বদলে যাওয়া সময়ের ফ্যাশন অনুষঙ্গ মাস্ক
১৪ মে ২০২১ ১২:৪১ | আপডেট: ১৪ মে ২০২১ ১৬:৩২
এবার অনেকের ঈদের পোশাক তালিকায় বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে মাস্ক। রকমারি মাস্কের মাধ্যমে মানুষের রুচি ও অভিব্যক্তিতে যোগ হয়েছে বাড়তি মাত্রা। সুরক্ষার চেয়ে মাস্কে নতুনত্ব তথা ফ্যাশন আনাও এখন একটা ফ্যাশন। এ বাস্তবতায় ফ্যাশনে জায়গা করে নিয়েছে নকশাসহ বিচিত্র সব মাস্ক। রঙ-বেরঙের এসব মাস্কের মান নিয়ে নানা কথা। দামেও তফাৎ। দেশে-বিদেশে প্রতিবাদী আন্দোলনেও এখন মাস্ক ব্যবহার হচ্ছে। যা একসময় হতো মুখোশে।
মাস্কের শুরুটা ছিল প্রয়োজনের তাগিদে। শখে বা ফ্যাশনে নয়। মাস্কের নকশা হতে পারে, তখন ভাবাও যায়নি। এখন মাস্ক ফ্যাশন দুনিয়াকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। লিপস্টিক এবং কাজলের বিক্রি কমছে বলে বিক্রেতাদের উদ্বৃতি দিয়ে পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়েছে। ২০২০ সালে করোনার তোড়ে স্বাস্থ্যবিধি আরোপের পর থেকে দেশে-দেশে মাস্ককে ফ্যাশনের জায়গায় নিয়ে আসার পেছনে বিশেষ অবদান সেলিব্রিটিদেরও। মাস্ক ব্যবহারে নিজস্বতায় তারা চমক এবং পুলক জাগিয়েছেন ভক্ত- অনুরাগীদের। হলিউড-বলিউডের তারকাদের মাস্ক পরা একেকটি ছবি করোনায় মৃত্যু বা আক্রান্তের খবরের সমান্তরালে নিউজ ট্রিটমেন্ট পেয়েছে। মুখে কালো রঙের মাস্ক পরে মার্কিন কয়েক সেনার সঙ্গে জেনিফার লোপেজের ছবিটির কথা উল্লেখ না করলেই নয়। তার সেই সেলফি নেটমাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
প্রেমিক অ্যালেক্স রডরিগেজের সঙ্গেও একই ধরনের মাস্ক পরে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন এই হলিউড স্টার। ভাইরাল হয়েছে সেই ছবিও। মাস্কের কারণে বেশ ক’বার আলোচনায় এসেছেন গায়িকা-অভিনেত্রী লেডি গাগা। তার মধ্যে দু’বার তাঁর মাস্ক রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। প্রথম বার মিউজিক ভিডিয়ো পুরস্কারের মঞ্চে গোলাপি রঙের অদ্ভুত দর্শন মাস্ক যেমন চমকে দিয়েছিল সকলকে। পরে সাদা মাস্কে তার ছবি এবং সঙ্গে শান্তির বার্তা অনুরাগীদের বিস্মিত করেছে। অনেকেই তখন তার সঙ্গে মা মেরির তুলনা টেনে ফেলেছিলেন। বলিউডের প্রিয়ঙ্কা চোপড়াও নতুন করে হিট হয়েছেন মাস্ক পরে। সাধারণ নয়, সাদার ওপরে উপরে প্রিন্ট করা মাস্ক পরে সঙ্গে লিখেছিলেন, ২ মাস পরে প্রথম বার বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন তিনি। আমেরিকার যে ফ্যাশন ডিজাইনার তাঁকে মাস্কটি বানিয়ে দেন, তাঁকেও ধন্যবাদ জানান অভিনেত্রী।
বলিউডের অন্যতম ফ্যাশনিস্তা কারিনা কাপুর দ্বিতীয়বার মা হয়েছেন। নিজেকে নিরাপদে রাখাতে বাড়ি থেকে তেমন বেরোননি তিনি। যখনই বেরিয়েছেন, মাস্ক পরেছেন। সাধারণ এন-৯৫ মাস্ক পরে বিমানযাত্রাও করেছিলেন তিনি। সেই ছবি পোস্ট করেন নেটমাধ্যমে। তার ইনস্টাগ্রামে একটি মাস্ক পরিহিত ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘কোনো কুসংস্কার না ছড়িয়ে, মাস্ক ব্যবহার করুন। সাধারণ এন-৯৫ মাস্কই করিনার কারণে হয়ে উঠেছিল কেতাদুরস্ত। নিয়মিতই মাস্ক পরে ছবি নিজের নেটমাধ্যমে দিয়েছেন মিমি চক্রবর্তী। সাজুগুজুর সঙ্গে মিলিয়ে মাস্কে নিজেকে আরও মানানসই করে তোলেন তিনি। ধূসর রঙের এক মাস্ক পরা ছবি পোস্ট করে ভক্তদের বেশ আকৃষ্ট করেন মিমি। মাস্কে টালিউডের পাওলি দাম দেখিয়েছেন আরেক চমক। তার পরা মাস্কের নাম ‘গামোসা মাস্ক’। এ মাস্ক পরা ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন-সারাদিন এ মাস্ক পরে থাকা যায়। নিজের কন্যাসহ কয়েকজনকে নিয়ে সুতির কাপড়ের উপরে ছাপা মাস্কের ছবি পোস্ট করে নজর কেড়েছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ও।
কেবল মডেলরা নন, মাস্কের সঙ্গে ফ্যাশনকে মিলিয়ে দিয়েছেন বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও। অনেকে এখন ওয়েডিং ড্রেসসহ যেকোনো পোশাকের সঙ্গেই ফ্যাশনেবল মাস্ক ব্যবহার করছেন। ভারতের অনেকেই এই মহামারিতে কার্টুন প্রিন্ট বা এলইডি ফেস মাস্ক ব্যবহার করছেন। তবে পুনে এবং কটকের দুই ব্যক্তি করোনা ভাইরাসের থেকে নিজেদের রক্ষা তৈরি করেছিলেন সোনার মাস্ক। তারা এ মাস্ক পরে রীতিমতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই ফেলে দেন। তাদের এই মাস্কে খরচ পড়েছে ৩ লাখ রুপি। ফ্যাশন ডিজাইনাররা বর্তমানে কটন প্রিন্টেড মাস্কের পাশাপাশি এনেছেন সিল্কের মাস্কও। জমকালো জামা-কাপড়ের সঙ্গে মানানসই সিল্কের মাস্ক বেশ নজরকাড়া। নজরে পড়ার প্রশ্নে ভারতে ফ্যাব মাস্ক। অনেকেই পছন্দ করছেন এই সুতির মাস্ক। শুরুতে চীন বা জাপান থেকে বাংলাদেশে মাস্ক আনা হয়েছে। বর্তমানে দেশি কাপড়ের মাস্কের বেশ চাহিদা। ফার্মেসির পাশাপাশি রাস্তায়, ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে সমানে। বাস-ট্রেনেও প্রচুর কাটতি। অনেকে আবার অনলাইনেও বিভিন্ন নকশা ও মেটেরিয়ালের মাস্ক বিক্রি করছেন। নানা রঙের কাপড়ের মাস্কের উপর বাহারি ডিজাইনের হাতের কাজ করা এ মাস্কগুলো বাজার পাচ্ছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ি বাংলাদেশে করোনা হামারিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিশেষ আইটেম মাস্ক ব্যবহারে ৪ জোড়া সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। ঘরে-বাইরে মিলিয়ে এই ৮টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে তথ্য বিবরণীর মাধ্যমে। এতে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়ে বলা হয়েছে- এক্ষেত্রে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা হু’র মতে, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমানোর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে মাস্ক। মাস্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনাগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে।
১. কয়েক স্তর বিশিষ্ট সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো, যা এককালীন ব্যবহার করতে হবে।
২. অনেকে মাস্ক পরার সময় নাক খোলা রেখে শুধু মুখ ঢেকে রাখেন, যা সঠিক নয়। বরং, ওপরের মেটাল অংশটিকে নাকের সঙ্গে চেপে ও নিচের অংশটিকে থুঁতনির নিচে নিয়ে উভয়ই ঢেকে রাখতে হবে। সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল ঢেকে রেখে মাস্ক পরতে হবে।
৩. অনেকে মাস্ক থুঁতনি পর্যন্ত খুলে রেখে কথাবার্তা বলেন। এটাও ঠিক নয়। এতে লেগে থাকা জীবাণু সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।
৪. সার্জিক্যাল মাস্ক একবার পরে ঘরে রেখে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা উচিত নয়। একটি মাস্ক সর্বোচ্চ একদিন ব্যবহার করে সেটাকে ধ্বংস করে দিতে হবে।
৫. যেসব স্থানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল, যেমন -গণপরিবহন ও বাজার বা দোকানপাট, সেসব জায়গায় মাস্ক পরতেই হবে। পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ও হাত জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
৬. সাধারণ কাপড়ের মাস্ক ব্যবহারের পর অবশ্যই পরিষ্কার করতে হবে। অপরিষ্কার মাস্ক পরলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ব্যবহার করা মাস্ক জীবাণুমুক্ত করতে পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মাস্ক সাবান পানিতে ভিজিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
৭. ভেজা মাস্ক পরিধান উচিত নয়। এতে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
৮. বাইরে গেলে দুটি মাস্ক ব্যাগে রাখা দরকার। মুখে বাঁধা মাস্ক কোনও কারণে নষ্ট হলে বা ভিজে গেলে অন্যটি যাতে ব্যবহার করা যায়।
মাস্ক ব্যবহার বা পরিধান বিষয়ে বাড়তি আর কোনো টিপস লাগে না। উপরোক্ত ৮ নির্দেশনাই যথেষ্ট। মাস্ক বিষয়ক প্রায় সব জিজ্ঞাসার জবাবই এতে রয়েছে। দুনিয়াতে মাস্কের প্রচলন বা শুরুটা কিভাবে হয়েছিল সেই জবাবটা কিন্তু এখনো অজানার মতো। তবে, গবেষণাবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য কনভারসেশন ডট কম এ নিয়ে কিছু তথ্য দিয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, পোল্যান্ডের ব্রেসলাউ (বর্তমানে রোকলা) বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের প্রধান জোহান মিকুলিক্জ একদিন কাজ করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টকালীন হাঁচি–কাশিতে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পান। এরপর, ১৮৯৭ সাল থেকে তিনি মুখে মাস্ক পরতে শুরু করেন। তাঁর মাস্ক ছিল দুটি দড়ির সঙ্গে বাঁধা গজ কাপড়ের একটি বড় টুকরো, যা পুরো মুখ ঢেকে রাখত। পরে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কৌশল হিসেবে মাস্ক ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। রাসায়নিক দিয়ে জীবাণু মারার চেয়ে জীবাণুকে দূরে রাখার দিকেই মনোযোগ দেওয়া হয়। ১৯১০-১১ সালে মাঞ্চুরিয়ান প্লেগ মহামারির সময় মুখ ও নাক ঢাকতে মাস্কের ব্যবহার ছিল। ১৯৩০–এর দশকে মেডিকেল মাস্কের বদলে কাগজের তৈরি মাস্কগুলো জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৬০ সালের দিকে একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া যায় (ওয়ানটাইম ইউজ), এমন মাস্ক তৈরি করা শুরু হয় সিনথেটিক উপকরণ দিয়ে। ফিল্টার দেওয়া মাস্ক আসে আরও পরে।
মাস্ক পরার গুরুত্ব বোঝাতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নিতে হয়েছে কখনো কখনো। উত্তর আমেরিকায়, ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির সময় শহরগুলোতে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরার আদেশ দিতে হয়েছিল। এতে সুফলও আসে। সান ফ্রান্সিসকোর মতো জনবহুল শহরে মৃত্যুর হার কমে এসেছিল। জাপানে স্প্যানিশ ফ্লুর সময় মাস্ককে ভালোভাবে গ্রহণ করেছিল মানুষ। ১৯৭০ সালের দিকে যখন এর টিকা সবার জন্য সুলভ হয়, তখন মাস্ক পরা বন্ধ হয়। ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকে অ্যালার্জি প্রতিরোধের জন্য মাস্ক পরার চল ছিল। চিনেও মাস্ক পরার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। ১৯১০-১৯১১ সালে নিউমোনিক প্লেগ মহামারির সময় ব্যাপকভাবে মাস্ক পরা হতো। ১৯৪৯ সালে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসার পর, যুদ্ধ–পরবর্তী জীবাণু সংক্রমণের ভয় থেকে অনেকে মাস্ক পরতেন। করোনার জেরে দেশে-দেশে কিছু ফ্যাশন হাউস কেবল মাস্কই তৈরি করছে।
পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্কের রং ও নকশা বাছাই করে নেওয়ার ফলে নতুন ফ্যাশনের সুযোগটি হাতছাড়া করছে না সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা বুঝবানরা। বাংলাদেশের দেশের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসও মাস্কের সুন্দর সুন্দর নকশা করছে। দেশীয় সাংস্কৃতিক নকশার মাস্ক এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এর মধ্যে আছে পতাকার নকশায় মাস্ক, গামছা, জামদানির কাপড়ে তৈরি মাস্ক। আরও আছে রিকশাচিত্র, প্রাকৃতিক রং, মোম বাটিকে নকশা করা মাস্ক। একদিকে ফ্যাশনপ্রেমীরা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্ক পরছেন, আরেক দিকে ধর্ষণসহ বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে মুখের মাস্কে। সারা দেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের ঘটনায় বিচারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। রসিকতা করে বলা হচ্ছে, করোনার দাপট চলতে থাকলে চলতি বা পরবর্তী প্রজন্ম ভাবতে বাধ্য হবে নাক-মুখও শরীরের কোনো গোপনাঙ্গ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ