কোভিড-১৯ ও কোরবানির অর্থনীতি
২২ জুলাই ২০২১ ১৮:৪০ | আপডেট: ২২ জুলাই ২০২১ ১৯:৩৬
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দুই ঈদের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। রোজার ঈদে মূলত পোশাক জাতীয় পণ্যের বাজারে ক্রেতাদের ভীড় থাকলেও কোরবানির ঈদের ক্ষেত্রে কোরবানির পশুর বাজার ঘিরে অর্থনীতি চাকা ঘোরে। এ বছর বাংলাদেশে কোরবানির জন্য ১১.৯ মিলিয়ন পশু তৈরি আছে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কোরবানিতে পশু বাজারে সম্মিলিত পশু কেনাবেচা হয় ৫০-৫৫ হাজার কোটি টাকার। যা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। বিগত ২০২০ ও এ বছর কোভিড-১৯ পরিস্থিরির কারণে কোরবানির বাজার ততটা জমজমাট করে তোলা সম্ভব হয় নি। মূলত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রদত্ত কোভিড-১৯ নির্দেশনা অনুসরণ করা এবং অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য ঈদের সময় একটি পরস্পর বিরোধী অবস্থানে যাওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সরকারের জন্য। বাংলাদেশ সরকার সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে বছর লক-ডাউন শিথিল করে বাংলাদেশের মানুষকে কোরবানিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে একই সাথে এটি সমগ্র দেশে কোভিড-১৯ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
বাংলাদেশে ২০২১ সালের কোরবানির ঈদে একটি বড় সাফল্যের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। সেটি হলো অনলাইন ভিত্তিক ডিজিটাল কোরবানির পশুর হাট স্থাপন। গত ২০ জুলাই পর্যন্ত এই হাটে সর্বমোট ৩ লক্ষ ৮৭ হাজার ৫৭৯ টি পশু বিক্রি হয়েছে। (বাংলাট্রিবিউন, ২০ জুলাই, ২০২১)। বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এবং ই-ক্যাবের যৌথ উদ্যোগে এই ডিজিটাল পশুর হাট অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া সমন্বিত ডিজিটাল হাটের ওয়েব সাইটে প্রবেশ করলে (www.digitalhaat.net) সমগ্র দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত ডিজিটাল হাটে প্রবেশ ও পশু ক্রয়-বিক্রয় করা যায়।
করোনাকালিন সময়ে এবারের পবিত্র ঈদুল-আজহায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান থাকায় দেশের বিপুল সংখ্যক কৃষি ও শিল্প সংশ্লিষ্ট মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সংরক্ষিত হয়েছে। বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় চামড়ার ৬০ শতাংশের যোগান আসে কোরবানির ঈদের সময়। এবার করোনার মধ্যেও সাময়িকভাবে লক-ডাউন শিথিলের ফলে মানুষ কোরবানি করতে সক্ষম হওয়ায় গবাদিপশু ও চামড়া শিল্প একটি লাইফ লাইন পেয়েছে। তবে দেশের মানুষের যে অর্থনৈতিক সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে তা একটি তথ্যেই স্পষ্ট হয়। আমরা ২০১৮-২১ সালের কোরবানির ঈদের পশু বিক্রির পরিসংখ্যান বিচার করলে দেখতে পায় ২০১৮/১৯ এর তুলনায় ২০২০ ও ২০২১ এ গরু অপেক্ষা খাসি কোরবানির হার বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ মানুষের আয় ও সঞ্চয় কমে এসেছে এবং তার প্রভাব পড়েছে ঈদের মত ধর্মীয় আচার পালনের ক্ষেত্রেও।
অতীতে বাংলাদেশ কোরবানির গরুর জন্য ভারতের প্রতি অতিনির্ভরশীল থাকলেও ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ভারতের সরকার প্রধান হয়ে আসলে দেশটি থেকে বাংলাদেশে বৈধ কিংবা অবৈধ পথে গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশে কোরবানির সময় গবাদি পশুর সংকট হয়। যদিও এই সংকট থেকে এদেশের কৃষক ও পশুপালনকারিরা নতুন সম্ভাবনার হদিস পায়। তারা বিদেশি উন্নত জাতের গরু থেকে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাংলাদেশে উন্নত ও অধিক মাংস প্রদানকারী গরু পালন শুরু করে। ফলে গত ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের উপর থেকে নির্ভরশীলতা তুলে নিয়ে নিজেই গবাদি পশু উৎপাদনে সয়ং সম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে। যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে গবাদি পশু পালন নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অসংখ্য তরুণ এই খাতে বিনিয়োগ করে আত্ম-কর্মসংস্থান করেছে।
বিশ্বের প্রায় শতাধিক দেশে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিগত ৩ সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, মৃত্যুবরণ করছে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে সরকার গত এ মাসের শুরু থেকে দেশব্যাপী কঠোর লক-ডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু এই লক-ডাউনের ফল আমরা লাভ করার আগেই কোরবানির ঈদ চলে আসায় অর্থনীতি বাঁচাতে সরকার এক রকম বাধ্য হয়ে ১ সপ্তাহের জন্য লক-ডাউন শিথিল ঘোষণা করে। ঈদের সময় দেশব্যাপী বিপুল জনগণ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করায় এবং প্রকৃতপক্ষে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কার্যত ব্যর্থ হওয়ায় স্বাস্থ্যবিশারদগণ আশংকা করছেন যে ঈদের ১ থেকে ২ সপ্তাহ পর দেশব্যাপী করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যুহার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশের মত অপেক্ষাকৃত একমুখী অর্থনীতির দেশে করোনার ন্যায় দীর্ঘস্থায়ী মহামারি মোকাবেলা করা সহজ কাজ নয়। একদিনে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, অন্য দিকে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা; সব মিলিয়ে যে কোন সরকারের জন্যই এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত না থাকায় অসংখ্য মানুষ করোনা মহামারির সময়ে কাজ হারিয়ে খাদ্য সংকটে ভুগছে এবং মানবেতর জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ টিকা কূটনীতিতে চাতুর্যের সাথে সাফল্য অর্জন করতে না পারায়, আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী এখনো টিকার আওতার বাইরে রয়ে গেছে। নিকট ভবিষ্যতেও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট টিকা ক্রয় করার সম্ভাবনা দৃশ্যমান না হওয়ায় এবং ঈদের সময় বিপুল জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যাতায়াত ও একত্রিত হওয়ায় কোরবানির ঈদ পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী করোনার ব্যাপক বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে ফলে আসন্ন দিনগুলোতে বাংলাদেশে একটি মানবিক বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো যেখানে অধিকাংশ জনগণকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে এবং তার ফলে মাস্ক ব্যবহার কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার অবকাশ পেয়েছে সেখানে বাংলাদেশ বিগত দেড় বছরে অনেকটায় ব্যর্থ। করোনা রোগিদের জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত, পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদকরণ কিংবা দরকারি টিকার সংস্থান করাসহ কোভিড মোকাবেলা সংক্রান্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ব্যর্থতা দৃশ্যমান। একই সাথে জনগণের অসচেতনতা ও আইনের প্রতি বীতশ্রদ্ধার করোনা সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং প্রতিদিন মৃত্যু ঘটছে অসংখ্য মানুষের।
অর্থনীতি বনাম স্বাস্থ্য রক্ষার যে একটি কমপ্লেক্স প্যারাডক্সে বাংলাদেশে পড়ে গিয়েছে তা থেকে দ্রুতই বেরিয়ে আসা অসম্ভব। বিশ্ব ব্যাংক, আইডিবি সহ অধিকাংশ দাতা সংস্থা আগামী ২-৩ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ ৫% হওয়ার ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী করেছে, অন্যদিকে সরকার প্রক্ষেপিত জিডিপি গ্রোথ ৮ শতাংশ। অর্থাৎ আমরা এখানে প্রক্ষেপণের বিপরীতে বাস্তবতার একটি বিশাল ফারাক লক্ষ্য করছি। ফলে আমাদের অর্থনীতিতে একটি সংকটের আশংকা থেকেই যায়। এমতাবস্থায় জনগণের ব্যক্তিগত সচেতনতা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ঈদ উদযাপন নিশ্চিত করা জরুরি। প্রত্যকে যদি নিজ নিজ পরিবারের সদস্যদের জীবনের মূল্য অনুভব করে কোরবানির ঈদ ও পরবর্তী দিনগুলোতে সংযত আচরণ করেন তথা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন সেক্ষেত্রে আমরা করোনা মহামারি থেকে মুক্তি পেতে পারি। দেশের অর্থনীতিকে নতুন প্রাণ দিতে এবং একেকটি অমূল্য মানব জীবন বাঁচাতে করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার কোন বিকল্প নেই।
লেখক- শিক্ষার্থী, মাস্টার্স, নোভা স্কুল অফ বিজনেস অ্যান্ড ইকোনোমিক্স, পর্তুগাল
সারাবাংলা/আরএফ/