Thursday 23 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড; মেঘে ঢাকা মেঘের আকাশ

সজীব ওয়াফি
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:৪৩

মাহির সারোয়ার মেঘ। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। বয়স মাত্র পাঁচ বছরের সময় ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারে ঘাতকের এক নির্মম হত্যাকাণ্ডে মা-বাবাকে হারিয়েছে। বর্তমানে অতিক্রম হচ্ছে যে হত্যাকাণ্ডের দশম বার্ষিকী। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা হবে। তারপর কত আটচল্লিশ ঘন্টা আসলো গেল, কিন্তু হত্যাকারীদের হদিস আর মিললো না! এ পর্যন্ত ৮৫ বারের মতো এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবেদন জমা দেওয়া পিছিয়েছে। অপরাধীরা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল দিনদুপুরে, তারা যেন অলৌকিক! পরিণামে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সাংবাদিকতায় টিকে থাকা বাকীদেরও একটা ভীতিকর বার্তা দিচ্ছে বারবার।

বিজ্ঞাপন

সাগর সারোয়ার কাজ করতেন বেসরকারি টেলিভিশন মাছরাঙাতে এবং মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলায়। টেলিভিশনে কর্মরত থাকাকালীন রাতের অন্ধকারে খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। ঘাতকেরা তাদের বাসা থেকে তেমন কিছু নিয়ে যায়নি। খোয়া যায় শুধুমাত্র তাদের কাজ করার ডিভাইস। অর্থাৎ এটা পরিস্কার যে তাদের ডিভাইসে এমন কোন তথ্য ছিল বা এমন কিছু জানতেন যা নির্দিষ্ট কোন পক্ষের জন্য হুমকিস্বরূপ। ফলে সাহসী এই সাংবাদিক দম্পতিকে তারা পৃথিবীছাড়া করেছে। আর তাদের মেঘ নামে যে ছেলেটা– ও হয়েছে পিতৃ-মাতৃহারা। প্রতি বছর ১১ ফেব্রুয়ারির দিনে যখন ছেলেটার শোকাবহ শুকনো মুখের দিকে তাকাই, নিজেরই খারাপ লাগে। খারাপ লাগে না কেবল আমাদের রাষ্ট্রীয় হর্তাকর্তাদের!

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়, এমনকি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে অপরাধী পক্ষের চরিত্র প্রকাশ পায়। গণমানুষের পক্ষে সংবাদের শক্তির ব্যাপকতায় অপরাধীরা ফেঁসে যেতে বাধ্য। এ কারণে প্রায়ই অপরাধীরা সংবাদকর্মীদের উপর তার জোর খাটান, শক্তি এবং দাপট দেখান। সাগর-রুনি হয়তো এমন কোন অনুসন্ধানী সংবাদ জানতেন বা জানিয়েছেন যার পরিণতিতে তাদের জীবন দিয়ে শোধরাতে হয়েছে। কিন্তু এর বিচারিক প্রক্রিয়া বলতে গেলে থেমে যাওয়া রাষ্ট্রের জন্য বিপদজনক। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে সহকর্মী সাংবাদিকবৃন্দ ধারাবাহিক মানববন্ধন-প্রতিবাদ সভা করেছেন, কর্মবিরতি করেছেন। রাষ্ট্রের টনক নড়েনি। অন্যদিকে খুনের সময়ে পাঁচ বছরের মেঘ এখন কিশোরে পদার্পণ করেছে, বুঝতে না দেওয়ার জন্য তার অভিভাবকেরা অনেক চেষ্টাও করেছেন, খেলার ভিতরে ডুবে থাকলেও মেঘ এখন সবকিছু বুঝতে শিখেছে। বাবা-মায়ের অনুপস্থিতি কি আর পূরণ হয়! আজীবনের জন্যই ওর মুখখানি মেঘে ঢেকে গেছে।

সাগর-রুনিই নন; গত দেড় দশকে ২৩ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৫৬১ জন। আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৯৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২২ বছরে বাংলাদেশে ৩৫ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ১৫৪ জন সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন শুধুমাত্র বিগত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসেই। এত এত সাংবাদিক নির্যাতন-হত্যা হলো, কিন্তু বিচার হয়েছে অল্প কয়েকটির। যেগুলোর আবার বিচার হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশের রায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে জানিয়েছে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস। ফলে এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সাংবাদিকদের মারলে-হত্যা করলে কিছুই হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে দেখেছি– পেশাদারিত্ব পালনকালে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের বিভ্রান্ত কর্মীরা ডেইলি স্টারের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আরাফাত রহমানকে কিভাবে মেরে এক চোখ নষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়।

গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ গণমাধ্যম। সেখানে গণমাধ্যমের সাথে জড়িত সাংবাদিকতা পেশা কোন হেলাফেলার বিষয় নয়। অথচ বরাবরের মতো সাংবাদিক নির্যাতন, মারধর, গুম এবং হত্যাকান্ড বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় সরাসরি আঘাত। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সাংবাদিকতায় কেবলমাত্র ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি; বরং এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে কালক্ষেপণ করায় জীবনের নিরাপত্তার তাগিদে অনেকে সাংবাদিকতা পেশার বিদায় দিয়েছেন। জনমনে প্রশ্ন দাঁড়ায় একটা চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের বিচার এখনো কেন শুরু করা গেল না? একটা বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে পুলিশ-গোয়েন্দারা ঘটনা উদ্ঘাটন করতে কেন বারবার ব্যর্থ হলো! তাদের কি পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই? আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা কেন ৮৫ বারের মতো পেছাতে হলো? নাকি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে শক্তিশালী রাঘববোয়াল কেউ আছেন এবং তাদের বাঁচাতে কেউ কলকাঠি নাড়ছেন অথবা রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার অভাব? এতে কি বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতায় তীরবিদ্ধ হচ্ছে না! গণমানুষ কি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে না? সত্যি বলতে একের পর এক ঘটনায় আমরা ক্রমেই বিচারহীন এক মধ্যযুগীয় সমাজের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।

স্বজন হারানোর বেদনা যে কতটা কষ্টের, কতটা নির্মম; তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেয়ে কেউ বেশি অনুভব করতে পারবে বলে মনে হয় না। প্রধানমন্ত্রী জানেন পিতৃ-মাতৃহীন পরবর্তী দিনগুলো কেমন যায়। তিনি এটাও জানেন বিচার পাওয়ার পথ কতটা বন্ধুর। কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার পরে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৫ আগষ্টে নিহতদের পক্ষে ন্যায্য বিচার পেতে হয়েছে। মেঘের তো আর যাওয়া কোন জায়গা নেই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেই মা-বাবা খুনের বিচার পাওয়া ওর আকাঙ্ক্ষা। সকল নাগরিকের ন্যায্য বিচার পাওয়ার অধিকার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক গণতান্ত্রিক পন্থায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

সজীব ওয়াফি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর