কাশির মৌসুমে ভোটের বাঁশি
২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৫:০৪
মহামারি করোনার দাপট কমতির দিকে হলেও আশ্বিনের শুরু থেকে মৌসুমী পরিবর্তনের ফলে শুকনো কাশি দেখা দিয়েছে। সেই সঙ্গে জ্বর-সর্দি-কাশির প্রভাব। জ্বর বা সর্দি কয়েকদিন পরে কমে যায়, কিন্তু কাশি সহজে কমে না। কারও কারও কাশিতে প্রচণ্ড শ্লেষ্মা, আবার কারও শুকনো কাশি। খুসখুসে বা শুকনা এ কাশিকে করোনার লক্ষণ বলছেন না চিকিৎসকরা। তবে, সাবধান থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
এমন মৌসুমে বেশ আগেভাগেই জাতীয় নির্বাচনের বাহ্যিক তোড়জোর শুরু হয়েছে। বাঁশিটা বাজানো হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে। প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে। উদ্দেশ্য করেছেন দলের নেতাকর্মীদেরকে। বাঁশির সুরটা কম্পন তুলেছে বিএনপিতেও। এক সপ্তাহও দেরি করেনি তারা। নির্বাহী কমিটির সিরিজ বৈঠক করে ফেলেছে বিএনপি। এর মাঝে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে সরকার। তাও একটি ঘটনা। এমন সময়ে বাংলাদেশ চাইলে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার বার্তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পোর মাধ্যমে এসেছে বার্তাটি।
তা হলে নির্বাচন কি আগাম হচ্ছে বা হবে? ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগাম নির্বাচন হবে না। নির্বাচন যথাসময়েই হবে। কিছুটা বিপরীত গন্ধ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের তথ্যে। তার ভাষায় নির্বাচনের আর বেশিদিন নেই। এই ‘বেশিদিন’ মানে কতোদিন? কিছুটা ধোঁয়াশা এ কারণেই। হিসাব মতো দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ। অর্থাৎ দুই বছরের কিছু বেশি সময় বাকি। সময় হাতে রেখে প্রস্তুতি এবং নির্বাচন নিয়ে বাৎচিত একটি ভালো লক্ষণ। সেই অর্থে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হওয়া আলাপ-আলোচনাকে ইতিবাচক ভাবাই যায়।
বিরোধীমতের প্রধান দল বিএনপি কেবল দলীয় কর্মপন্থা ঠিক করছে না। নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি নিয়েও প্রকাশ্যে কথা বলছে। গেল বার ড. কামালের সঙ্গে ফ্রন্ট বা জোট করায় ক্ষতি হয়েছে বলে স্বীকারনামা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সেই সঙ্গে বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবশ্যই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। আর সেই নির্বাচন হতে হবে নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায়। কড়া জবাব এসেছে সরকার পক্ষ থেকে। বাংলাদেশে আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে না বলে দৃঢ়তার কথা জানিয়েছেন প্রভাবশালী মন্ত্রীরা। সংসদের বিরোধী দল নামে পরিচিত জাতীয় পার্টি ভোটের এ বাঁশিতে কাশি মেলাচ্ছে অন্যভাবে। জাপা চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের সামনে এনেছেন নির্বাচন কমিশন-ইসি গঠনের আইনের দিকটি। দেশে এ বিষয়ক আইন নেই। অথচ ইসি গঠনে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে বলে সংবিধানে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আইনের মাধ্যমে সৎ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ হবে বলে মত তার।
করোনার তোড়ে প্রায় দেড় বছর ধরে রাজনীতিতে স্থবিরতা ভর করেছে। নিয়মিত সাংগঠনিক তৎপরতা ছিল না কোনো দলেরই। করোনায় কর্মহীনদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিযোগিতাও হয়নি। তবে, রাজনৈতিক হানাহানি-সংঘাত বন্ধ থাকেনি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত এক বছরে মোট ৪৩৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ২১ জেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ১৫৮টি ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৩২ জনের। নির্বাচনী বাঁশির আওয়াজে সামনের দিনগুলোতে কী হবে, সেই শঙ্কা আপাতত তোলাই থাক। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে আসায় মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। আর এমন সময়েই বাজলো নির্বাচনের আগাম বাঁশিটি। রাজনীতির অঙ্গন কতটা উত্তেজনাপূর্ণ হবে তা নির্ভর করছে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর।
বিশেষ করে নির্বাচনী আইনের বিষয়টি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পেয়েছে। সামনের ফেব্রুয়ারিতে পাবে আরেক জন। দেশে জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে ১১টি। কিন্তু ১১৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশ অনুযায়ী কোনো আইন ও বিধানাবলী প্রণীত হয়নি। এতে সরকারের খাস পছন্দেই নির্বাচন কমিশন গঠন হয়। সিইসিসহ কমিশনাররা নিয়োগ পান সেই পছন্দেই। কে এম নুরুল হুদাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে বর্তমান কমিশন গঠন হয় ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সব ঠিক থাকলে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন হবে। যাদের হাতে থাকবে ২০২৩ সালের শেষে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ভার। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে জোরালো কোনো আলোচনা জমেনি। বিচ্ছিন্ন কিছু কথাবার্তা আসছে। তুলনামূলক একটু এগিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরবর্তী প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করেছেন তিনি। তারা হলেন- সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) সাখাওয়াত হোসেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ও মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামাল। তাদের মতো নিরপেক্ষ লোক আরো আছে এমন কথাও বলে রেখেছেন ডা. জাফরুল্লাহ।
সাংবিধানিক এ সংস্থার সদস্যদের নিয়োগে আইন করার কথা রয়েছে। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।’ বাস্তবতা হচ্ছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও তা হয়নি। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ইসি গঠনের জন্য আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনটি হয়নি। তবে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন হয়েছে। আবারও সেই রেওয়াজ মতো হবে, না আইন হবে? -সারকথা বলা বা শেষ কাশি ছাড়ার সময় আসেনি এখনো।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই