Wednesday 08 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদসমৃদ্ধ সিআরবি বাঁচাও

সজীব ওয়াফি
২৬ আগস্ট ২০২১ ১৪:৫৮

চলমান শতাব্দীতে পুরো পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে। কোথাও বন্যা, কোথাও ঘূর্ণিঝড়, আবার কোথাও দাবানলে দাউ দাউ করে পুড়ছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। বন্যার কবলে ভাঙ্গনে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজার কিলোমিটার। জলবায়ুর এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশেও। ছয় ঋতুর দেশে গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত বাদে বাকীগুলো উধাও। প্রতিবছর ঢলের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে উত্তরাঞ্চল। সিডর, আইলা, মহাসেনের মতো প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ের বিধ্বস্ত উপকূল। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ভেঙে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের একমাত্র কারণ অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ। আর কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিতে পর্যাপ্ত গাছের অনুপস্থিতি। ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদসমৃদ্ধ চট্টগ্রামের সিআরবিতে শতবর্ষী গাছগুলো কাটার আয়োজন চলেছে পরিবেশের এমন একটা দুঃসময়ে।

বিজ্ঞাপন

সিআরবি- ইংরেজি শব্দটির পূর্ণরূপ হচ্ছে সেন্ট্রাল রেলওয়ে বোর্ড। ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন আসাম এবং পূর্ব বাংলার রেলওয়ে সদর দপ্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বন্দরনগরী বা কংক্রিটের শহর যা-ই বলেন না কেন, চট্টগ্রামের এক টুকরো অরণ্য ওই সিআরবি ঘিরেই। এখানে আছে ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন।

স্থাপত্যশৈলীমণ্ডিত কলোনিয়াল সেন্ট্রাল রেলওয়ের লাল রঙের ভবনটি বর্তমানে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় এবং তৎসংলগ্ন এলাকাটি পদস্থ কর্মকর্তাদের আবাসস্থল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এখানে পাকবাহিনীর আক্রমণে রেলওয়ের অনেক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। একাত্তরে শহীদ দশজন মুক্তিযোদ্ধার স্মরণার্থে স্মৃতিস্তম্ভ আছে এখানে। আছে বীর মুক্তিযোদ্ধা চাকসুর জিএস আবদুর রবসহ দুজন মুক্তিযোদ্ধার কবর। এছাড়াও স্থানটি বহন করছে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত ঘটনা।

বন্দরনগরী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম শহর রাতারাতি পরিবর্তন হচ্ছে। আগের মতো সবুজ আর এখন নেই। ইট-পাথরের শহর, জনাকীর্ণ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে দিনে দিনে। এক কিলোমিটারেরও অল্প জায়গাতে তৈরি হয়েছে শিশুপার্ক, সার্কিট হাউস, জাদুঘর, পাঁচতারকা হোটেল, জিমনেসিয়াম ও বিত্তবানদের জন্য ক্লাব। দুটি শপিংমল, দুটি সিনেমা হল, তিনটি কমিউনিটি সেন্টার এই অল্প জায়গার ভিতরেই। আছে স্টেডিয়ামও, স্টেডিয়াম ঘিরে আবার বহু রেস্তোরা।

এম এ আজিজ স্টেডিয়াম পার হয়ে সিআরবি শিরীষতলা পৌঁছতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল যেন। শান্ত-কোলাহলহীন নিসর্গশোভা সিআরবিতে আছে শতবর্ষী শিরীষ গাছ। শহরের দুর্লভ নানা পাখি এবং প্রাণীর আবাস। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া পিচঢালা পাহাড়ি সাতরাস্তা। পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ছায়াঘেরা পরিবেশ নগরবাসীর প্রাতঃ এবং বৈকালিক ভ্রমনস্থানও এটি। এখানে কেউ ব্যস্ত থাকে শরীরচর্চায়, কেউবা যোগব্যায়ামে, কেউ বিনোদনে। স্থানটি ড্রাইভিং শিক্ষারও অন্যতম বিদ্যাপিঠ বলা যায়। পাশের শিরীষতলায় সারা বছরই চলে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হৈ-হুল্লোড়ে সরগম হয়ে উঠে। শিশু-যুবা থেকে বয়োবৃদ্ধ সকলের কাছে জায়গাটি মানসিক প্রশান্তির।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত এই সিআরবি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বর্তমান সময়ে। ছয় একর জমিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের চুক্তি করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে টাঙ্গানো হয়েছে প্রকল্পের সাইনবোর্ড, ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে রেলওয়ে কলোনির কর্মচারীদের থাকার জায়গা। প্রাকৃতিক আঁধার রক্ষায় হেঁয়ালিপনা দেখে ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও ক্ষুদ্ধ হয়েছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

গত কয়েক বছর ধরে ডিসি হিলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ। এ কারণে পহেলা বৈশাখ, বাসন্তীবরণসহ নানা আয়োজন হয় শিরীষ তলায়। ফলত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত কারণেও সাম্প্রতিক সময়ে সিআরবির গুরুত্ব বেড়েছে বহুগুণে। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের অন্য কোথাও কোনো স্মৃতিস্তম্ভ নেই। জাতির মহান সন্তানদের মনে রাখার জন্য, প্রায় আট বছর আগে মুক্তিযোদ্ধারা এই জায়গাটিতেই স্মৃতিস্তম্ভ করতে জানিয়েছিলেন অনুরোধ। এছাড়া হাসপাতাল নির্মাণে ম্লান হচ্ছে প্রবীণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দাবি।

চট্টগ্রাম নগরের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় সিআরবিতে আছে ১৮৩টি ঔষধি গাছ। এগুলো ব্যবহৃত হয় ক্যানসার, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, জন্ডিস এবং অর্শের মতো বিভিন্ন দুরারোগ্য রোগের ঔষধ তৈরীতে। বিপন্ন প্রজাতির ৯টি উদ্ভিদসহ এখানে আছে ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হাওয়ার সম্ভাবনাময় ৭৫টি উদ্ভিদ। এলাকাটিতে বড় বৃক্ষ রয়েছে ৮৮টি। যার মধ্যে শতবর্ষী গর্জন ও শিরীষ গাছ অন্যতম। মোটকথা জায়গাটি নিজেই একটি ‘প্রাকৃতিক হাসপাতাল’। এখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে এসব শতবর্ষী, ঔষধি এবং বিলুপ্তপ্রায় গাছের বেশির ভাগই ধ্বংস হয়ে যাবে চোখের অলক্ষ্যে।

১৯৯৫ সালে প্রণীত চট্টগ্রামের মাস্টারপ্ল্যানে সিআরবিকে ‘সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ২০০৯ সালে যা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়। ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন’ –এই মর্মে উল্লেখ আছে সংবিধানের ১৮(ক) ধারায়। জাতীয় স্মৃতিনিদর্শন বিষয়ে ২৪ ধারায় অঙ্গীকার করেছে যে– ‘বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমন্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ অর্থাৎ হাসপাতাল নির্মাণে সিআরবি রক্ষা এবং সংরক্ষণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এবং অঙ্গীকারও উপেক্ষিত হচ্ছে নিশ্চিত।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করে সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল করাও অসম্ভব। কারণ একজন রোগীর সাথে হাসপাতালে বহু মানুষের আগমন ঘটে। ল্যান্ডস্কেপিং করে শতবর্ষী গাছ রক্ষায় পরিবর্তন আনলেও হাসপাতাল এরিয়ায় রাস্তার দুপাশে শত মানুষ, শরীরচর্চা আর অসুস্থ বা মৃত রোগী নিয়ে ছুটে চলা অস্বাভাবিক। হাসপাতালের কাছাকাছি সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও উদ্ভট চিন্তা। জোরাজুড়ি করে সুন্দর হাসপাতাল হবে, তবে সুন্দর পরিবেশ আর থাকবে না। কারণ হাসপাতালের বর্জ্য নিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনার উপর্যুক্ত দক্ষতার অভাব আছে আমাদের। পরিণামে প্রকৃতি হারাবে তার বিপুলা সৌন্দর্য।

কেউ হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধী নয়। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক সংবেদনশীল, ঐতিহাসিক এবং ঐতিহ্যগত গুরুত্বের জন্য সিআরবিতে হাসপাতাল করা অনুচিত। চট্টগ্রামে চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি আছে, প্রয়োজন আছে আধুনিক সুবিধা সংবলিত হাসপাতালের। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে না গিয়ে জনগণের স্বার্থে রেলওয়ে শুধুমাত্র নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারলে সেটা আরো ভালো হয়। সিআরবি প্রতিষ্ঠার পর কাছাকাছি জায়গায় ছোট্ট একটি হাসপাতাল করে ব্রিটিশরা। পরবর্তীতে এর সাথে যুক্ত হয় কুমিরার রেলওয়ে যক্ষ্মা হাসপাতাল। নানান কারনে এই হাসপাতালটি বর্তমানে নিস্ক্রিয়। রেলওয়ের প্রায় ৩৫ একর জমি পড়ে আছে সেখানে। কর্তৃপক্ষ চাইলে এ হাসপাতালটিকেই মেরামত, আধুনিকায়ন করে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে পারে। চট্টগ্রামে রেলওয়ের অনেক জায়গার মালিক; বিপর্যয় ঘটবে না এরকম সুবিধাজনক জায়গা নির্বাচন করে, উত্তর বা দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্য কোথাও হাসপাতাল করতে বাঁধা নেই।

সিআরবি ঐতিহ্যগতভাবে যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি বৈচিত্রপূর্ণ বৃক্ষরাজিতেও অনন্য। সময়ের পরিক্রমায় বিভিন্ন অযুহাতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শূন্যতায় চিন্তার পরিবর্তন হয়ে আমাদের তরুণেরা জঙ্গিবাদীতায় ঝুঁকছে। সাংস্কৃতিক শূন্যতার দখল নিয়ে চিন্তার নেতিবাচক পরিবর্তন সকলেই অনলাইনে প্রত্যক্ষ করছি হাড়ে হাড়ে। এ অবস্থায় নতুন করে আবার শূন্যতা! আমরা কি শত চেষ্টা করেও এরকম আরেকটা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাংস্কৃতিক লীলাভূমি তৈরি করতে সক্ষম? নগরজীবনে এত ঔষধি গাছের সমাহার কোথায় পাব আমরা? যদি আরেকটা সিআরবি তৈরি করতে না পারি, তাহলে কেন এত ধ্বংসের আয়োজন!

উন্নয়ন স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ করতে গেলেই অক্সিজেন কারখানায় কেন ধাক্কা লাগে। এর আগেও যশোর রোড চওড়া করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হলো, গাছ কাটা হলো রমনাপার্কের ওয়াকওয়ে তৈরীতে, আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হল তৈরি করলেও কাছের গোড়ায় কুড়াল পড়লো! অথচ করোনা মহামারিকালীন সকলেই দেখেছি অক্সিজেনের গুরুত্ব কেমন। প্রকৃতি কিভাবে সতেজ হয়ে উঠেছিলো আমরা দেখেছি।

যা যায়, তা আর ফিরে পাওয়ার নয়। বিগত দিনে সুন্দরবনের ক্ষতি আমরা করে ফেলেছি। চট্টগ্রাম শহরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, সমাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে রেলওয়ের ভূমিকা অসীম। প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে হলেও শুধুমাত্র সিআরবি নয়, সারাদেশের সমস্ত গাছ এবং বন রক্ষা করা সকলের দায়িত্ব। দায়িত্বে অবহেলা হলে শতবর্ষের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি যেমন ধ্বংস হবে তেমনি গরমে মরবো, পানিতে মরবো; প্রবল দুর্যোগ আছড়ে পড়বে ভবিষ্যতের দিনগুলোয়। চট্টগ্রামের সিআরবি রক্ষায় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা সকলের প্রত্যাশা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

মত-দ্বিমত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন- ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদসমৃদ্ধ সিআরবি বাঁচাও সজীব ওয়াফি সিআরবি বাঁচাও

বিজ্ঞাপন

জীবন থামে সড়কে — এ দায় কার?
৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৫২

বাসচাপায় ২ কলেজছাত্র নিহত
৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৮:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর