বিশ্ব কূটনীতির বাঁকে চীনের চিকন টোকা
১৯ মার্চ ২০২৩ ১৭:০৭
চলমান স্নায়ুযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেওয়ার স্টিয়ারিংয়ে চীন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজ দেশে যা চেয়েছিলেন তা হয়েছে। অথবা তিনি তা করে ছেড়েছেন। চীনের পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে তাকে তৃতীয় পাঁচ বছরের মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে। যা তার আজীবন ক্ষমতায় থাকার পথ করে দিয়েছে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিসির প্রতিষ্ঠাতা মাও সেতুংয়ের পরে শি জিনপিংকেই চীনারা বেশিদিন ক্ষমতায় রাখছে এবং ক্ষমতাধর করে দিচ্ছে। চৈনিক ক্ষমতার এ রেশ এখন বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযাত্রা।
কেবল শি জিনপিংকে ক্ষমতাধর করছে বলে নয়, বিশ্বরাজনীতিতে বিশাল এজেন্ডায় ধাবমান চীন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশে পরিণত করার মিশন তার। আশপাশ বা উপাঞ্চল মাড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও দফায় দফায় শক্তির জানান দিয়ে চলছে দেশটি। সাত বছর পর ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনেও ভূমিকা রাখার সক্ষমতা দেখিয়েছে। লিবারেল গণতন্ত্রের পতাকাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমের দেশগুলোর সামনে কাস্তে-হাতুড়ির লাল পতাকা তাই যারপরনাই আতঙ্কের। চীনের চিকন কূটনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক খবরদারিতে এরইমধ্যে ছেদ ফেলেছে।
নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে এবং মার্কিন সামরিক সদর দপ্তর পেন্টাগনে ২০০১ সালের ৯ ইলেভেনে বোমা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেরর ঘোষণা সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিপরীত সুফল ভোগ করছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের তা টের পেতে অনেক সময় লেগেছে। একক বিশ্বে বিগত স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র মুসলিম দেশগুলোর উপর থেকে রাতারাতি মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কুফল ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পথে ভূমিকা রাখা পাকিস্তানকেও খরচের খাতায় ছুঁড়ে ফেলতে দেরি করেনি তারা। এখন মুসলিম দেশগুলোসহ এক সময়ের মিত্রদেরও কাছে টানার চেষ্টা মাঠে মার খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর বিশ্ব রাজনীতির হিসাব আরো গোলমেলে হয়ে গেছে। সেখানেও এখন পর্যন্ত নড়বড়ে অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের। উল্টোদিকে বেশ ফর্মে চীন।
যুদ্ধটির প্রথম বার্ষিকীর কয়েকদিন আগে, মার্কিন কর্মকর্তারা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ এনে চীনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। চীন এই অভিযোগ কেবল অস্বীকারই করেনি। সংঘাতের বদলে শান্তির বার্তার এক ডজন প্রস্তাবও দেয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সম্পর্কও আরো বিস্তৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি বিষ হজম করার মতো। তারওপর মার্কিন আকাশে চীনা গুপ্তচর বেলুনের চক্কর। যুদ্ধের শুরু থেকেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সতর্ক করেছে রাশিয়াকে সমর্থন না করার জন্য। ২০২২ সালের মার্চ মাসে রাশিয়া চীনের কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছিল এমন রিপোর্ট প্রকাশের পর ওয়াশিংটন চীন-রাশিয়া উভয়কে হুমকি-হুঙ্কারের মাত্রা বাড়ায়। চীন এতে ভ্রুক্ষেপ না করে রাশিয়া থেকে কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক-গ্যাস আমদানি আরো বাড়িয়ে দেয়। ভারতও প্রায় একই কাজ করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে অনেক রাশিয়ান কোম্পানি ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে চীনের দ্বারস্থ হয়েছে। চীন এই সুযোগে প্রতিরক্ষা শিল্পে ব্যবহারের জন্য রাশিয়ায় প্রযুক্তি রপ্তানি বাড়িয়েছে।
চীনের কূটনীতির ভাঁজে ভাঁজে অর্থনীতি। গোটা বিশ্বেই একটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চায় চীন। রাশিয়ার সঙ্গে তাল মেলানোর নেপথ্যেও প্রচুর অর্থনীতির অংক। ওই অংকের অংশ হিসেবে জি ২০ বৈঠক শেষে ইউক্রেনের যুদ্ধের সমালোচনা করে নেয়া প্রস্তাব সমর্থন করতে অস্বীকার করেছে। বহুল আলোচিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও চীন বাণিজ্যের জাল ফেলেছে। তাদের হিসাব বড় পরিস্কার। পশ্চিমারা যত বেশি এবং দীর্ঘ সময় ধরে ইউক্রেনের দিকে মনোনিবেশ করবে, ততদিন তাইওয়ান এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে কম সহায়তা করতে পারবে। আবার রুশ-ইউক্রেন কোনো সমঝোতা হলেও লাভের অংক যাবে চীনের ঘরে। জ্বালানি তেল সরবরাহ প্রশ্নে রাশিয়া চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। চীনের শিল্প কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য রাশিয়ার সীমাহীন জ্বালানি তেল রফতানি চীনের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত খুলবে।
অংকের এমন হিসাবের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রকে এখন যুদ্ধবাজ ছাড়া আর কিছু ভাবছে না চীন। অর্থনীতির ফ্যাক্টর ভাবে না। আর নিজেদেরকে জানান দিতে চায় শান্তিকামী হিসেবে। এই চীনই ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে চমক তৈরি করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমান্তরালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপরীতে ভূমিকাও নিয়েছে। ১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আবার চীন এবং রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো হতে থাকে। ১৯৯১ সালে দেশ দুটি শান্তিপূর্ণভাবে একটি স্থল সীমান্ত ভাগ করে এবং ২০০১ সালে ‘গুড-নেবারলিনেস অ্যান্ড ফ্রেন্ডলি কোঅপারেশন’ চুক্তিতে তারা স্বাক্ষর করে। ২০২১ সালের জুনে আরও পাঁচ বছরের জন্য এই চুক্তি নবায়ন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে এবং বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের বিরুদ্ধে চীনের যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সাল থেকে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সামর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেখেছে।
ওই অভিজ্ঞতা থেকেই এখন প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গ্রেফতারি পরোয়ানাকে ন্যয়সঙ্গত বলে দাবি করছে যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবার আইসিসির রায় ঘোষণার পরপরই বিবৃতি দেয় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জানায়, রাশিয়া আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র না হওয়ায় প্রেসিডেন্ট পুতিনকে গ্রেফতারের কোন ক্ষমতা নেই সংস্থাটির। তবে আইসিসির সদস্য কোন দেশ ভ্রমণের সময় তাকে গ্রেফতারের সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যান ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেশকভ। এদিকে, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্রের প্রধান আখ্যা দিয়ে আইসিসির রায়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রাশিয়ার মতোই আইসিসির সদস্য না হয়েও আইনি সংস্থাটির এমন রায়কে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। একইভাবে পুতিনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘোষণা করার বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিকসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। চীন সেখানে কেবল মজা দেখা ও সমীকরণ মেলানোর ভূমিকায়।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই
টপ নিউজ বিশ্ব কূটনীতির বাঁকে চীনের চিকন টোকা মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল