ধর্মতে সংখ্যার লঘু-গুরু আর কত?
১৪ অক্টোবর ২০২৩ ২১:৩২ | আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৩ ০২:৪৩
ধর্ম দিয়ে সংখ্যার লঘু-গুরু নির্ধারণের বাতিক থেকে আমাদের নিস্তার নেই- তা অনেকটা পরিস্কার। অবিরাম চর্চায় এটি নিয়তির মতো হয়ে গেছে। যে কারণে স্বাধীনতার একান্ন-বায়ান্ন বছরেও শুনতে হয় সংখ্যালঘু শব্দটি। তারওপর টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায় সংখ্যালঘুদের অধিকতর পছন্দের দল আওয়ামী লীগ। এর পরও পূজা-পার্বণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তাহীনতার কথা, নিরাপত্তা দেয়ার আশ্বাস শুনতে কি ভালো শোনায়? নিরাপত্তার আশ্বাস শুনিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে? এরপরও শুনতেই হয়। মাথা নাড়তেই হয়। ব্যতিক্রম নয় এবারও। সামনে নির্বাচন। এর আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের সব চেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন দূর্গাউৎসব। এ নিয়ে হরদম রাজনীতি। হঠাৎ প্রেম বা প্রেম রিমেকের মহড়া।
সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির ফল ভালো হয় না। অন্তত বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশে তা বারবার প্রমাণিত। এরপরও রাজনীতির কাণ্ডারিরা দমেন না। এবার দেবী দূর্গার আগমন ও গমন হবে ‘ঘোটকী’। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবীর এ ধরণের আগমন ও গমনকে চরম অশুভ ভাবে। শঙ্কা করে প্রকৃতি বা মনুষ্য সৃষ্ট দূর্যোগের। তাদের এমন শঙ্কা অন্যদেরও বিশ্বাস করতে হবে-ব্যাপারটি এমন নয়। একটা ভয় যে তাড়না করছে, তা লুকানোও হবে এক ধরনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করা। আর বাস্তবতা অস্বীকার করা প্রকারান্তরে সমস্যাকে জিইয়ে রাখা। প্রয়োজন ও সময়দৃষ্টে আবার টোকা দেয়ার উদ্দেশ্যে সমস্য জিইয়ে রাখার চর্চাও দেশে কম নয়। তাতে কি কারো মুখ একদম আটকে রাখা যায়? পূজা উদযাপন পরিষদ নেতাদের মুখ কি আটকানো গেছে? ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ের সময় ছোট ছোট কিছু কথা বলেছেন তারা। তাদের ছোট কথাগুলোর মাঝে বড় বড় কিছু টোকা ও টিকা রয়েছে। পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যাতে কোনো হামলা না হয়; সে জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন। এসময় পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন, কিছু মানুষ চায় না দেশে হিন্দুরা থাকুক। আওয়ামী লীগেও এমন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে অভিযোগ তার। সাম্প্রদায়িক হামলার পূনরাত্তি যাতে না ঘটে সেই আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনভাবে পূজা উদযাপনে সবার সহায়তাও চান জে এল ভৌমিক। একই দিন প্রায় একই সময়ে কুমিল্লায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভে পুলিশের বাধা। যুবলীগ- ছাত্রলীগের ধাওয়া। কুমিল্লা কান্দিরপাড় পুবালী চত্বর থেকে তারা বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলকারীদের ধাওয়া করে। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। ‘মদমুক্ত দুর্গা পূজা’ নিয়ে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য উল্লেখ করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ।
এ ধরনের ঘটনা ঘটছে কেন? কারা ঘটাচ্ছে? রাজনীতির পণ্য বানাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে কব্জা করে রাখার একটি চর্চা বহুদিনের। আবার তারা তাদের পছন্দের দলের হাতে নিগৃহিত হয়ে কাঁতরালে তৃপ্তি পাওয়ার মহলও আছে। পুরোটাই রাজনৈতিক ব্যাপার। ক’দিন আগে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, কী দেবেন-কী নেবেন এবার আগেই ফয়সালা করতে হবে। আরেক বক্তব্যে বলেছেন, সরকার চাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, না চাইলে হয় না। এ ধরনের কথার পূর্বাপরে ব্যাপক রাজনীতির সঙ্গে তথ্যও কম নয়। সচরাচর নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির মাত্রা বাড়ে বাংলাদেশ এবং ভারতে। এতে কেউ লাভবান, কেউ লোকসানের শিকার হন। হিন্দু বনাম মুসলমানের স্নায়ুবিরোধ বাড়িয়ে মানবতা, সামাজিক স্থিতিশীরতার কতো সর্বনাশ করা হচ্ছে, ধর্মের কতো অমর্যাদা করা হচ্ছে- তা বুঝেও না বোঝার একটি ধারা তো আছেই। নির্বাচন সামনে রেখে সেই ঢোলে আবার বাড়ি দেয়া হচ্ছে।
বিষয়টা ওপেন সিক্রেট। আবার সংখ্যালঘুরা মার খেলে আরো খাক, খেতে থাকুক, তারা তো ওদিকেরই লোক- এমনটি ভেবে বিকৃত স্বস্তি বোধকারীদের মতিগতিও স্পষ্ট। ভোটের আগে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন কাটাতে ক্ষমতাসীনদের তৎপরতা বেশ বেগবান। মেয়াদের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এসব সংগঠনের নেতাদের একটু যত্নআত্তি করা হচ্ছে। পুরোনো প্রতিশ্রুতি, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের অঙ্গীকার তও আছেই। আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি ছিল। ২০১৮ সালে সেই নির্বাচনে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিন্তু প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করেনি তারা। এই অভিযোগ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয় সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলোর ভেতরে, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কের টানাপোড়েনও তৈরি হয়। নির্বাচন সামনে রেখে তারা সেই ক্ষোভ ঝাড়ছে সরকারের ওপর। সরকারও কাছে টানছে। পিঠ বুলাচ্ছে। কোনো ধর্মাবলম্বীদের মাথা গুনে লঘু-গুরু ঠিক করার এই টোকাটুকি আমাদের অনেক সর্বনাশ করেছে। একবার দুবার নয়, বারবার। এবার ধর্মীয় ’সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু’ রেখা টানার পুরানো খেলাটা বেশি আগে শুরু হয়ে গেছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ব্যানারে সংখ্যালঘুদের এ ধরনের প্রশ্নের তীর ছোঁড়া আচানক বা আজগুবি নয়। একদম আকস্মিকও নয়।
এর নেপথ্যে রয়েছে নানা ঘটনা। রাজনীতি বা ভোটের অংক মেলাতে চিকন বুদ্ধিতে সংখ্যালঘুদের ব্যবহারের কাজে আওয়ামী লীগ বরাবরই অপ্রতিদ্বন্দ্বি। একতরফা বেনিফিসিয়ারিও। বছর কয়েক ধরে হেফাজতসহ দক্ষিণপন্থী বা ইসলামি নামধারী সংগঠনগুলোর বেশিরভাগও তাদের কব্জায়। এ বিষয়ক চাপা আলোচনা ও কতক গুঞ্জনের মাঝেই নির্বাচনে সংখ্যালঘুরা ১০০ আসনের ফলাফলে প্রভাব ফেলতে পারে বলে বার্তা দেয়া হয়েছে। আরেক অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল এবং সহযোগী বামপন্থিরা একসঙ্গে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও দেশ কেন এত সাম্প্রদায়িক? সরকারের কাছ থেকে এ প্রশ্নের জবাব আদায় করে ছাড়ার কড়া হুঙ্কারের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের আর রাজনীতির দাবা গুটি না বানানোর আহ্বানও জানানো হয়। খবর ও মন্তব্যগুলো মোটেই শুভ নয়। এরপরও এখন পযন্ত প্রতিবেশি দেশের চেয়ে আমাদের অবস্থান অত্যন্ত ভালো পযায়ে। সেখানকার ক্ষমতাসীন দলের কিছু এজেন্ডার জেরে মনিপুর –আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সহিংসতা চলমান। এ নিয়ে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি-কংগ্রেস পাল্টাপাল্টি দোষারোপ ও নানা তিক্ত কথা। এর গোটা রসদই লুকানো ক্ষমতার রাজনীতির পেটে। এ নিয়ে সাতচল্লিশে দেশভাগের মর্মন্তুদ বেদনা নিয়ে লেখা উর্দুভাষী ঔপন্যাসিক কৃষণ চন্দরের দাঙ্গার গল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’র ভূমিকায় উর্দু কবি আলি সরদার জাফরির লেখা বড় প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিকও। জাফরির লেখার কয়েকটি লাইন এমন- ‘ভারত ও পাকিস্তানে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এই আগুনের লেলিহান শিখায় মানুষ, ঘরবাড়ি আর পাঠাগারের পাশাপাশি আমাদের জীবন, স্বাধীনতা, সভ্যতা এবং কৃষ্টি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কয়েক মাসের ব্যবধানে এর তীব্রতা কিছুটা কমলেও এখনো সম্পূর্ণ কমেনি। ছাইয়ের নিচে আগুন এখনো চাপা পড়ে আছে, যা একটু ফুঁ দিলেই আবার জ্বলে উঠতে পারে। এই ছাইয়ে বাতাস দেওয়ার লোকেরও অভাব নেই।’
‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’-এ ভারত-পাকিস্তানের কথা এসেছে। তখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। আজকের প্রেক্ষাপটে যা ভারত-বাংলাদেশ। দেশ দুটিতে ধর্মীয় রাজনীতির রূপ-বৈশিষ্ট্য প্রায় কাছাকাছি। যার যার সুবিধা মতো সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু দলকে কাজে লাগানোর নোংরামি সাতচল্লিশের চেয়ে এখন বরং আরো বেশি। কেবল ধরন পাল্টেছে মাত্র। কক্সবাজারের রামুতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে, সুনামগঞ্জের শাল্লা বা রংপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের নানান জায়গায় কোরআন পোড়ানো, মন্দিরে হামলা ইত্যাদি ঘটনা রাজনীতির ফায়দা উশুলে সময়োপযোগী এক কদাকার স্মাটর্নেস। ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেলে কয়েকদিন হম্বিতম্বি, এরপর সব স্বাভাবিক। হোতাদের কিছু হয় না। সাধারণ মানুষ ভুলেও যায়। দগদগে ঘায়ের মতো ভোগে শুধু আক্রান্তরা। এগুলো মোটেই সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর চশমা দিয়ে দেখার বিষয় নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই
টপ নিউজ ধর্মতে সংখ্যার লঘু-গুরু আর কতো? মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল