স্নায়ুযুদ্ধ: নিরপেক্ষতার খেল খতম
২ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:০২ | আপডেট: ২ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:২৩
কোনোদিকে না হেলে চুপ মেরে থাকবেন? নিরপেক্ষ থাকবেন বা নিরপেক্ষতার ভান করবেন? এক নৌকাতেই পা রাখবেন অথবা সবার সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতবেন? সেই দিন আপাতত শেষ। বৈশ্বিক মহামারি করোনা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বমন্দা সর্বোপরি স্নায়ুযুদ্ধ সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। সব উথাল-পাতাল করে পাল্টে দিয়েছে শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞাও। কে কার বন্ধু, কে শত্রু- তা নির্ধারণের আদি সূচকের খোলনলচে পাল্টে গেছে। বদলে যাওয়ার এ জার্নিতে যে আগে উঠছে সে-ই প্রাপ্তিতে এগিয়ে।
স্নায়ুযুদ্ধ পরাশক্তিগুলোর গোপনীয়তাও কমিয়ে দিয়েছে। যার যার ঘোষণা ও সিদ্ধান্তও প্রকাশ্য। রাখঢাক নেই। ড্যামকেয়ার ভাব। পশ্চিমা ‘আধিপত্য’ রুখে চীন ও ভারতকে একান্ত করে পেতে নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে সই করে ফেলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। ৪২ পৃষ্ঠার সেই নথি এখন ওপেন সিক্রেট। এরইমধ্যে মস্কো তার ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় বাজার থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে চীন এবং ভারত উভয়ের কাছে জ্বালানি সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়েছে। তার ঘোরতোর প্রতিপক্ষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কথা-কাজও টনটনে। নিজের বুঝ থেকে নড়ছেন না একটু্ও। যার নমুনা দেখালেন ২৯-৩০ মার্চ তার ডাকা দ্বিতীয় ‘গণতন্ত্র সম্মেলনেও। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এ সম্মেলনের সহআয়োজক ছিল কোস্টারিকা, নেদারল্যান্ডস, জাম্বিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। সম্মেলনের প্রথম পর্ব ভার্চুয়ালে যার যার দেশে বসেই বিশ্বনেতারা আলোচনায় বসেছিলেন। দ্বিতীয় পর্বে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সহআয়োজক দেশে সশরীর ও ভার্চ্যুয়াল অংশগ্রহণের মাধ্যমে আলোচনা করেন।
বিশ্বনেতারা ছাড়াও সুশীল সমাজ ও ব্যক্তিখাতের প্রতিনিধিরাও এতে অংশ নেন। তার এ গণতন্ত্র সম্মেলন শেষ হতে না হতেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা ‘আধিপত্য’ হ্রাস করার লক্ষ্যে ৪২ পৃষ্ঠার রূপরেখা। এখন একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আরেকদিকে রাশিয়া। সক্ষমতার প্রশ্নে চীন-ভারত বড় ফ্যাক্টর। এরপরও তারা একা নয়, কারও না কারও সঙ্গে যুথবদ্ধ। আমতা-আমতা পর্যায়ে নেই। আন্তর্জাতিক পরিসরে চীন ও রাশিয়া এখন আর আমেরিকার আধিপত্য মানতে চাইছে না। তারা নিজেদের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ রক্ষায় সামরিক সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন এবং চীনের ক্ষেত্রে বিরোধীয় দক্ষিণ চীন সাগর এলাকায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে পাত্তা না দেওয়ার পাকা সিদ্ধান্ত তাদের। এ ক্ষেত্রে কোনো লুকোচুরি নেই। কথা ও কাজ একদম পরিস্কার। যদি, তবে, কিন্তু- ধরনের শব্দ নেই।
বিগত স্নায়ুযুদ্ধের চরিত্র এমন ছিল না। তখন রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল ‘সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ’ শ্লোগানে। গরীব ধনী প্রায় সকল দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্র রপ্তানির চেষ্টা করেছে। কম-বেশি সফলও হয়েছে। যার জেরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একই ধাঁচে মার্ক্স, লেনিনের আদর্শ এবং মাও সেতুং এর চিন্তাধারা প্রচার করে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের উজ্জীবত করতে মাঠে নেমেছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে পুঁজিপতি বিশ্বের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীন সম্পর্ক স্থাপন করে বিশ্ব ব্যবস্থা পাল্টে দেয়। আবার চীনের নিজ দেশে চালু হয়ে যায় দুই ব্যবস্থা। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা শেষে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে হংকংয়ের নিয়ন্ত্রণ পায় চীন। হংকং পরিচালনায় ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি প্রণয়ন করা হয় ।
শুধু হংকং নয়। চীনের অভ্যন্তরে মানুষের জীবন যাত্রায় পশ্চিমের ছোঁয়া লাগানোর জন্যও বিভিন্ন নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে যাকে এক দেশ, দুই ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। কিন্তু সবকিছুই সেখানে নিয়ন্ত্রিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে। চীনে মার্ক্স ও লেনিনের আদর্শের বিস্তারের বিপরীতে রাশিয়া চক্কর খায় নানা ঢালে। সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, ধনতন্ত্র সবচর্চাই করতে থাকে। ২০১৬ সালের পররাষ্ট্রনীতিতে আবার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াই, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার, বৈশ্বিক অঙ্গনে রাশিয়ার উপস্থিতি এবং রুশ জাতির সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিশেষ মিশন। পরাশক্তিগুলোর এমন দিনবদল, মনবদল দুনিয়ার কোনো দেশকে আর নিরপেক্ষ থাকার রাস্তা রাখেনি। তাদের যেকোনো একদিকে যেতেই হবে। একাধিক নৌকা থেকে পা সরাতেই হবে।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য তা খোলামেলা ঘোষণা করে রেখেছে আরও আগেই। ৯/১১ এ হামলা হওয়ার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন- আপনি হয় আমাদের সাথে, না হয় সন্ত্রাসীদের সাথে থাকবেন। এই ঘটনার ২২/২৩ বছর পর এসে সেই দম্ভ রাশিয়ারও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বিরোধীতা করবে সে গিয়ে উপস্থিত হবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টে এবং চীনের প্রেসিডেন্টের ডেরায়। আর রাশিয়া ও চীনের প্রেসিডেন্টে যাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে সে গিয়ে উপস্থিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের দুয়ারে।
শান্তির দেশ ফিনল্যান্ড এতদিন বিশ্বমঞ্চে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিল। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ হামলার পর নিরপেক্ষতার তকমা বাদ দিয়ে রাশিয়ার ভয়ে ন্যাটো জোটমুখী। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যে নিরপেক্ষ থাকা যায় না তা আবারও প্রমাণ করলো ফিনল্যান্ড। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলি অরক্ষিত বোধ করছে। ফিনল্যান্ডের জনমতও আমূল বদলে গেছে। দেশটির জনগণ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার ভাল সুযোগ রয়েছে। দোদুল্যমান দেশগুলোকে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বলয়ে প্রবেশ করতে হবে নইলে রাশিয়া চীনের প্রভাবের মধ্যে যেতে হবে।
রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং চীনের কূটনৈতিক চাল চলতে থাকার সময় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় গণতন্ত্র শীর্ষ সম্মেলন থেকে দেওয়া হলো পাল্টাবার্তা। এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদের বিপক্ষে বিশ্বের অন্য অংশকে নিয়ে একটি ফ্রন্ট খোলার আয়োজন করছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেসব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় নিজেদেরকে নির্মাণ করেছে, সে সব দেশের উপর ভর করবে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তি। এ শক্তি দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত চীন এবং সাবেক কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত রাশিয়াকে মোকাবেলা করবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব। নতুন ও কঠিন এ সন্ধিক্ষণ থেকে মুক্ত নয় বিশ্বমানচিত্রের কোনো দেশই। বাংলাদেশও নয়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই
টপ নিউজ মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল স্নায়ুযুদ্ধ: নিরপেক্ষতার খেল খতম