Friday 03 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিদ্যুতের ঝলমলে আলোয় রিজভীর হারিকেন মিছিল এবং অভ্যস্ততার গল্প

আসাদ জামান
৯ জুন ২০২৩ ১৯:৪৬ | আপডেট: ১০ জুন ২০২৩ ১৭:৪৭

আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের গেটে এক লোক ভিক্ষা করেন। এটা তার পার্মানেন্ট জায়গা। ভিক্ষার চিরায়ত ‘পুঁজি’ নির্বাচিত কিছু শব্দমালা উচ্চারণের মাধ্যমে সকাল থেকে রাত অব্দি মানুষের হৃদকোমলে আঘাতের পর আঘাত হেনে নিজের ‘আসল ব্যবসার পুঁজি’ গুছিয়ে নিয়ে ঘরে ফেরেন তিনি। ঝর-বৃষ্টি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক যাই আসুক, এখানে তার আগমন নিত্যদিন। মাঝে-মধ্যে মহিলা ভিক্ষুকদের সঙ্গে তার রসালাপ দৃষ্টিগোচর হয়, শ্রুতিগোচর হয় না!

বিজ্ঞাপন

দিন কয়েক আগে মসজিদ গেট পার হওয়ার সময় ভিক্ষুক মহাশয়কে উত্তেজিত মনে হল। এক মহিলা ভিক্ষুকের সঙ্গে কী নিয়ে যেন উচ্চস্বরে কথা বলছেন তিনি। মনে হল- ঝগড়া করছেন! দূরত্ব আরেকটু কমে এলে বোঝা গেল, এটা ঝগড়া নয়— ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া!

সারাদিন ধুলা-বালি, রোদ-বৃষ্টির মধ্যে নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে মধ্যরাতে বাসায় ফেরার পর ভিক্ষুক মহাশয় যে আরামের ঘুমটা দিতেন, ইদানিং সেটা ব্যহত হচ্ছে। লোডশেডিংয়ে আরামের ঘুম হারাম হয়ে গেছে তার! তাই সকাল বেলা ভিক্ষা করতে এসে সহকর্মী মহিলা ভিক্ষুকের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলছেন— ‘ধ্যাত! এভাবে থাকা যায়? রাতে তিন/চারবার কারেন্ট গেছে! এট্টু ঘুমাতে পারি নাই।’

গল্পটা এখানেই শেষ হতে পারত। তবে এটাকে টেনে আরেকটু বড় করার অবকাশ রয়েছে বৈকি! একজন ভিক্ষুক চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। রাতে দুয়েক ঘণ্টা লোডশেডিং নিতে পারছেন না তিনি। যদিও তার এই কষ্ট সাময়িক। ঘোষণা আসছে, সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু কবে ঠিক হবে? ঠিক কি এমনি এমনিই হবে? এর জন্য তো আন্দোলন প্রয়োজন!

কিন্তু আন্দোলন করতে গেলে তো জায়গা হারাতে হবে। ভিক্ষার জন্য ছাপড়া মসজিদের উত্তর গেট দারুণ একটা জায়গা। প্রার্থনা শেষে বেশিরভাগ লোক এ গেট দিয়ে কলোনিতে ঢোকে। দশ জনের কাছে হাত পাতলে অন্তত দুই জনের কাছে ভিক্ষা মেলে। এমন সুবিধাজনক জায়গা ছেড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে গেলে নির্ঘাত জায়গাটা হারাতে হবে! তাহলে আন্দোলনটা করবে কে?

ঘটনার ১২ ঘণ্টা পরই এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল! ‘গণমানুষের দল’ বিএনপির সবচেয়ে সক্রিয় নেতা রুহুল কবির রিজভী সন্ধ্যার পর পার্পেল কালারের ব্রান্ডনিউ হারিকেন হাতে মিছিলে নেমে পড়লেন। লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে তার এই ঝঁটিকা হারিকেন মিছিলে ব্লু ও গ্রিন কালের আরও অসংখ্য ব্রান্ডনিউ হারিকেন চিত্তকর্ষক পরিবেশ তৈরি করে। পার্পেল কালারের হারিকেন হাতে বিএনপির আরেক সক্রিয় নেতা ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নিপুণ রায় চৌধুরীর উপস্থিতি মিছিলের শোভা অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়।

বিজ্ঞাপন

দাবি আদায়ে এই নান্দনিক প্রতিবাদ আরও চিত্তকর্ষক হতে পারত। কিন্তু বাধ সাধল দৈত্যাকৃতির সড়ক বাতি। একটা নয়, দুইটি নয়, শত শত সড়ক বাতির ঝলমলে আলো রিজভী এবং নিপুণের ব্রান্ডনিউ হারিকেনের আলোকে ম্ল্যান করে দেয়। ‘বিদ্যুতের মহাসংকটকালে’ নয়াপল্টনের পুরো এলাকায় জুড়ে তখন ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা/ আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা/ নাচে আলো নাচে, ও ভাই, আমার প্রাণের কাছে/ বাজে আলো বাজে, ও ভাই হৃদয়বীণার মাঝে/ জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা/ আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা’ অবস্থা!

১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথম বারের মতো ঢাকায় বিদ্যুৎ বাতি জ্বলার ১২২ বছর পর রিজভীর হারিকেন মিছিলের দিনই বোধ হয় নয়াপল্টনে বিদ্যুতের ঝলকানি সবচেয়ে বেশি ছিল। ক্রিকেট স্টেডিয়ামে রাতের বেলায় আন্তর্জাতিক ম্যাচ চলকালে খেলোয়াড়দের ঘর্মাক্ত শরীর থেকে টুস করে পড়া ঘামের ফোটা যেমন দূর থেকে দেখা যায়, ঠিক তেমনি রুহুল কবির রিজভীর পার্পেল কালারের হারিকেন, ম্যাচিং করা পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা, গ্রে কালারের চপ্পল এমনকি তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা টিস্যুর ছিন্নাংশ পর্যন্ত দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল। এমন আলোর বন্যায় ভেসে কয়েক শ’ লোক এবং বাজার থেকে কিনে আনা কয়েক ডজন নতুন হারিকেন নিয়ে রিজভীর লোডশেডিংবিরোধী মিছিল রীতিমতো নেট দুনিয়ায় ভাইরাল।

তবে নেটিজেনদের বোঝা উচিত, এতে রুহুল কবির রিজভীর কোনো দোষ নেই। তিনি হয়তো কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিলেন! লোডশেডিং শুরু হলেই হারিকেন নিয়ে নেমে পড়বেন। কিন্তু বেরসিক বিদ্যুৎ বিভাগ নয়াপল্টনের সড়ক বাতিগুলো জ্বালিয়েই রাখল। আশপাশের ভবনগুলোতেও মিনিট দশেকের জন্য লোডশেডিং দিতে পারল না তারা। কারণ, ওই রাতে ১৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৩৮৯ মেগাওয়াট। সুতরাং লোডশেডিংয়ের জন্য সারা রাত অপেক্ষা করলেও রিজভীর হারিকেন মিছিল সড়ক বাতির ঝলমলে আলোতেই করতে হতো। কী আর করার? অগত্যা বিদ্যুতের ঝলমলে আলোতেই বিদ্যুৎ চেয়ে হারিকেন মিছিল করতে হল রুহুল কবির রিজভীকে!

গল্পটা শুরু হয়েছিল আজিমপুর থেকে। শেষ করতে হচ্ছে নয়াপল্টনে। তার আগে ছোট্ট করে বিদ্যুতের ইতিহাসটা বলা যেতে পারে। ১৯৯১-১৯৯৬ বিএনপি আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬০০ মেগাওয়াট, ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ আমলে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮০৩ মেগাওয়াটে। ২০০১- ২০০৬ বিএনপি আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ৩২৬৮ মেগাওয়াটে। বর্তমান আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫,০০০ মেগাওয়াট স্পর্শ করে।

ফলে, চাহিদার শতভাগ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করা বাংলাদেশে একজন ভিক্ষুকও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সে চব্বিশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ চায়। না পেলে তার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। অপরদিকে রিজভীও চায় ‘সাময়িক সংকট’-কে ইস্যু করে কিছু একটা করে দেখাতে। কিন্তু ভুল সময়, ভুল জায়গায়, ভুল মানুষের উপস্থিতি সব গল্পকেই বদলে দেয়! গল্পের পেছনের গল্পটা তখন সড়ক বাতি হয়ে জ্বলতে থাকে।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এজেডএস

আসাদ জামান টপ নিউজ রিজভীর হারিকেন মিছিল

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর