Saturday 11 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চা-শ্রমিক দাসত্বের শেষ কোথায়?

সজীব ওয়াফি
২৭ আগস্ট ২০২২ ১৩:২৫

বাজারে ডিমের হালি ৫৫, ব্রয়লার মুরগির কেজি ২১০ টাকা। আর চালের দাম? সে প্রতিনিয়ত বাড়ছেই; কখনো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে, আবার কখনো মিল মালিকদের সিন্ডিকেট। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া হওয়ায় নাভিশ্বাস উঠেছে খোদ মধ্যবিত্তে। খাবারের তালিকা করতে হচ্ছে কাটছাঁট। আর সেই বাজারে একজন চা শ্রমিকের দৈনিক পারিশ্রমিক কত জানেন? ১২০ টাকা মাত্র! তা-ও মালিকপক্ষের শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে যে এই মজুরি পেতে হলে একজন শ্রমিককে দৈনিক কমপক্ষে ২৩ কেজি চা পাতা তুলতে হবে। অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ তো আছেই।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের শোষণ, নিপীড়ন, নিরক্ষরতা ও সামাজিক বৈষম্য একদিনের নয়। দিনে দিনে এই ব্যবস্থার কায়েম হয়েছে। যখনই তারা তাদের দাবি উত্থাপন করেছে তারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদেরকে রাখা হয়েছে দেশের মূল জনগোষ্ঠী থেকে একরকমের বিচ্ছিন্ন করে। অথচ রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, খালি পায়ে দেশের অর্থনীতিতে তারা কেবল অবদানই রেখে গেলো। মশা-মাছি, জোঁক, বিষাক্ত সাপ ও পোকামাকড়ের আক্রমনের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। পিঠে ঝুরি বেধে সকাল থেকে সন্ধ্যা শুধুমাত্র কাজই করে যায়। মুখ থেকে রা পর্যন্ত বের হয় না; যা বের হয় তা কেবল নিঃশ্বাস-দীর্ঘশ্বাস। বিপরীতে তাদের সেই গ্লানির নিঃশ্বাস ভরা পেয়ালায় চুমুক দেই আমরা শহুরে ভদ্র সমাজ। একবার খোঁজ নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করি না কেমন কাটে এই পানীয় সংশ্লিষ্টদের জীবন।

বিজ্ঞাপন

একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই। মহা বিদ্রোহের ঠিক ২০-২২ বছর আগে, ঔপনিবেশিক শাসনকালে, ১৮৩৪-৩৫ সালের দিকে আদিবাসী শ্রমিকদের সিলেট অঞ্চলে নিয়ে আসা হয়। তাদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল নতুন জীবনের। নতুন ঘর, থাকবে ফসল ফলানোর অধিকার আর জমির মালিকানা। উদ্দেশ্য ব্রিটিশ সাহেবেরা চা পান করবেন, ব্রিটেনে রপ্তানি করবেন। চা উৎপাদন হয়েছিলো সত্য, রপ্তানিও হয়েছিলো, এখনো হয়; কিন্তু ভেসে যাওয়া ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রতিশ্রুতি দেওয়া আশ্বাসগুলো মিথ্যা বিশ্বাসে পরিণত হয়। চালু হয়ে গেল চা বাগানের দাসপ্রথা। জন স্টেইনব্যাকের লেখায় উঠে এসেছে ঠিক এরকমটাই। অত্যাচার-অবিচার, শোষণ-শাসন, নিপীড়নের শিকার হয়ে নিজভূমে ফেরার জন্য পরিশেষে ১৯২১ সালের ২০ মে শুরু হলো “মুল্লুক চলো” আন্দোলন। চা শ্রমিকদের হাতে দেশে ফেরার মতো টাকাকড়ি ছিলো না। হেঁটেই তারা রওনা হন নিজভূমের উদ্দেশ্য। চা শ্রমিকেরা চাঁদপুরের মেঘনা ঘাটে পৌঁছলে তাদের উপর ব্রিটিশের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। অনেকের পেট কেটে ভাসিয়ে দেওয়া হয় মেঘনায়। খুন হয় অসংখ্য শ্রমিক। রক্তে লাল হয়ে ওঠে আমাদের চায়ের পেয়ালা! এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর ২০ মে পালিত হয় “চা-শ্রমিক হত্যা দিবস”।

এই তো গেল কেবল এক শতাব্দী পূর্বের ইতিহাস। বর্তমান সময়ে কি চলছে? শ্রমিকেরা কি একশো বছর পূর্বের লড়াইয়ে অধিকার আদায়ে সফল হয়েছে? শ্রমিকদের নিয়মিত পারিশ্রমিক এবং খরচের তুলনা করলেই বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট হয়। বর্তমানে নিয়মিত একজন শ্রমিক ১২০ টা মজুরি পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ সারাদিনের পরিশ্রমে ১২০ টাকার বাইরে একজন শ্রমিকের আর কোন আয়ের পথ থাকে না। খরচের দিকে দৃষ্টি দিলে সাম্প্রতিক বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম ৫২ থেকে ৫৬ টাকা। অন্যান্য জিনিসপত্রের লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সম্পর্কে শুরুতেই ধারণা দিয়েছি। যদি ধরা হয় একজন শ্রমিকের পরিবারে পাঁচ জন সদস্য বসবাস করেন, সে অনুপাতে পরিশ্রম করা শরীরে তিনবেলা খাবারে তাদের নিয়মিত দুই থেকে আড়াই কেজি চালের প্রয়োজন। বাজারের পাথর মিশ্রিত একেবারে নিম্নমানের চালটাও তারা ক্রয় করলে নিয়মিত আড়াই কেজি চালে দরকার হয় ১৫০ টাকা। দৈনিক পারিশ্রমিক ১২০ টাকা হলে তরকারি, হলুদ, মরিচ, তেল জাতীয় অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তারা কিনবেন কিভাবে! সংসারের নারী-পুরুষ উভয়ে যদি কাজ করেন সেক্ষেত্রে ২৪০ টাকায় হয়তো কোন রকমে টেনেটুনে তাদের খাবারের যোগান হবে। কিন্তু অন্যান্য মৌলিক চাহিদা? পোষাক-পরিচ্ছেদ, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার খরচ, চিকিৎসার খরচ আসবে কোথা থেকে! দ্বিতীয়ত শ্রমিক যেদিন অসুস্থ বা কাজে অক্ষম থাকবেন সেদিন চলবে কি করে? সর্বোপরি ভূমির মালিকানা কি তারা পেয়েছে? সংবাদপত্রে উঠে এসেছে চা-শ্রমিকদের নিয়মিত ৩০০ টাকা মজুরির আবেদন। বিস্ময়কর যে সপ্তাখানেক আন্দোলন পরবর্তী ২৫ টাকা বাড়িয়ে করা হলো ১৪৫ টাকা। ১৪৫ টাকা মজুরি প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন রাখতে চাই বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে কোন পরিবারের পক্ষে একশত পয়তাল্লিশ টাকায় নিয়মিত খরচ মেটানো সম্ভব কিনা? এ কেমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত!

শ্রমিকের মাথায় ঘাম পায়ে ফেলে সমস্ত লভ্যাংশ গিয়ে উঠে মালিকের ঘরে, পুঁজিপতির খতিয়ানে। উৎপাদন ব্যবস্থার সমস্ত পরিশ্রম করে খেটে খাওয়া শ্রমিক অনাহারে, অর্ধাহারে আর অপুষ্টিতে ভুগলো। পুঁজিবাদী পন্থায় কোন কাজ না করেও মালিকের পরিবার চড়বেন বিলাসবহুল গাড়িতে, খাবেন নামি-দামি রেস্তোরাঁয়। চিকিৎসার জন্য তারা ছুটে যাবেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে। শ্রমিকদের তো টাকা নেই, সুতরাং দেশের বেসরকারি মেডিকেলেও তাদের চিকিৎসা জুটবে না। অপুষ্টি, অখাদ্য এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকায় একসময়ে রোগেশোকে আক্রান্ত হবেন। অবহেলা-আনাদরে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু ঘটবে সরকারি হাসপাতালের বান্দায়। ন্যায্য দাবি করে আন্দোলন করলেই তেড়ে আসবে রাষ্ট্রের টাকায় কেনা বন্দুকের গুলি কিংবা হুলিয়া।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন ১২০ টাকা মজুরির কাজ ছেড়ে শ্রমিকেরা চলে যাচ্ছেন না কেন! যাচ্ছেন না এই কারণে যে কয়েক প্রজন্মের বসবাস যাদের চা বাগানের শ্রমিক কলোনীতে বেঁধে রাখা; তাদের যাওয়া এতো সহজ নয়। কেননা থাকার ঘরটুকুও যে ঐ চা-বাগানের, শ্রমিকের মালিকানা নেই। কাজ বন্ধ করলেই যে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাবে। দ্বিতীয়ত তাদের পর্যাপ্ত শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও অনুপস্থিত যাতে শিক্ষিত হয়ে ভবিষ্যতে বেরিয়ে পরতে না পারে, নিজের অধিকার ফিরে পেতে বিদ্রোহী হয়ে না উঠতে পারে। চিকিৎসা সুবিধার জন্য অনুপস্থিত পর্যাপ্ত হসপিটাল।

চা শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন। উদ্যোগটি অত্যন্ত প্রসংশনীয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এর আওতায় থাকবেন শুধুমাত্র স্থায়ী শ্রমিক। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্য মতে স্থায়ী-অস্থায়ী চা শ্রমিকর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ। স্ট্যাস্টিক্যাল হ্যান্ডবুক অন বাংলাদেশ টি ইন্ডাস্ট্রি বুক-২০১৯ অনুযায়ী দেশে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৬৬ টি। যার স্থায়ী চা শ্রমিক সংখ্যা ১ লক্ষ ৩ হাজার ৭৪৭ জন ও অস্থায়ী ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন এবং চা জনগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা ৪ লক্ষ ৭২ হাজার ১২৫ জন। পরিসংখ্যানিক তথ্যে দেখা যায় যে অস্থায়ী এবং বেকার চা শ্রমিকের সংখ্যা স্থায়ী শ্রমিকের দ্বিগুণ। কাজেই সরকারি কর্মসূচিতে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। অন্যদিকে চা রপ্তানি বা বিক্রিতে যে মালিকেরা লোকসান গুনছেন এমনটা কিন্তু নয়। লাভের অংশ একটু কমিয়ে দিয়ে শ্রমিকের তিন বেলা খাবারের যোগান দিতে শ্রম বাজার বিবেচনায় নূন্যতম গ্রহনযোগ্য মজুরি বাস্তবায়ন সম্ভব। বাংলাদেশে চা শিল্পের উন্নয়ন হয়েছে, যখন পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে বেঁচে থাকার নিমিত্তে নূন্যতম গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণ থাকে; তখন আমাদের শ্রমিকদের কপালেই জুটে নানান তালবাহানা।

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে চা শ্রমিকেরা অনিচ্ছা স্বত্তেও নিম্নমানের এক জীবন পেয়েছে। মালিকদের কাছে তাদের এই দাসত্ব জীবনকে যেমন ইচ্ছে তেমন খাটানো যায়, যা ইচ্ছে তা করা যায়; দাসদের আবার প্রয়োজনীয় মজুরি কিসের! দাসদের থেকে তো চাই শুধু কাজ আর কাজ; দাসদাসী মরে হলেও লাভের ষোলআনা উঠানো চাই মালিকের ঘরে। রাষ্ট্রীয় মূল অর্থনৈতিক ফসল উৎপাদনের সাথে যারা জড়িত তাদের জীবন মানের খোঁজ না রাখা; পুরো দেশ থেকে, সমাজ থেকে, এমনকি অর্থনীতির যাঁতাকলে ফেলে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার দায় আমাদের নাগরিক পর্যায়েও। দীর্ঘ বিরতিতে বঞ্চনা-ক্ষোভে শ্রমিকের চিৎকার যখন একবার ভেসে এসেছে, ধর্মঘটে কাজ না করায় ঘরে খাবার নেই, এমতাবস্থায় না খেয়ে পেটে পাথর বেঁধে আন্দোলনে সামিল হয়েছে; সুতরাং ভবিষ্যৎ নির্মাণ হতে বাধ্য। ন্যায্যতার দিকে বন্দুক তাক করা আহম্মকি। রাষ্ট্রের অর্থনীতির সুষম বিকাশে শ্রমিকের ঘামের ন্যায্য মূল্যায়ণ এখনই প্রত্যাশিত।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

চা-শ্রমিক দাসত্বের শেষ কোথায়? মত-দ্বিমত সজীব ওয়াফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর