ফের সামথিং-নাথিং গেমে পাকিস্তান
২৯ মার্চ ২০২২ ১৫:৪৩
বিশ্ব বলয়ে এদিক–ওদিক করে এগিয়ে যাওয়ার প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতিতেই এগুচ্ছে পাকিস্তান। দেশটিতে হালেও নতুন কিছু হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান হয় টিকে যাবেন, নইলে তার পূর্বসূরিদের পরিণতি ভোগ করবেন। বিশ্ব পরিস্থিতিতে পরাশক্তি ভান করা পাকিস্তানের শাসকদের চলমান বৈশিষ্ট্য। ক্ষমতায় যেতে সেনাবাহিনীর কৃপা, আবার সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়ে ক্ষমতাচ্যুতিও সেখানে দুধভাতের মতো গা–সহা। বিরোধীদল এখানে অনেকটা নাথিং। কিন্তু সেনাবাহিনীর আস্থা নিতে পারলে সামথিং। অথবা এর চেয়েও বেশি।
ক্ষমতায় টলটলায়মান ইমরান খানকে ক্ষমতায় এনেছে পাকিস্তান সেনাবহিনীই। সেইসঙ্গে ক্রিকেট স্টাইলের নানান ছক্কায় বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নিজেকে দ্রুত নিয়ে যান ঈর্ষনীয় ফর্মে। গত মাসকয়েকে বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের প্রভাবে উত্তপ্ত পাকিস্তানের রাজনীতি। বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে। ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি মালুম করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে খাতির রিমেকের চেষ্টা করছেন। সেনাপ্রধানের সঙ্গে এক্সক্লুসিভ বৈঠকও করেছেন। তিনি উৎরে যান বা চিৎপটাং হন তাতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গুনগত পরিবর্তনের কোনো নমুনা নেই।
ক্ষমতাসীন দলকে মেয়াদ পুর্তির সুযোগ না দেয়াও পাকিস্তানের রাজনীতির আরেক সংস্কৃতি। ইমরান খান বলেছেন, তাকে হটাতে অনেক ফান্ডিং হচ্ছে। মার্কিনীদের প্ররোচনায় বিরোধীদলগুলো এ কাজ করছে বলে জোর প্রচারণা। অথচ এই মার্কিনীদেরই খাস পেয়ারাবান্দা বলা হত তাকে। সেই পেয়ার এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তাকে যুক্তরাষ্ট্রের সমান্তরালে চীন–ভারতের ক্যামেস্ট্রিও করতে হয়।
বিদেশিশক্তির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর মন–মর্জি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতিতে কম–বেশি প্রভাবও নতুন নয়। পাকিস্তানে সেটি একেবারে নিরঙ্কুশ পর্যায়ে। এর জেরে নতুন করে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল। দেশটিতে মার্শাল’ল জারির শঙ্কাও কারও কারও। গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা রদবদল সোনার হরিণের মতো দশাগ্রস্ত দেশটিতে স্থিতাবস্থা কখনো ছিলও না। জন্মলগ্ন থেকেই যেখানে গনতন্ত্রের চর্চাহীনতা। এর প্রথম গভর্নর জেনারেল হলেন খোদ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ছিল পার্লামেন্ট, ছিল মন্ত্রী পরিষদ। ক্ষমতা জিন্নাহর হাতে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ক্যান্সারে মারা যান তিনি। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রকাশ্য জনসভায় গুলি খান লিয়াকত আলী খান। দেশটি চলতে থাকে সংবিধানহীন এক সংবিধানের যাঁতাকলে। পেছন থেকে কলকাঠি সেনাবাহিনীর হাতে। ৫৬–তে হোসেন শহীদ সোরাওয়ার্দী একটি সংবিধান দিলেও তা বেশিদূর এগুতে পারেনি। এগুতে দেওয়া হয়নি। আর পেছনে না থেকে ৫৮ তে সরাসরি ফ্রন্টে চলে আসেন জেনারেল আইউব খান। সংবিধান স্থগিত করে জারি করেন মার্শাল’ল। পরের ইতিহাস আরো নির্মম। আইয়ুব গেলে আসেন ইয়াহিয়া খান। জেনারেল টু জেনারেল। এরপর ৭০ এর নির্বাচন। নির্বাচিতদের ক্ষমতা না দিয়ে তাদের বুকে চালায় গুলি।
পরিণতি সকলের জানা। এরপর দেশের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে ফাঁসিতে লটকিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। জেনারেল জিয়াউল হক, আরো পরে জেনারেল মোশাররফ। জেনারেলদের মিছিল। এমন দেশটিতে ফের খানে–খান ধরনের কিছু ঘটলে তা মোটেই অবাক–বিস্ময়কর হবে না। যে কারণে শত্রু দেশটির কথা না ভেবে নিজ দেশের হাজারও সমস্যা বেশি গুরুত্বপূর্ণ অনেকের কাছে।
যুক্তি আছে তাদের এমন মানসিকতায়। কিন্তু, হাল দুনিয়ায় একলা থাকা বা একলা চলার জো নেই। দুনিয়াতে কেউ কারো ভার নিতে না চাইলেও বাস্তবতা হচ্ছে বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশের সুখ–শান্তির ভাগ অনেক দেশই পায়। অশান্তির ভাগও ভুগতে হয়। আর শিক্ষা তো নিতেই হয়। পাকিস্তানের আজকের এ অবস্থার নেপথ্য কেবল সেনাবাহিনী নয়। মূল কারণ অর্থনৈতিক দূরাবস্থা। চরম অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণেই আবার মেয়াদ পূর্ণ হবার আগে সরকার পরিবর্তনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে দেশটিতে। মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ধারা সেখানে ভয়াবহ। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রেখা ছুঁয়ে গেছে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী আবার তখতে–তাউসে চড়ে বসতে পারে বলে সতর্ক করে চলছে পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলো।
লেখক: সাংবাদিক–কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই