দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সর্বরোগের মহৌষধ
২৪ জুন ২০২২ ১৯:৪১ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২২ ২০:৩৬
আগামীকাল ২৫ জুন বাংলাদেশের আকাশে নতুন যে সূর্য উদীত হবে, সেই সূর্যের আলোতেই রচিত হবে নতুন ইতিহাস। লেখা হবে পদ্মা সেতু নামক এক মহাসৃষ্টির মহাকাব্য। নদীবিধৌত বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এই সেতু হয়ে উঠবে সর্বরোগের মহৌষধ। হাজার বছরের জরাজীর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা সেরে উঠবে কোনো এক জাদুকরের সোনার কাঠির ছোঁয়ায়। নতুন দিনের নতুন গল্প লেখা হবে প্রমত্তা পদ্মার বুকে।
পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় বিভক্ত বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা যে রোগ, যে ক্ষত কিংবা ত্রুটি; তা সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয় মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুই ইদে। এ সময় দুয়েকদিনের ব্যবধানে লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। আর এতেই ফুঁটে ওঠে নানান অসঙ্গতি ও জরাজীর্ণতার চিত্র। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কোটি মানুষকে। আবার যেকোনো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা সংকটকালেও দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় এই যোগাযোগ ব্যবস্থাই। কোনোভাবে ফেরি বন্ধ থাকলেই দেশজুড়ে শুরু হয় দুর্ভোগ। যাত্রাপথে মানুষের ভোগান্তি তো আছেই, সেইসঙ্গে টান পড়ে পকেটেও। মুহূর্তে বেড়ে যায় নিত্যপণ্যের দাম। ব্যবসায়ীদের চিরচেনা অভিযোগ, ‘ফেরি বন্ধ। সাপ্লাই কম। দাম তো বাড়বেই।’
ফেরি মানেই ঘাটে ঘাটে ভোগান্তি। সময়সাপেক্ষ নদী পারাপার। ঘন কুয়াশা, ঝড়সহ যেকোনো দুর্যোগে যাত্রা বাতিল, বেশি স্রোত অথবা নদীর নাব্যতাসংকটে ফেরি অচল। পদ্মা সেতু চালু হলে সংকুচিত হবে সেই ভোগান্তির ফেরি চলাচল। শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ির ফেরি পারাপারের গল্প ঠাঁই নেবে ইতিহাসের পাতায়। ভোগান্তি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটেও।
প্রায় দুই যুগ ধরে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলার মানুষের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াতের অন্যতম প্রধান প্রবেশপথ পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া নৌপথ। ২০০২ সালে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌপথে চালু করা হয় ফেরি সার্ভিস। এরপর থেকেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়। তবে ফেরি চালু হলেও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের রাজধানীর ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম এই পথে যাতায়াতে পোহাতে হতো চরম দুর্ভোগ। ট্রাক এবং ছোট বড় বাসের লম্বা লাইন উভয়ঘাট ছাড়িয়ে চলে যেত মাইলের পর মাইল।
বিআইডাব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ জানায়, পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া দুই প্রান্ত মিলে গড়ে প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ হাজার যানবাহন পারাপার হয়। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয় দুই ইদের সময়। ইদে ঘরমুখো মানুষজনকে ফেরির দেখা পেতে ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত যানবাহনের ভেতর অপেক্ষায় থাকতে হয়। সব মিলিয়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভোগান্তির অন্যতম একটি নাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সেই ভোগান্তি শেষ হবে
পরিবহন সেক্টরে যুক্ত ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নিত্য ভোগান্তির কবলে পড়া যাত্রীরা বলছেন, পদ্মা পাড়ি দিতে ফেরিঘাটে ট্রাককে সাধারণত পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা আটকে থাকতে হতো। কখনো কখনো দুই থেকে তিন দিনও অপেক্ষায় থাকার রেকর্ড আছে পদ্মার দুইপাড়ের মানুষদের। এখন সেই পদ্মা পাড়ি দেওয়া যাবে মাত্র ৬ মিনিটে। পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বেশকিছু জেলার এক তৃতীয়াংশ দূরত্ব কমিয়ে দেবে।
স্বাধীনতার পর বিস্তৃত হয়েছে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। মেঘনা ও যমুনার ওপর সেতু নির্মাণের ফলে রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের। এরপরও রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল প্রমত্তা পদ্মা। যা ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম প্রধানতম রোগ। যে রোগে আক্রান্ত ছিল দক্ষিণাঞ্চলসহ সারাদেশই। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে নদীমাতৃক এই দেশের সর্বত্রই যাওয়া যাবে সড়কপথে।
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া কিংবা কুয়াকাটা, পদ্মা সেতুর কল্যাণে দেশের সবপ্রান্তেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সড়কপথে। এই সেতুর মধ্য দিয়ে আমূল পরিবর্তন ঘটবে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায়। সব রোগ সেরে যাবে। একসুতোয় গাঁথা হবে বাংলাদেশ। সবপথ এঁকেবেকে পৌঁছে যাবে রাজধানী ঢাকায়। নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে।
তবে এখানেই শেষ নয় পদ্মা সেতুর কীর্তিগাঁথা। এই সেতু শুধু রোগের উপশমই করবে না, বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে ইউরোপের দরজায়। পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সিঙ্গাপুর থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ট্রেন যাবে ইউরোপে।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আনিস মণ্ডল পদ্মা সেতু দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সর্বরোগের মহৌষধ মত-দ্বিমত