সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক, তিনজন নির্বাহী কমিটির সদস্য, ঢাকা মহানগরের তিন শীর্ষ নেতা, যুব ও স্বেচ্ছাসেবক দলের পাঁচ শীর্ষ নেতা এবং জেলা পর্যায়ের কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে গেলে এসব মামলা হতো না বলে নিশ্চিত নেতারা। এখন আন্দোলনের চেয়ে তাদের মুক্ত করাকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার একটি ফল আশা করতেই পারে বিএনপি। এরইমধ্যে কিছু ফল মিলছেও।
এমন ফল অব্যাহত থাকলে চলতি এবং আগামী মাসে ঢাকাসহ সাংগঠনিক বিভাগগুলোতে সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির। সামনে রমজান মাস। রোজা সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম চড়া। সরকারের বিরুদ্ধে এটি মোক্ষম ও যৌক্তিক ইস্যু হতে পারে। ধীরে ধীরে আবার ফিরতে পারবে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে। সেই নমুনাও মিলছে। গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয় এবং নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় খেলা হয়েছে। আত্মগোপনে থাকা নেতা-কর্মীরাও একটু একটু প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। আদালত থেকে নেতা-কর্মীদের কারো কারো জামিন তো মিলছেই। কৌশলী এ রাজনীতির পুরোভাগে রয়েছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. মঈন খান। কূটনৈতিক অঙ্গনে বেশ সমাদৃত তিনি। তিনি বরাবরই মারদাঙ্গা বা সহিংস আন্দোলনবিরোধী। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা তাকে পছন্দ করেন বলে আলোচিত। এর বিপরীতে দলের মধ্যে ভীরু-আপোসকামীতার বদনামও আছে তার। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন কারো কারো মধ্যে নেতিয়ে পড়া দলটি নিয়ে অতিকথনে সন্তুষ্টু বিএনপির একটি মহল। তারা মনে করেন, এসব কথা বলে মন্ত্রীদের কয়েকজন বিএনপির গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই