গণতন্ত্র মঞ্চ: আস্থা অর্জনের দৌড়ে কতদূর?
১৩ আগস্ট ২০২২ ১৩:০৯
ভোটের আগে রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন আসে। নিজেদের পক্ষের কৌশল গ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। সময়ের পরিক্রমায় ক্রমেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। আশা করা যায় সামনের বছরের শেষাশেষি হয়তো নির্বাচন হবে। সে অনুযায়ী ছক কাটছে সরকারি এবং সরকার বিরোধীদলগুলো। দল গোছাতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে গুরুত্বারোপ অন্যতম। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি তাদের পুরোনো মিত্রদের কাছে পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি অব্যাহত রেখেছে বিরোধীদের ভিতরে প্রগতিশীল ঘরানার দল বা সংগঠনগুলোকে কাছে পাওয়ার জোর প্রচেষ্টা। সরকার এবং বিরোধীদের এতো এতো কৌশলের দৌড় ছাপিয়ে মাঝখান থেকে গড়ে উঠেছে গণতন্ত্র মঞ্চ নামের গণআন্দোলন কেন্দ্রীক একটি প্লাটফর্ম। শুরুতেই যারা হাজির হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে জনগণের ভোগান্তি বিষয়ক জনসংশ্লিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে।
গণতন্ত্র মঞ্চের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ৮ আগস্ট (সোমবার) এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। আত্মপ্রকাশ হওয়ার আগেভাগে যদিও কিছু আভাস গণমাধ্যম পাওয়া গিয়েছিলো, সংগঠনগুলোর মাঠপর্যায়ের কর্মসূচিও ছিলো। যাহোক জোটভুক্ত দল এবং সংগঠনগুলো হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, নাগরিক ঐক্য, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ এবং রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। এর ভেতরে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি এবং সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ছাড়া কারো নিবন্ধন নেই। নাগরিক ঐক্যকে নিবন্ধন দিয়েও আবার বাতিল করেছিলো নির্বাচন কমিশন। আর জোনায়েদ সাকি নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনকে নিবন্ধন দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও কমিশন সেটা তোয়াক্কা করেনি। এ নিয়ে নির্বাচন কমিশন এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যেও আছে। নুরুল হকদের গণঅধিকার পরিষদ ইদানীং সময়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করেছে; কিন্তু গণতন্ত্র মঞ্চ আত্মপ্রকাশের দু’দিনের মাথায় পুরোনো মামলায় আদালতের তলবের মুখে পরেছে শীর্ষ নেতৃত্ব। ধারণা করা যায় গণতন্ত্র মঞ্চে বঙ্গভবন-গণভবন দখল করার মতো বক্তব্য দলটিকে হুমকিতে ফেলেছে। কাজেই বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিবন্ধন যে তারা সহজে পাচ্ছেন না এ কথা অন্ধ ব্যক্তিরও অনুমানযোগ্য।
গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনে গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকির দৌড়ঝাঁপ লক্ষ্যণীয়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তার পরিচিতি খুবেই ইতিবাচক। আরেকটু বৃহদাকারে বললে সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত টকশো টেবিলেও তার সাহসী বক্তব্য জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্যতার শিখরে। সাইফুল হকের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি বাম বলয়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী; যদিও বর্তমানে বাম গণতান্ত্রিক জোটে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং গণসংহতি আন্দোলনের সদস্যপদ স্থগিত করা। জেএসডি আ স ম আবদুর রবের ঐতিহাসিক কর্মসূচি তাকে কিংবদন্তি করেছে প্রায়। রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ুম সংবিধান বিষয়ে সুস্পষ্ট এবং বিজ্ঞ। চিন্তা-চেতনার জগতে তারা বলবান।
২০০৯ সালের বিপুল সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় ওঠায়। আপামর জনসাধারণের তাতে সমর্থন ছিলো। কিন্তু তৎপরবর্তীকালে দু’টি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তারা এমন বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে যে— তাদের বক্তব্যেই বেরিয়ে এসেছে, বাঘের পিঠ থেকে নামলে তাদের আর রক্ষা নাই। গদি এবং জীবনের নিরাপত্তা তারা এক করে ফেলেছে। বিপদজনক এই পথে আসাতে দলটিকে আমলাতন্ত্রের তোয়াজ করে চলতে হচ্ছে। চলতে হচ্ছে ব্যবসায়ী শ্রেণীর খুশি-অখুশির বহুমুখী হিসাবের অঙ্ক কষে। অঙ্কের দরকষাকষি এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে জনগণের জীবন এবারে আর বাঁচছে না। কয়েক দফা জ্বালানি তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎতের দাম বাড়ায় পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে; জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। বিপরীতে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা দেখছেন জনগণের গায়ে ভালো ভালো জামা কাপড় পরা আর বেহেশতে থাকার তত্ত্ব। আর গণতন্ত্র? তার বলি হয়েছে এক দশক হলো, সংবিধানের নামে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটহীন-প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন একক প্রার্থী নির্বাচন হওয়ায়। কোন কোন এলাকায় ভোটারের চেয়েও অধিক নজিরবিহীন ভোট পরা সকলেরই জানা।
একাদশ নির্বাচনের আগে বিএনপি তাদের পুরোনো মিত্রশক্তিসহ কিছু শক্তি এক করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট করেছিলো। ঐ ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো নির্বাচন। নির্বাচন ব্যতীত জনগণের ভোগান্তি লাঘবে তাদের নূন্যতম কোন কর্মসূচি ছিলো না। এমনকি নির্বাচন পরবর্তী ঐক্যফ্রন্টের কার্যক্রম তলানিতে তলিয়ে যায়। এর আগে বিএনপি-জামাত আঠারো দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। দমন-পীড়নে ব্যর্থ বিএনপি সব সময়েই ব্যস্ত ছিলো তাদের নেত্রীর মুক্তি, নির্বাচন এবং ক্ষমতায় যাওয়া কেন্দ্রীক। জনগণের জন্য তারা নূন্যতম কর্মসূচি গ্রহণ অগ্রাহ্য করেছে নির্দ্বিধায়। বরং দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বাম জোট হরতাল ডাকলে বিএনপির দৌড় বাম দলের হরতালে সমর্থন দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো।
গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের তোড়জোড়ের প্রাক্কালে বিএনপির সাথে দলগুলোর বৈঠক হয়। বরাবরের মতো মঞ্চ নেতৃত্বরা বলে এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের আমূল সংস্কারের লক্ষ্য তারা লড়ছেন। পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন সামনে আসলেই রাষ্ট্রীয় সংকটের স্থায়ী বন্দোবোস্ত তাদের করণীয়। নাগরিকের ভোটের এবং ভাতের অধিকার ফিরিয়ে দিতে মঞ্চ নেতৃবৃন্দ বৃহত্তর ঐক্যের আহ্বান করেছেন। কেউ কেউ অবশ্য এই জোটকে বিএনপির সাথে দরকষাকষি অংশ অবিহিত করেছেন। কেউ সন্দেহ করেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালীন মওদুদ আহমদ যে গণতন্ত্র মঞ্চ গঠনের উল্লেখ করেছিলেন এটা সেই মঞ্চ কিনা? সাত-পাঁচ না ভেবে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকদের খেয়াল করলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়। কেননা গণতন্ত্রে মঞ্চে অংশগ্রহণকারী গণসংহতি আন্দোলন এবং বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশকে বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে এ রকম কোন সংগঠন বা ব্যক্তি মঞ্চের অংশীদার হিসেবে চোখে পরেনি। সুতরাং গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন চলাকালীন মওদুদ আহমেদের প্রস্তাবিত মঞ্চকে যে রাজাকার মঞ্চ আখ্যায়িত করেছিলো, জোনায়েদ সাকিদের নেতৃত্বাধীন এই মঞ্চ সেই মঞ্চ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের বিগত দিনের চেষ্টা এবং কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করলেই পরিস্কার হয় যে ক্ষমতায় যাওয়া তাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, এটা তাদের নির্বাচনী জোট না। তারা বরাবরের মতো তাদের পথ শুরু করেছেন রাষ্ট্রের নানামুখী সংস্কারে জনসংশ্লিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে।
গণতান্ত্রিক সংকটের নেতিবাচক রূপ জ্বালানি তেল ও ডলারে ধাক্কা খেয়েছে, লোডশেডিংয়ে যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে উৎপাদন এবং অর্থনীতিতে। গণআন্দোলন করে যারা মাঠ দখল করবে, ইতিহাসে তারাই রাজনীতির নির্মাতা; বিজয়ীর বেশে তারাই কেবল হাসে। ১৯৭০ থেকে ৯৬, ০১, ০৭ সেই ইঙ্গিতই দেয়। ২০১৪ ও ১৮ এবং বর্তমানে বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থতা এবং গ্লানির জরাজীর্ণে রাজনীতির মাঠে নিরব-শূন্যতা বিরাজমান। হা-পিত্যেশে নিমজ্জিত জনগণের আকাঙ্ক্ষাও এবার তৃতীয় কোন শক্তি। পরিবারতন্ত্রের বাইরে গণতন্ত্র মঞ্চ তৃতীয় সেই শক্তি হয়ে হয়তো কোন বার্তা দিচ্ছে; নয়তো শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ অন্যের হয়ে নির্বাচন করবে। তবে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্দেশ্য মহৎ। এবার দেখা যাক আমরা জনগণ কতটুকু সুবাতাস পাই।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
গণতন্ত্র মঞ্চ: আস্থা অর্জনের দৌড়ে কতদূর? মত-দ্বিমত সজীব ওয়াফি