কথা কম বলে কাজ বেশি করা ভালো
১০ মার্চ ২০২২ ১৬:০৯
খুব বেশি আলোচনায় না থাকলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর সবার নজরে এসেছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও সচিব ছিলেন। তার সম্পর্কে সরকারবিরোধী কোনো দল বা ব্যক্তি ইতিবাচক কিছু না বললেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার মেরুদণ্ড শক্ত বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারের গুণগ্রাহী না হয়েও নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রশংসা করেছেন, কারণ তার নাম প্রস্তাবও তিনিই করেছেন। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নাম আওয়ামী লীগ প্রস্তাব করেনি। তবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সদ্ভাব আছে এমন ছোট দু–একটি দল তার নাম প্রস্তাব করেছে। অনুসন্ধান কমিটির কাছে বিভিন্নভাবে জমা হওয়া তিন শতাধিক নাম থেকে ১০ জনের নাম চূড়ান্ত করে রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছে। এই ১০ জনের একজন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তাকে সবচেয়ে উপযুক্ত বিবেচনা করা হয়েছে কেন তা শুধু নিয়োগদাতা রাষ্ট্রপতিই বলতে পারবেন। তবে তিনি নিয়োগ পাওয়ায় অনেকেই ধরে নিয়েছেন যে তিনি সরকারের আস্থাভাজন।
কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল মনে করে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সেজন্য বিএনপি শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির কোনো মাথাব্যথা নেই। বিএনপি চায় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। সরকারেরকে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি মানতে বাধ্য করার কথাও বিএনপি বলছে। বর্তমান সরকারের পতন হলে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে আবার একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করবে এবং সেই সরকার ও কমিশনের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে। মানুষ তাদের ভোট দেবে এবং তারা সরকার গঠন করবে।
এই প্রক্রিয়া সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা এক বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। বিএনপি মনে করছে, বর্তমান সরকার জনবিচ্ছিন্ন। জোর করে ক্ষমতায় আছে। তবে এটা নাকি আর পারবে না। সরকারের পতন আসন্ন। যদি তা–ই হয় তাহলে কি নির্বাচন নির্দিষ্ট সময়ে হবে? সরকারের পতন, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসা, নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া – এতসবের জন্য সময় লাগবে না? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বরং জানা দরকার বিএনপির আন্দোলন–পরিকল্পনা। বিএনপি কবে থেকে আন্দোলন শুরু করবে? আন্দোলনের জন্য বৃহত্তর ঐক্যই বা কবে হবে? দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো ছাড়া বাম প্রগতিশীল কোনো কোনো দলও নাকি বিএনপির সঙ্গে সরকার পতনের আন্দোলনে যোগ দেবে। কিন্তু এসব কথা এখন শুধু হাওয়ায় ভাসছে। বাস্তবে কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না।
জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো বিএনপির সঙ্গে থাকতে পারে বা আছেও হয়তো। কিন্তু বাম ঘরানার কোন দল বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে, সেটা স্পষ্ট নয়। সরকারের কোনো কোনো নীতি–পদক্ষেপের সঙ্গে বাম দলের ভিন্ন মত থাকতে পারে। সরকারের ধনিক তোষণনীতির বিরোধিতাও বামেরা করতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় গরিব মানুষের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়ায় সরকারের ওপর মানুষের অসন্তুষ্টি বাড়ছে –এটাও ঠিক। কিন্তু সেজন্য বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে –এই কথা বিএনপির বাইরে কারা ভাবছে? বিএনপি চাইলেই দেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটবে, তার বাস্তব অবস্থা কি আছে? বিএনপির দলীয় সাংগঠনিক অবস্থা কি খুব মজবুত? ক্ষমতার পরিবর্তন হলে সরকার প্রধান হিসেবে এমন একটি নাম কি বিএনপির পক্ষ থেকে বলা সম্ভব যে নামটি শুনলে মানুষ উদ্দীপনা অনুভব করবে?
এর মধ্যে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের একটি বক্তব্য নিয়ে কূটনৈতিক মহলে কিছটা জটিলতা তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির মত শক্ত হয়ে মাঠ ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনারল কাজী হাবিবুল আউয়াল। আর এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছে রাশিয়া। দেশটির ঢাকার দূতাবাস এ বক্তব্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান হিসেবে দেখছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাশিয়া দূতাবাসের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভোট বর্জন সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নতুন সিইসি ইউক্রেন–রাশিয়ার আগ্রাসন আর যুদ্ধের চলমান ঘটনাপ্রবাহ টেনে আনেন সিইসি। তিনি বলেছেন, ‘মাঠ ছেড়ে চলে গেলে হবে না। মাঠে থাকবেন। কষ্ট হবে। জেলেনস্কি হয়তো দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন। তিনি পালাননি। তিনি (জেলেনস্কির) বলেছেন–রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে খবর বের হয়েছে যে, সিইসির এ ধরনের বক্তব্যকে ঠিক ভাবে নেয়নি ঢাকার রাশিয়ার দূতাবাস। অনানুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানটিটসকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চাওয়া হয়নি। ফলে এ নিয়ে কোনো উত্তর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়নি। তবে রাশিয়ার ক্ষুব্ধ হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ এ ইস্যুতে তার অবস্থান বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে। আর এ নিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশ তার অবস্থানের ব্যাখ্যাও দিয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে যদি জানতে চাইতেন, তবে তাকে বাংলাদেশের অবস্থানই জানিয়ে দেওয়া হতো। আর সিইসি হয়তো তার ব্যক্তিগত মত দিয়েছেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই।’
নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অফিস শুরু করার দিন পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল গণমাধ্যমের কাছে অনেক কথাই বলেছেন। সব প্রয়োজনীয় বা জরুরি কথা তিনি বলেছেন তা নয়। তিনি এবং তার সহকর্মীরা একটি বড় দায়িত্ব পেয়েছেন। তাদের ওপর একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনেক কিছু নির্ভর করছে। সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আস্থা অর্জন করতে না পারলে দায়িত্ব পালন সহজ হবে না। নির্বাচন কমিশন নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অনেকেই যুক্ত না হওয়ায় একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যেই যাত্রা শুরু হয়েছে। আগের কমিশন অনেক বিতর্ক তৈরি করে বিদায় নিয়েছে। কাজেই নতুন কমিশনকে সতর্কতার সঙ্গেই চলতে হবে। বেশি কথা বলে অহেতুক বিতর্ক তৈরির সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। তবে সব দলের জন্য নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের কাজ। কম কথা বলে কাজ বেশি করার নীতিতে না চললে কমিশন বড় ঝামেলায় পড়তে পারে। কেউ কেউ এর মধ্যেই এটা মনে করছেন যে নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অতিকথন দোষে দুষ্ট হতে পারেন! রাশিয়া নিয়ে মন্তব্য করে তিনি কিছু ঝামেলা বাধিয়েছেন। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায়ও তাকেই বের করতে হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
কাজী হাবিবুল আউয়াল টপ নিউজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিভুরঞ্জন সরকার