হিন্দু সংখ্যা কমে যাওয়া: রাষ্ট্রের নীতি ও করণীয়
১১ আগস্ট ২০২২ ১৬:০৬ | আপডেট: ১১ আগস্ট ২০২২ ১৭:২৬
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়া নিয়ে দেশজুড়ে বেশ আলোচনা চলছে। যেখানে এই সম্প্রদায়ের মানুষের হার বাড়ার কথা, সেখানে কেন কমছে? এ নিয়ে কোন কোন মহলে দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই। মূলত যারা দেশকে ভালোবাসেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করেন তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ।
প্রশ্ন হলো হিন্দু জনংখ্যা কমছে বলে নীতিনির্ধারকদের কেউ কী মনের কষ্টে ভুগছেন? মৌলিকত্য হারানোর কারণে রাষ্ট্র কী এ বিষয়ে মহা চিন্তিত? তাছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের দেশছাড়া ঠেকাতে রাষ্ট্র, সরকার তথা রাজনৈতিক দলগুলো কি জোড়ালো কোন পদক্ষেপ নিয়েছে?
গেল ১৪ বছর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে দেয়া ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী দাবি করা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট ক্ষমতায়। এই সময়ে দেশে কতোগুলো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে? প্রতিটি ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন জড়িত থাকারও অভিযোগ কী মিথ্যা?
১৯৭১ সালের পর বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতারাই বেশি হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করেছে। এখনও করছে। এসব সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা এসেছে আজও?
সর্বশেষ নড়াইলে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর চিত্রা নদীর পাড়ে এখনও বিরাজ করছে ভয়, আতঙ্ক আর অজানা শঙ্কা। কাঁদছে এই এলাকার মানুষ-সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সর্বদলীয় এই হামলায়অন্য দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে!
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্যাতনের বিষয়টি যতোটা না দলীয় তারচেয়ে বেশি সর্বদলীয়। অর্থাৎ সব দলের লোকদের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক মনোভাব বেড়েছে। তাই সংখ্যালঘু ইস্যুতে রাজনৈতিক আদর্শকে বড় করে না দেশে আক্রমন ও দেশত্যাগে বাধ্য করা, সম্পদ আত্মসাৎ ও লোটপাট করার চিন্তাই বড়। যদি তাই না হতো- তাহলে তো গেল ১৪ বছরে দেশে একটিও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটার কথা ছিল না। বাস্তবতা হলো, আরও হয়ত হবে। প্রতিরোধের জন্য যা করার প্রয়োজন ছিলো, এর কিছুই হয়নি!
তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ কেন ঝুঁকি নিয়ে এ দেশে থাকবে? কেউ তার বাপ-দাদা, পূর্বপুরুষের ভিটা জন্মভূমি ছাড়তে চান না। অনেকে কাঁদতে কাঁদতে চোখের সাগরে ভেসে অন্যদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এমনও নজির আছে ভারতে কয়েক বছর থাকার পর পরিবার নিয়ে আবারো দেশে ফিরেছেন। যদিও এখন অনেকেই বাড়তি নিরাপত্তা ও শান্তির কথা চিন্তা করে উন্নত দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
২০১৮ সালে ভারতে গিয়ে কিশোরগঞ্জের কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। আমাকে পেয়ে বাংলাদেশী পরিবারগুলো যেন কিছু সময়ের জন্য প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। সবাই গল্প করে বিদায় নেবার পর একজন ভদ্র মহিলা আসেন।
আমাকে বলছেন, ‘দাদা আপনি তো সাংবাদিক। যদি পারেন আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যান। বেনাপোল বর্ডার কোন রকমে পার করে দিলেই হবে। বাদ বাকিটা আমি নিজেই সামলে নেব। কারণ আমার তো পাসপোর্ট নেই’।
ভদ্র মহিলার বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। কিশোরগজ্ঞে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ির লোকজন দেশ ছেড়ে ভারতে যায়। তার বিদেশের মাটিতে মন বসে না। মাটি আর প্রিয়জনদের জন্য রাতদিন মন কাঁদে। মনের কষ্টে তিনি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন। গায়ের রং বিবর্ণ হচ্ছে।
বললেন, ‘আমার ফেলে আসা অতীত, আপনজন, মাঠজুড়ে আলুর ফলন সব সময় চোখে ভাসে। আপনি আমার ভাই। আমাকে যে কোন উপায়ে সীমান্ত পার করে দেন’। জন্মভূমিতে ফিরতে অনেক বিনয় জানালেন। কিন্তু পারিনি। জানিনা এই ভদ্রমহিলা এখনও বেঁচে আছেন কিনা।
খোঁজ নিলে দেখা যাবে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমানো মানুষের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরতে চান। দেশের মাটির জন্য তাদের মন ডুকরে কেঁদে ওঠে। হয়ত একথা কেউ বিশ্বাস করবেন, কেউ করবেন না।
মিয়ানমার থেকে বিতারিত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে কেন আশ্রয় নিল? সর্বশেষ ব্যাপক সহিংসতার মুখে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাকসে কেন দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িকতা সহ নানা কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন প্রত্যাশির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
মানুষ কেন দেশ ছাড়ে? একজন দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে দেশ ছেড়ে যাওয়ার চাইতে মানসিক যন্ত্রণা আর কিছু হতে পারে না। যখন ব্যক্তি নিজেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য নিরাপদ মনে না করে, বা একের পর এক অত্যাচারিত হয় তখনেই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
লাখ-লাখ বিতারিত মানুষের জন্য মিয়ানমার তো কোন সুরক্ষার ব্যবস্থা নেয়নি। তাই তাদের ফেরানো যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি যারা আছে তারাও নানা কায়দায় বিভিন্ন দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে সমুদ্রপথে যাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশে বাসকরা রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগ দেশে ফিরতে আগ্রহী।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ৯০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটির অধিক আদিবাসী মানুষ বাস করে, যাদের ইনডিজিনাস পিপল, ফার্স্ট ন্যাশনস্, নেটিভ পিপল, অ্যাবোরিজিনাল, ট্রাইবাল, হিল পিপল ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়।
বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জাতিসত্তার এই মানুষদের জোরপূর্বক দেশান্তরকরণের ইতিহাস। বিশ্বের দেশে দেশে তারা নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। তাদের অঞ্চলে বহুবার ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। কোথাও কোথাও পাহাড়ি মানুষদের নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে নিরাপত্তার সন্ধানে এবং ভবিষ্যৎ উন্নত জীবনের আশায় অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে এসব মানুষ।
মূল কথা হলো সামাজিক বাস্তবতার কারণে ১৯৪৭ সালের পর থেকেই পূর্বাঞ্চলে হিন্দু জনসংখ্যা কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনেও সেই চিত্র দেখা গেল। দেশে এখন হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এটা নিয়েই প্রশ্ন। গত সুমারিতে বেশি ছিল, এখন কেন কমেছে?
২০১১ সালের জনশুমারির চেয়ে এবারের জনশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে দশমিক ৫৯ শতাংশ। পক্ষান্তরে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯১ শতাংশ। ২০১১ সালে যা ছিল ৯০.৪ ভাগ। ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর আরও চারটি আদমশুমারি হয়েছে। এবার আরও কমল। তার মানে কি এদেশে হিন্দুর সংখ্যা ধারাবহিকভাবে কমতে কমতে এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে?
আমরা কেন আশা করব দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ বাড়বে? কেন তারা দেশ ছাড়বে না? রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক দলগুলো এই সম্প্রদায়ের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কী বদ্ধ পরিকর। নাকি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য নিরবচ্ছিন্ন কাজ শুরু করেছে?
মনে রাখা প্রয়োজন গায়ে ধর্মের আবরণ রেখে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণ হয় না। ১৯৭২ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রীয় চারটি মূলনীতি ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। টানা তিন মেয়াদের প্রথমেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনলো আওয়ামী লীগ। তাতে বাহাত্তরের সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরে এলেও ‘বাস্তবতা’র দোহাই দিয়ে রয়ে গেলো ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’। রয়ে গেলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অধিকার। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ আর প্রতিষ্ঠা হলো না।
যেখানে হিন্দুরা নিজেদের সম্মান, মর্যাদা নিয়ে থাকতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের নাগরিক অধিকার নেই, নিরাপত্তা নেই। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন করার দাবি উপেক্ষিত, সামাজিক-প্রশাসনিক সুরক্ষাও নেই। কথিত ধর্মের অভিযোগ তুলে মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাদের বাড়িঘরে আক্রমণ হয়, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। প্রতিকার হচ্ছে না।
২০০৮ সালের পর থেকে শুনছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা। এই কথাগুলো শুধুমাত্র কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ। মাঠ পর্যায়ে আসলে অসাম্প্রদায়িকতা নয় সাম্প্রদায়িকতার চাষ হয়েছে। যারা দেশকে সাম্প্রদায়িককরণ করতে চায়; তারা বসে নেই। তারা দায়িত্ব অনুযায়ি কাজ করে সফল হয়েছে। ফলে এসব ঘটনার হ্রাস এখন ইচ্ছা করলেই টানা সম্ভব নয়।
লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার ৪৫ দিন পর গত তিন আগস্ট কর্মস্থলে ফিরেছেন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। কিন্তু এই মানুষটিকে ডিসি-এসপির উপস্থিতেতে জুতার মালা পরিয়ে যেভাবে প্রকাশ্যে অসম্মান করা হয়েছে তা কী কখনও ফিরিয়ে দেয়া যাবে। নড়াইল, শাল্লা, কুমিল্লা, রামু, ব্রাক্ষèণবাড়িয়া সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হওয়া মানুষগুলোর হৃদয়ে সৃষ্টি হওয়া দগদগে ক্ষত কী কখনও মুছে দেয়া যাবে?
শেষ পর্যন্ত দেশের সকল জেলা উপজেলায় ডিসি ও ইউএনওদের উপস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় কমিটি গঠন করেছে সরকার। এই কমিটি কতোটুকু ফল দেবে তা সময়েই বলবে। সেইসঙ্গে ‘শান্তিতে সস্প্রীতিতে অনন্য বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে জনগণের মাঝে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারা জনসচেতনতা বাড়াতে পোস্টার, লিফলেট, নাটক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আচ্ছা এভাবে কি সাম্প্রদায়িকতা মুছে দেয়া যাবে?
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে এদেশের নাগরিক মনে করে তাদের সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকাতে সবার আগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দরকার। ঘোষণা দিতে হবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করা যাবে না। নির্যাতন করলে তাকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের কোন ব্যক্তি যদি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে, তাকে দল থেকে বহিস্কারের পাশাপাশি- কোনদিন নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হবে না।
পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যেকোনো অত্যাচার নির্যাতনের ঘটনার দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন আইন করা বা প্রচলিত আইন সংশোধন করে অপরাধকে অজামিনযোগ্য করতে হবে। হামলাকারী ব্যক্তি যদি সরকারী চাকরি করে তাকে চাকুরিচ্যুত করতে হবে। সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার চর্চা বাড়াতে হবে। এজন্য পোস্টার লিফলেট করে কাজ হবে না। জেলা থেকে ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িকতার বার্তা পৌঁছে দেয়ার বিকল্প নেই। সৃষ্টি করতে হবে সামাজিক জাগরণ।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এজেডএস