হঠাৎ করেই তামিমের বিদায় ঘোষণা: কেন?
৬ জুলাই ২০২৩ ১৯:১৪ | আপডেট: ৬ জুলাই ২০২৩ ১৯:৪৭
একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ব্যক্তিগতভাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি এই বিদায়ের ঘোষণা দেন। সংবাদ সম্মেলনে তার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য ব্যাথিত করেছে দেশের লক্ষ লক্ষ ক্রিকেটপ্রেমীকে। সামনে এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ। এই দুই আসরে বাংলাদেশ দলের ভাল করার স্বপ্ন দেখছেন ক্রিকেটারদের সঙ্গে দেশবাসীও। আর সেই স্বপ্ন জয়ের যুদ্ধে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল সেনাপতি তামিম ইকবালের। কিন্তু হঠাৎ করেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন তিনি।
কিন্তু এখনই কেন বিদায়? এর উত্তর খোলাসা করেন নি তামিম। বলেছেন হুট করে তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন নি। কয়েকদিন থেকেই ভাবছিলেন। পরিবারের সঙ্গেও এ নিয়ে কথা হয়েছে। প্রথম ম্যাচের পরে মনে হয়েছে বিদায় জানানোর সময় হয়েছে। তাই বিদায় বলেছেন। আসলেই কি তাই। এই তো প্রথম ম্যাচের আগেই বলেছিলেন তিনি ঠিক ফিট নন তবুও ম্যাচ খেলবেন। ইনজুরির কারণে কদিন আগে মিস করেছেন আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচ। সেই ম্যাচের সময়ও তিনি ফিটনেস ট্রেনিং করেছেন। নেট প্র্যাকটিস করেছেন। মাঠে ফিরে আসার এমন আকুতি যার তিনি কি করে এভাবে সরে যেতে পারেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। অঝোর কান্নায় বেদনার আবহ ছড়িয়ে জাতীয় দল থেকে বিদায়ের ঘোষণা দেন?
দীর্ঘ ১৬ বছর জাতীয় দলকে সার্ভিস দিয়েছেন। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি, টেস্ট সব ফরম্যাটেই জ্বলজ্বলে পারফরমেন্স তার। একটি পর্যায় থেকে আজকের যে পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্তরণ তার এক বীর সেনানী তামিম ইকবাল। হ্যাঁ, সাম্প্রতিক সময় তার খুব ভাল যাচ্ছিল না। ব্যাটে রানের খরা ছিল। উইকেটে ব্যাট হাতে সেই তামিমকে দেখতে পাচ্ছিলেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। ইনজুরি পিছু লেগে ছিল। বার বার ফর্মে ফেরার চেষ্টা করেও ফিরতে পারছিলেন না। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা ছিল। অনেক ক্রিকেট সাংবাদিকও তার তীব্র সমালোচনায় মুখর ছিলেন। এ জন্যই বোধহয় বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে তামিম সাংবাদিকদের বলেছেন— এত বছর জাতীয় দলে খেলেছেন। তার বিদায়ের সিদ্ধান্তটাকে যেন তারা সম্মান জানান। বলেছেন— আগামীতে যারা ক্রিকেট খেলবেন তাদের ভালমন্দের আলোচনা-সমালোচনা সাংবাদিকরা করবেন। খারাপ খেললে খারাপ বলবেন তবে সেটি যেন হয় ক্রিকেটের সীমানার মধ্যেই। অনেক সময় বাউন্ডারী ক্রস করে ফেলা হয়। বললেন— টিমকে সাপোর্ট করতে, সেটিই মুখ্য ব্যাপার।
তামিম জানালেন, ‘সারা জীবন ক্রিকেটের প্রতি, দায়িত্বের প্রতি সৎ ছিলেন তিনি’। এ নিয়ে বোধহয় কারোরই প্রশ্ন নেই। বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে একহাতে ব্যাট করার সেই ঘটনাই তো দেশের জন্য, দলের জন্য তার নিবেদনের বড় প্রমাণ। আসন্ন বিশ্বকাপ নিয়ে তিনি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। মাশরাফিকে মেন্টর হিসেবে সাথী করে দলের জন্য বড় লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। সেই তামিম হুট করে বিশ্বকাপের আগে সরে গেলেন দল থেকে!
নেপথ্যের কারণগুলো বলতে চান নি। কিন্তু দুয়ে দুয়ে চার তো মিলেই যায়। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচের আগে তিনি যা বলেছিলেন তা নিয়ে বোর্ড প্রেসিডেন্ট একটি মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা আত্মমর্যাদাবান কোন তারকার পক্ষে হজম করা কঠিন। প্রকাশ্যে এমন প্রতিক্রিয়া জানানো দলের অধিনায়ককেই অপমান করার শামিল। ভেতরের খবর — এমন অযাচিত আচরণ, চাপ নাকি হরহামেশাই সইতে হয় দলের অধিনায়ক ও সিনিয়র খেলোয়াড়দের। মিডিয়ায়তো এসব খবর প্রায়ই চাউড় হয়। এ জন্যই বোধহয় মাশরাফি-রিয়াদের মতো তামিমও হুট করে সরে দাঁড়িয়ে বিরুদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তির পথ খুঁজলেন?
এমন বাজে সংস্কৃতি আমাদের ক্রিকেটে কেন তৈরি হলো? আমরা কেন আমাদের ক্রিকেট তারকাদের সম্মানের সঙ্গে বিদায় দিতে পারিনা? ১৫-১৬-১৮ বছর যারা দেশের জন্য, জাতীয় দলের জন্য নিজেদের তারুণ্য-যৌবন উৎসর্গ করেছেন তাদের কেন ব্যাথায়-বেদনায় বিদায় নিতে হয়? নিজেদের বিদায়ের কথা মিডিয়ায় নিজেদের জানাতে হয়? বোর্ড কেন আগে জানতে পারে না? খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোর্ড কর্তাদের এমন তিক্ত সম্পর্ক কেন, যে ক্রিকেটাররা বোর্ড কর্তাদের বিদায়ের কথা না জানিয়ে মিডিয়াকে জানান?
দেশের ক্রিকেটকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নড়বড়ে অবস্থা থেকে সবল পায়ের শক্তভিতে দাঁড়করানোর নায়ক যে পঞ্চপান্ডব। তাদের তিন জন এরই মধ্যে বিদায় নিয়েছেন। তিনজনের বিদায়ের চিত্রনাট্যটি একই। বোর্ডের একাংশের নেপথ্য সমালোচনা, নেতিবাচক আলোচনা, সরিয়ে দেয়ার জন্য কলকাঠি নাড়াচাড়া এবং কর্তাদের শীতল অবহেলা, উপেক্ষা সেই সঙ্গে কোচের ভুমিকায় অধিনায়ক কিংবা সিনিয়র ক্রিকেটাররা বুঝে যান সরিয়ে দেয়ার আগে দল থেকে সরে পড়াই ভালো। মাশরাফি, রিয়াদ যা করেছেন সেই পথেই হাঁটলেন তামিমও। বাকী মুশফিক, সাকিব এবং টেস্ট তারকা মুমিনুল। এ তিনজনই তাদের পারফরমেন্সের কারণে লড়াই করেও টিকে আছেন।
কাকতালীয়ভাবে দীর্ঘদিন দলকে সার্ভিস দেয়া তারকাদের অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে বিদায় নিতে হচ্ছে কোচ হাথুরেসিংহের সময়ে। জিম্বাবুয়ে, শ্রীলংকা, বাংলাদেশে প্রথম পর্বে হাথুরের সময়ে বার বার অধিনায়কদের, সিনিয়র খেলোয়াড়দের অনাকাংখিত বিদায়ের বিব্রতকর ঘটনা ঘটেছে। এবারও ঘটল। এটি কি আমাদের ক্রিকেটের জন্য ভাল হলো? একজন সফল অভিভাবক হলে তো সিনিয়রদের সঙ্গে বিবাদের কোন কারণ ঘটার কথা নয়। তামিম ফিট নন তাকে বুঝিয়ে বিশ্রামে রেখে বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুত করার দায়িত্ব ছিল হাথুরের। তা না করে তিনি বিচার দিয়েছেন বোর্ড প্রেসিডেন্টের কাছে। বোর্ড প্রেসিডেন্ট ঢাকঢোল বাজিয়ে মিডিয়ায় নিজের ক্ষোভ ঝেড়েছেন সেই সঙ্গে জানিয়েছেন অধিনায়কের ব্যাপারে কোচের অসন্তুষ্ঠির কথা। একজন অধিনায়ক যখন কোচের কাজে কর্মে বা আচরণে বুঝতে পারেন যে বস তাকে পছন্দ করছেন না। দলে না রাখতেই তার ইচ্ছে তখন তো সম্মানজনক সিদ্ধান্ত বিদায় বলে দেয়া। তামিম তাই করেছেন। কিন্তু আসন্ন এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপের আগে এমন পরিস্থিতি দলের জন্য কি ভাল হল? আফগানিস্তানের সঙ্গে প্রথম ম্যাচই তার প্রমাণ।
এটা তো নিয়তিরই বিধান এক সময় সবাইকেই বিদায় নিতে হয় । সব তারকার জীবনেই তা ঘটে। কিন্তু ঠিক কোন সময়ে বিদায়ের সিদ্ধান্তটি নেয়া উচিত তা অনেক তারকাই বুঝতে পারেন না। আবার তারকাদের বর্নিল বিদায়ের পরিবেশ তৈরি ও আয়োজনের দায়িত্বটি অভিভাবকদের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তা হচ্ছে না। আমাদের তারকাদের বিদায় নিতে হচ্ছে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ক্ষোভ বেদনার মধ্য দিয়ে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, ক্রীড়া বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এএসজি
টপ নিউজ মত-দ্বিমত মাহমুদুল হাসান শামীম হঠাৎ করেই তামিমের বিদায় ঘোষণা: কেন?