নিভৃতচারীর সরব প্রস্থান
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:২৯ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২০:৪২
সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মো. শাহ আলমগীর এ বছর মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন। এটি তার প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এর আগে তিনি ‘কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাহিত্য পুরস্কার ২০০৬, ‘চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক ২০০৫ ’, ‘রোটারি ঢাকা সাউথ ভকেশনাল এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড ২০০৪’ ও ‘কুমিল্লা যুব সমিতি অ্যাওয়ার্ড ২০০৪’ পেয়েছেন।
মো. শাহ আলমগীর, আমাদের আলমগীর ভাই। আমার মত অনেকেরই ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড। চার বছর আগে আমাদের ছেড়ে গেছেন। আজ তার মহাপ্রয়াণ দিবস।
আলমগীর ভাইয়ের সাথে কতো লক্ষ কোটি স্মৃতি তা মনে করার চেষ্টা করা বাতুলতা মাত্র। কেবে পরিচয় তা স্মরণ করা সম্ভব না।
স্কুলে পড়ি তখন। বাসা কলতাবাজারে। ছাত্র ইউনিয়নের হোসেনি দালানের অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে প্রেস রিলিজ ধরিয়ে দেয়া হতো বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে পৌঁছে দেয়ার জন্য। কোন পত্রিকায় কার হাতে দিতে হবে তা বলে দেয়া হতো প্রথম দিকে। পরে আর দরকার হয়নি।
দৈনিক সংবাদ তখন আমাদের অঘোষিত মুখপত্র। সংবাদে গিয়ে প্রেস রিলিজ দিতাম শাহ আলমগীর ভাইয়ের কাছে। মিষ্ট ও স্বল্পভাষী শাহ আলমগীর ভাই প্রেস রিলিজ নেয়ার পাশাপাশি মাথায় হাত রেখে সস্নেহে জিজ্ঞেস করতেন সংগঠন আর পড়াশোনার খবর। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের মত নামী প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়ায় স্নেহের স্বরেই পড়াশোনার বিষয়েও উৎসাহ পেয়েছি।
১৯৯২ সালে এসে দৈনিক সংবাদ-এর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছি মাস কয়েক। শাহ আলমগীর ভাই তখন শিফট ইন-চার্জ। তখন দেখেছি নিউজ রুমের সবচেয়ে নিচুকণ্ঠের মানুষটি ছিলেন তিনি।
২০০১ সালে শাহ আলমগীর ভাই চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক হলেন। আমি সেখানে সামান্য সৈনিক ছিলাম মাত্র। সহজ, সরল, বিনয়ী মানুষটির চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে বলা যাবে অনেকটা সময় জুড়ে। তবে ওয়ান-ইলেভেনের দিনটি থেকে শুরু করে পরের কঠিন সময়ে তাঁর নেতৃত্ব ও অগণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি মাথা নত না করার ঘটনা দেখার সুযোগ হয়েছে খুব কাছ থেকে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নে সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন যোগ্যতার সাথে। তিনি যখন দ্বিতীয় মেয়াদে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন আমি তখন যুগ্ম সম্পাদক। অন্তত গত ২০/২৫ বছরের মধ্যে তিনি আর্থিকভাবে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করা অনন্য নেতা। ডিইউজে-এর পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজী, তদ্বিরবাণিজ্য না করা একমাত্র নেতা শাহ আলমগীর ভাই।
আলমগীর ভাই হেড অব নিউজ হয়ে ২০০৭ সালে চলে গেলেন একুশে টেলিভিশনে। আমি থেকে গেলাম চ্যানেল আই’তেই। ২০০৯ সালের শুরুতে আলমগীর ভাই নির্বাহী পরিচালক (বার্তা) হয়ে যোগ দিলেন যমুনা টেলিভিশনে। আলমগীর ভাইয়ের হাত ধরে ১২ জুলাই ২০০৯ সালে ডেপুটি এডিটর হয়ে আমি সেখানে ঠাঁই পেলাম। যমুনা টেলিভিশন ছাড়ার পর তিনি গেলেন মাছরাঙা টিভিতে। আমিও সেখানে যাবো এটা ছিল প্রায় নিশ্চিত। পরপর তিন দফা ফাহিম মোনায়েম ভাইয়ের কারণে নিয়োগপত্র তৈরি হওয়ার পরও যোগ দিতে পারিনি।
আমার বেকারত্ব ঘোচাতে আলমগীর ভাই চেষ্টা করেছেন বেশ কয়েকবার। ২০১৩ সালে প্রধান নির্বাহী ও প্রধান সম্পাদক হিসেবে তিনি যোগ দিলেন এশিয়ান টিভিতে। টিম গোছানোর প্রাথমিক কাজ চলছে, এ অবস্থায় যুক্ত হলেন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট (পিআইবি)-তে, মহাপরিচালক হয়ে।
পিআইবি-তে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম বিএনপি শাসনামলে ড. রেজওয়ান সিদ্দিকী মহাপরিচালক হওয়ার পর। পালা পরিবর্তন হলেও যাইনি আর। আলমগীর ভাইয়ের কারণে আবার শুরু হয় যাতায়াত। পিআইবি’র সাথে পেশাগত সম্পৃক্ততাও তৈরি হয়। দুর্যোগ সাংবাদিকতা (মানবসৃষ্ট দুর্যোগ) নিয়ে বই লেখা কিংবা ঘটনাপঞ্জী ২০১৩-এর সম্পাদনার কাজ করেছি। তবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সাংবাদিক-দের নিয়ে প্রকাশিত বইটির সম্পাদনার কাজটি আমাকে দিলেন। এতে তিনি চিরকৃতজ্ঞ করে রেখেছেন আমাকে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে গর্ব করার মত কাজটি করার সুযোগ পেয়েছি শাহ আলমগীর ভাইয়ের জন্যই। কারণ তিনি জানতেন, কাজটি আমি টাকার জন্য নয়, করবো ভালবাসার টানে।
সাংবাদিক রাজনীতিতে আমার সম্পৃক্ততা আলমগীর ভাইয়ের জন্যই। আলতাফ মাহমুদ ভাই (প্রয়াত) আমাকে নির্বাচনমুখী করেছেন, কিন্তু সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হওয়ার কঠিন পথটি দেখিয়েছেন আলমগীর ভাই। চাঁদাবাজী না করে সংগঠনের দৈনন্দিন কাজ বা বড়ো অনুষ্ঠান কিভাবে করতে হয় তা দেখিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন আলমগীর ভাই।
গণমাধ্যমে বড়ো ভাই, ছোট ভাই আছেন অনেকে। কিন্তু শাহ আলমগীর ভাই একজনই। ৩৩ বছর ধরে দেখেছি তিনি কারও ক্ষতি করেন না, সুযোগ থাকলে আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়ান।
আমার মত বেয়াড়া, ঊদ্ধত, বাউণ্ডুলে মানুষও যার সাথে নিচু লয়ে কথা বলে তিনি আমাদের শাহ আলমগীর ভাই। গণমাধ্যমে একমাত্র ব্যক্তি শাহ আলমগীর ভাই, যার প্রতি আমার অভিমান হয়, রাগ-ক্ষোভ সবই। বাকিদের নিয়ে আমার ভাবনা নেই। কারণ, আমার রাগ, ক্ষোভ, মান, অভিমান… ইত্যাদি, ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেয়ার দরকার নেই কারও। শুধু আলমগীর ভাই-ই আমাকে স্নেহ ও ভালবাসায় প্রশ্রয় দেন। আমার সব পাগলামী হাসিমুখে ধারণ করেন। আলমগীর ভাইয়ের কল্যাণে কিছুটা স্নেহ পাই মায়া ভাবির কাছ থেকেও।
আজ (২৮ ফেব্রুয়ারি) শাহ আলমগীর ভাইয়ের চিরবিদায়ের দিন।
আলমগীর ভাইয়ের জন্ম ১৯৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা ১০টায় চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এর আগে ভোর ৭টায় পরপর কয়েকবার হার্ট অ্যাটাক করায় নেয়া হয়েছিল লাইফ সাপোর্টে।
রক্তে হিমোগ্লোবিন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরে ছিলেন চিকিৎসাধীন। শেষ ২/৩ বছর চিকিৎসা নিচ্ছিলেন চেন্নাইয়ে। সেখানে ডাক্তাররা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি ঠিক কি হয়েছে। এরপর ২০১৯ এর শুরুতে যান সিঙ্গাপুর। কয়েকদিন থেকে চলে পরীক্ষা নিরীক্ষা। এরমধ্যেই চাইনিজ নববর্ষ শুরু হওয়ায় ফিরে আসেন দেশে। কথা ছিল দুই সপ্তাহ পর আবার যাবেন সিঙ্গাপুরে।
২১ ফেব্রুয়ারি মনটা খুব খারাপ ছিল। ফোন দেই আলমগীর ভাইকে। তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ফোন দেই মায়া ভাবীকে। তিনিও ফোন রিসিভ করেননি। এমনটা হওয়ার কথা নয়। শুরু হয় দুঃশ্চিন্তা। বাসায় ফিরে আসি। বাসায় আসার কিছুক্ষণ পর, সোয়া ৭টার দিকে মায়া ভাবীর ছোটবোন শাহনাজ শারমীন ফোন দেন। জানান, সিঙ্গাপুর থেকে টেস্ট রিপোর্ট এসেছে। ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন রিপোর্ট নিয়ে। ডাক্তার রাতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছেন। আমিও যেন সম্মিলিত সামরিক হাসপালে (সিএমএইচ) যাই।
খবরটা পেয়েই ছুটি হাসপাতালের দিকে। আমি পৌঁছানোর ১০/১৫ মিনিট পর ভাবী ও ছেলে দীপ-সহ আলমগীর ভাই হাসপাতালে পৌছেন। ভাবী জানালেন আলমগীর ভাই দাড়াতে পারবেন না। ছুটে গিয়ে হুইল চেয়ার নিয়ে আসি। পা নামাতে পারছেন না। গাড়ির দরজার নিচে এক হাত রেখে আরেক হাতে পা ধরে নামিয়ে আনি গাড়ি থেকে। হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাই ইমার্জেন্সিতে। ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম হেলাল ভাই ব্যবস্থা করে ফেলেন হাসপাতালে ভর্তির।
এরপর দিন নেয়া হয় এইচডিইউ-তে। এই সময় প্রায় সব গণমাধ্যমে শুরু হয় সংবাদ দেয়া। সংবাদে তথ্য প্রদানে কিছু অসঙ্গতি তৈরি হয়। যে যার মত প্রাথমিক তথ্যের ওপর আরও তথ্য যোগ করছিলেন। তাই সিদ্ধান্ত হলো আলমগীর ভাইয়ের শারিরীক অবস্থার আপডেট জানিয়ে আমি ফেসবুকে যে পোস্ট দিব সেটাই হুবহু নেবে বিভিন্ন টেলিভিশন ও পত্রিকা।
আলমগীর ভাই হাসপাতালের বিছানায়। ভাবী-সহ আমরা হাসপাতালের বারান্দায় দিন কাটাই। এক পর্যায়ে প্রয়োজন হয় রক্তের। অসংখ্য মানুষ এলেন রক্ত দিতে। গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে অচেনা মানুষ এগিয়ে এলেন রক্ত দিতে।
২৪ তারিখ পিআইবি’র একজন কর্মকর্তাকে আলমগীর ভাই বললেন ব্যাংকের চেক নিয়ে আসতে। তিনি সাইন না করলে সবার বেতন আটকে যাবে। চেক এলো। বিছানায় শুয়ে আলমগীর ভাই কাঁপা হাতে স্বাক্ষর করলেন। অফিসের সবার নির্ধারিত দিন বেতন প্রাপ্তি নিশ্চিত হলো।
২৬ তারিখ (সম্ভবত) দিবাগত মধ্যরাতে আলমগীর ভাইকে এইচডিও থেকে স্থানান্তর করা হলো আইসিইউ-তে। ডাক্তাররা জানালেন, কোন ওষুধই শরীরে রেসপন্স করছে না। এমন অবস্থায় ২৭ তারিখ দিবাগত রাত ৪টার দিকে কেবিনে গেলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে। টানা কয়েকদিনের নির্ঘুম ও দৌড়ঝাপের কারণে শরীর চলছিল না। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সিএমএইচ-এর তৎকালীণ পরিচালক ব্রিগেডিয়ার ডা. তৌফিক ভাবীকে ফোন করে জানালেন আলমগীর ভাইয়ের অবস্থা ভালো নয়। একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। আমরা ছুটে গেলাম আইসিইউ-তে।
ডাক্তার জানালেন, আমরা যাওয়ার আগে আরেকবার অ্যাটাক হয়েছে। তাই দ্রুতই লাইফ সাপোর্ট দিতে হয়েছে। এর পরের করণীয় জানতে চাইলেন তারা। কঠিন সিদ্ধান্ত। সকাল ৭টা থেকে ইকবাল সোবহান চৌধুরী ভাই, আবুল কালাম আজাদ ভাই, মন্জুরুল আহসান বুলবুল ভাই, সাইফুল আলম ভাই সহ অন্যদের আলমগীর ভাইয়ের সবশেষ অবস্থা জানিয়ে হাসপাতাল আসার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তারা সবাই সকাল ৯টা নাগাদ হাসপাতাল এসে পৌঁছেন। ততক্ষণে টেভিশনের টিকার দেখে শতশত গণমাধ্যম কর্মী এসে হাজির হন হাসপাতালে। বিভিন্ন টেলিভিশনের ক্যামেরায় ভরে যায় হাসপাতালের বারান্দা।
সবার সাথে কথা বলে ভাবী সিদ্ধান্ত দিলেন লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়ার। শেষ হলো বর্ণাঢ্য একজীবনের।
সেদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যমজুড়ে ছিল বিষাদের ছায়া। যে মানুষটি ছিলেন নিভৃতচারী, তার মৃত্যু সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। সব জাতীয় গণমাধ্যম দেশবাসীকে শোকের বার্তা জানালো গভীর দুঃখের সাথে।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট
সারাবাংলা/এএসজি