বাজেট: নারীতে সুনজর
৪ জুন ২০২১ ১৮:০৬
নতুন বাজেটে ইতিবাচক দৃষ্টিপাত নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি। নারী উদ্যোক্তারা বছরে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করলে কোনো কর দিতে হবে না। বর্তমানে নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ লাখ টাকা। এবার আরও ২০ লাখ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবনার পক্ষে যুক্তি হিসেবে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, অর্থনীতিতে উদ্যোক্তা হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি নারীর সংখ্যা বাড়ছে।
নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার মাঝেও নারীরা নিজেদের মতো কাজের ক্ষেত্র তৈরি করছেন। তা ঘরে-সবখানেই। গত বছর কয়েকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ফেসবুক উদ্যোক্তা নারীরা যেসব ছোটখাটো উদ্যোগ চালান, সেই হিসাব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই। সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। ছোটবেলায় শেখা কোনো জ্ঞান, ছোট হস্তশিল্প, সহজাত রান্নার দক্ষতা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তারা ঘরে বসে বাচ্চা লালনপালনের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যবসা একটু বড় হলে একজন দুজন করে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন। নিয়োগপ্রাপ্তরাও নারী। ক্রেতা-বিক্রেতা-কর্মী সবাই নারী।
সন্তান রেখে কাজে যাওয়ার কোনো উপায় না পেয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন— এমন অনেক নারী আছেন। গৃহে নারীর মজুরিবিহীন কাজ আর বিনামূল্যে থাকছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের নারীরা ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা মজুরিবিহীন গৃহকর্ম করেন। এই কাজের উদ্বৃত্ত দিয়েই তারা অন্য আরেকজন নারীর গৃহকর্মের বোঝা কমিয়ে আনেন, যিনি বাইরে কাজ করে আয় করেন। পরিবারের প্রজনন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যাসহ সংসার ও আবাসকে গতিশীল রাখার মূল কাজটি করেন নারী, যিনি কন্যা, জায়া অথবা জননী।
সিপিডি হিসাব কষে দেখিয়েছে, নারীর এই নীরব অবদানের অর্থমূল্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যা গত বছরের মোট জিডিপির ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ। গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে, প্রতিদিন একজন নারী গড়ে একজন পুরুষের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সময় এমন কাজ করেন, যা জাতীয় আয়ের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় না।
জাতীয় অর্থনীতিতে নারী সরাসরি যে শ্রম ও উদ্যোগ যুক্ত করেন, তার জন্য পোশাকশ্রমিক, খুদে নারী উদ্যোক্তাসহ অন্যরা অভিনন্দিত হন। কিন্তু সাংসারিক কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীরা যে অবদান রেখে যাচ্ছেন, সেটি সব ধরনের হিসাব, স্বীকৃতি ও প্রতিদানের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। ‘উইমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল ২০২১ ইনডেক্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে এসব তথ্য। রিপোর্টটিতে দেখা যায় বাংলাদেশের অবস্থান আফগানিস্তানের চেয়ে খানিকটা ভালো।
এই প্রতিবেদেনে আটটি সূচকের আলোকে মোট নম্বর ছিল ১০০। চলাচলের স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রের সমতা, মজুরি, বিয়ে, পিতৃত্ব-মাতৃত্ব, উদ্যোগ, সম্পদ ও পেনশন— এই আটটি সূচকের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিটি সূচকের সর্বোচ্চ নম্বর ১০০। সবগুলো সূচকের নম্বরকে গড় করে ১০০ নম্বরের মধ্যে স্কোর করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আট সূচকে এই ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ৪৯ দশমিক ৪। অর্থাৎ পুরুষের তুলনায় নারীরা গড়ে অর্ধেকেরও কম সুবিধা পাচ্ছে। গত বছরের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ এই মানে ছিল। এবারের প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থান নেপালের। দেশটির সূচক ৮০ দশমিক ৬। ভারতের ৭৪ দশমিক ৪। সূচকে তার পরেই ৭৩ দশমিক ৮ পয়েন্ট নিয়ে আছে মালদ্বীপ। ভুটান ৭১ দশমিক ৯, শ্রীলঙ্কার ৬৫ দশমিক ৬ আর পাকিস্তান রয়েছে ৫৫ দশমিক ৬ পয়েন্টে। বাংলাদেশ এই অঞ্চলে শুধু আফগানিস্তানের (৩৮.১) ওপরে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, চলাচলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা শতভাগ স্বাধীন। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ায় বাধা নেই। কর্মক্ষেত্রের সমতায় বাংলাদেশ পেয়েছে ৫০, মজুরির ক্ষেত্রে ২৫, বিয়েতে ৬০, মাতৃত্বে ২০, উদ্যোগে ৭৫, সম্পদে ৪০ ও পেনশনে ২৫। সব মিলিয়ে গড় দাঁড়ায় ৪৯ দশমিক ৪ নম্বরে। গত দুই বছরের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ এই অবস্থানে ছিল।
করোনার কঠিন সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার তথ্য ধরা পড়েছে রিপোর্টটিতে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, মানব উন্নয়ন সূচক ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ ইতিবাচক ধারায় ছেদ ফেলেছে করোনা মহামারি। এ রকম সময়ে নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৫০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০ লাখ টাকা করা অবশ্যই এবারের বাজেটের অন্যতম একটি দিক। টাকার অঙ্কে এটি একেবারে কম নয়। তা নারী উদ্যোক্তাদের আরও উৎসাহী করবে— এ আশা করাই যায়।
লেখক: সাংবাদিক–কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/টিআর