মরছে নদী, কাঁদছে দেশ
শফিকুল ইসলাম খোকন
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৪
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৪
সম্প্রতি একটি বিষয় আমার কাছে খুব আশ্চর্য মনে হচ্ছে সেটি হল- দেশের সকল বিষয়ই প্রধানমন্ত্রীর দেখতে হয়, তার নির্দেশনা ছাড়া যেন কোনো কিছুই হয় না! কেন যেন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। বিষয়টি আমার কাছে কেমন যেন মনে হয়। প্রশ্ন জাগে, সবকিছুর ক্ষেত্রে যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে কাজ করতে হয় তাহলে এত মন্ত্রী, দপ্তর, সচিব কেন? আমার মনে হয় এ প্রশ্ন শুধু যে আমার তা নয়। হয়তো এ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে আমার প্রশ্নকর্তার পাল্লাই ভারি হবে। কোনও একটি ঘটনা ঘটল, সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ মূলধারার গণমাধ্যমে আলোচনায় আসার পর টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী থেকে শুরু করে আমলা জানলে যে হবে না। সম্প্রতি এমন চিত্রের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার। তারা হয়তো বিষয়টি গা-ই করলেন না। কিন্তু যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে এলো, তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দিলেন, সবার মধ্যে শুরু হয়ে গেল দৌড়ঝাঁপ। সমাধানও হয়ে গেল এক নিমিষে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমসাময়িক নির্দেশনা নাই-বা টানলাম। সাম্প্রতিক সময় নদী-খাল নিয়ে এ সরকারের কঠোর অবস্থান পরিষ্কার। ঢাকার সদরঘাটসহ আশপাশের নদীর পাশে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমেই তা আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। সরকারের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তৃণমুলে দেখা যায়নি তেমন কোনও পদক্ষেপ। নদী ও খাল-বিল ও সাগরের জোয়ারভাটার পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে পানির প্রবাহে বাধা সৃষ্টিকারী সব ধরনের স্থাপনা অবিলম্বে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের সব জেলা প্রশাসককে জরুরি ভিত্তিতে এ বিষয়ে লিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে জোয়ার ভাটার পানিও যেন বাধাহীনভাবে ওঠানামা করতে পারে সে বিষয়টি বাস্তবায়নেরও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, গুজব, খাদ্যে ভেজাল, সামাজিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, জনগণকে সরকারি সেবা প্রধান, খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৫ দফার মধ্যে ১৯ দফায় সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ, ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণকে প্রাধান্য এবং ২০ নং দফায় নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বাড়াতে হবে। স্লুইচগেইট বা অন্য কোনো কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এ রকমের অনেক নির্দেশনাই রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। শুধু দেশের নদী, খাল ও জলাশয় নিয়ে ২০২০ সালেও প্রমানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে কতটুকু? আবারও ২০২৩ সালে এসেও একই নির্দেশনা দিতে হল তার।
নদীমাতৃক দেশে নদীই আমাদের ভরসা। নদী আমাদের হৃদপিন্ড, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশ সুরক্ষা হবে না এমনকি টেকসই উন্নয়নও করা সম্ভব নয়। নদীগুলো এত গুরুত্বপুর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কারও কোন ভূমিকা বা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত ‘রামসার কনভেনশন ১৯৭১’ এবং ‘রিও কনভেনশন ১৯৯২’ স্বাক্ষর করায় ভূমি ও জলজ পরিবেশ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই কনভেনশন দু’টির প্রথমটি জলজ পাখির আবাস সংরক্ষণ সংক্রান্ত, যা নদী ও জলাভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষার লক্ষ্যে অতি প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়টি ভূমি ও জলের সকল প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত, যা একই লক্ষ্যে অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টাঙ্গুয়ার হাওর ও সুন্দরবন এলাকা ‘রামসার সাইট’ হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হাকালুকি হাওর এবং সুন্দরবনকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ ঘোষণা করায় ওই দুই এলাকার নদী ও জলাভূমিসমূহ সংরক্ষণের বেলায় সরকারি দায়বদ্ধতা রয়েছে। কিন্তু এখনই আমাদের দেশের আরও অনেক জলাভূমি ‘রামসার সাইট’ হিসেবে এবং ‘পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
সারাদেশেই আগ্রাসী থাবায় নদী আজ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, সর্বশান্ত। যে কোনও নদীর পাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির পরিমাণটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক নদ‐নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন। অনেক নদীকে আর বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ‐নদীর মধ্যে প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে। ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে হয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটারের মতো। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। গবেষণায় যেসব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালি, কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর, রাজখালি খাল। আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বরিশাল কীর্তনখোলা, বরগুনার খাকদোন নদীও দিন দিন মরে যাচ্ছে। নদীগুলো যে দখলই হচ্ছে তা নয়, শিল্পবর্জ্যের ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়।
সবশেষ দেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। প্রায় চার বছর কাজ শেষে গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নদী গবেষকরা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি অন্যান্য সংস্থার প্রকাশিত নদ-নদীর তথ্যের সঙ্গেও এনআরসিসির খসড়ার তথ্য মিলছে না। নদী রক্ষা কমিশনের প্রস্তুত করা খসড়া তালিকার তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি নদ-নদী সিলেট বিভাগে। এ বিভাগের চারটি জেলায় নদীর সংখ্যা ১৫৭। সবচেয়ে কম নদী চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগে নদীর সংখ্যা ৬২। নদ-নদীর সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে ময়মনসিংহ ও খুলনা বিভাগ। এ দুই বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ১৪৫ ও ১২৭। এরপর নদ-নদীর সংখ্যা বেশি ঢাকা বিভাগে, ১২৫টি। তারপর রংপুর বিভাগে ১১৯টি। বরিশাল ও রাজশাহী বিভাগে নদ-নদীর সংখ্যা যথাক্রমে ১০০ ও ৭২। তবে এ তালিকায় প্রকাশিত নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে আপত্তি রয়েছে নদী গবেষকদের। তারা বলছেন, দেশে নদ-নদী রয়েছে দেড় হাজারের বেশি। কিন্তু এনআরসিসির তালিকায় তা নেমে এসেছে হাজারেরও নিচে। আবার সরকারি অন্যান্য তালিকার সঙ্গেও এটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন অসামঞ্জস্য নিয়ে এটি প্রকাশিত হলে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে জটিলতা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আলোচিত এই তালিকায় অসামঞ্জস্যের বিষয়টি স্বীকার করছেন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও। এনআরসিসির খসড়া তালিকায় অসংগতি থাকা অস্বাভাবিক নয় উল্লেখ করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘দেশে নদ-নদীর সংখ্যা এর চেয়েও অনেক বেশি হবে। নদী রক্ষা কমিশনের গবেষণাকাজের এরিয়া হয়তো এ নদ-নদীগুলো নিয়ে ছিল। নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডে সংরক্ষিত আছে। আমরা ভিন্ন একটি প্রজেক্ট নিয়েছি সারা দেশের নদ-নদী উদ্ধার ও নাব্যতা নিয়ে। এ কাজ সমাপ্ত হলে আমরা নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা পেয়ে যাব।’ (সূত্র: বণিক বার্তা,তারিখঃ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩)। ওই প্রতিবেদনে সচিব বলেন ‘অবশ্যই দেশে নদ-নদীর সংখ্যা আরও বেশি হবে। শুধু সুন্দরবনেই নদী আছে ২১৮টি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় কয়টা নদী আছে তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। এ সংখ্যা নদীর প্রকৃত সংখ্যা নাও হতে পারে। আমরা বাংলাদেশের পুরনোসহ সবগুলো নদী ম্যাপ ধরে উদ্ধারের কাজ শুরু করেছি। এটা আমরা করব মৌজা ম্যাপ ধরে।’ নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বক্তব্যে সুন্দরবনে ২১৮টি নদীর কথা বলা হলেও এনআরসিসির খসড়া তালিকায় পুরো খুলনা বিভাগেই নদী দেখানো হয়েছে ১২৭টি।
এদিকে দেশে ৪০৫টি নদ-নদী নিয়ে ২০১১ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ নিয়ে ছয় খণ্ডের বইও প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। ওই ৪০৫ নদ-নদীর মধ্যে ১৩৯টিই এনআরসিসির খসড়া থেকে বাদ পড়েছে। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ওই সিরিজের সঙ্গে এনআরসিসির খসড়া তালিকার নদ-নদীর তথ্যে ব্যাপক গরমিল আছে বলে দাবি করেছে নদীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, পাউবোর সমীক্ষার অন্তত ১৩৯টি নদীর নাম এনআরসিসির খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের আমরি, ইসদার, উমিয়াম, কর্ণঝরা, কর্ণবালজা, কাঁচামাটিয়াসহ ২৭টি নদীর নাম তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি। একইভাবে রাজশাহী বিভাগের ১৬টি, রংপুরের ১০, ময়মনসিংহের ২৭, বরিশালের সাত, ঢাকার ৩০, চট্টগ্রামের ১২ ও খুলনা বিভাগের ১০টি নদী তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি।
উপরোক্ত তথ্যে খুবই সহজেই অনুমেয় কিত হচ্ছে দেশ নিয়ে, নদী নিয়ে। আসলেই কি দেশ সুরক্ষা এবং দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করা হচ্ছে? টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। গবেষণায় জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে ৬৮ বিলিয়ন টন। ২০৫০ সালে ব্যবহৃত হবে ১৪০ বিলিয়ন টন, যা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করবে। মানুষের কারণে ২০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ৩০ শতাংশ বনভূমি এবং ১০ শতাংশ চারণভূমি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে আবাসন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলো দখলে বিপর্যস্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে।
নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। টেকসই উন্নয়ন ও নদী রক্ষায় সবাইকে নিয়েই সামনে এগোতে হবে। নদীর ব্যবহার এখন বহুমাত্রিক। মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর কাছেই গড়ে উঠেছে বড় বড় কল-কারখানা, নদীতে এখন হাজার হাজার লঞ্চ-স্টিমার। নদীতে শত শত বাঁধ। নদী দখল, নদী দুষণসহ যখন যেভাবে প্রয়োজন তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। তাদের কাজ কি? তারা আসলে কি করে? নদী ভরাট ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করা, নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজ করে এ কমিটি। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। ডিসিদেরও সরকারসহ উচ্চাদালত থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তাদের নীরব ভূমিকা দেখা গেছে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। তেমনি এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। দেশের নদী রক্ষা, জলালয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা মানছেন না। আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলী-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর।
আমাদের বাংলাদেশ হল নদীমাতৃক দেশ। এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশট হল নদী বেষ্টিত। নদী ও জলাশয়ে রয়েছে অনেক সম্পদ। কথায় বলে, পরিবেশ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ উদ্যোগে, নিজের স্বার্থে নদীকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না। পরিবেশকে বিবেচনায় না রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরিবেশ আর উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশকে রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। এজন্য শুধু সরকার বা বিভিন্ন সংস্থাকে কাজ করলে চলবে না, সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করত হবে। পরিবেশ বাঁচিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্ভব করতে হবে।
পরিবেশে বলতে চাই, মানুষের হৃদপিন্ড না থাকলে বাঁচবে না, তেমনি নদী না থাকলে দেশও বাঁচানো সম্ভব নয়; যেভাবে নদী মরছে, আর যেভাবে নদীগুলো কাঁদছে, তাতে একদিন নদীবিহীন হয়ে যাবে দেশ। একটি দেশকে বাঁচাতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন করতে হলে নদীগুলো সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও জরুরী। দেশ রক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে মুক্তির জন্য নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া খুব জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই