জিডিপির জিলাপি; প্যাঁচের পাঁচালি
৩০ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:৫৩
করোনার বিষ, অবিশ্বাস্য যত দুর্নীতি, চাঞ্চল্যকর সব অনিয়ম-অনাচার, অর্থনৈতিক-সামাজিক এন্তার বিশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য খাতে লুটপাটের মধ্যেও জিডিপির ম্যাজিক বাংলাদেশের। বেকারত্ব-ছাঁটাই, ধর্ষণসহ রোমহর্ষক নারী নির্যাতনের মধ্যেও পরিসংখ্যানের জোয়ারে চুইয়ে পড়ছে উন্নতি। মাথাপিছু আয়-আয়ু সমানে বাড়ছে। আর জিডিপি বাড়ছে পৃথিবীর ধনাঢ্য বহু দেশকেও পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে। পজিটিভ পরিসংখ্যান নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় কেউ পক্ষে। কেউ বিপক্ষে। দু’দিকে যুক্তির ছড়াছড়ি। সাফল্যের ঢেঁকুর আর সংকটের পদধ্বনি সমান্তরালে। ঈর্ষা, তর্ক-বিতর্ক, ভিন্নমত যা-ই থাক জিডিপির এমন সুখবর কার না ভালো লাগে?
বিশ্বজুড়ে বহুল ব্যবহৃত একটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকের নাম ‘গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট’ সংক্ষেপে পরিচিত ‘জিডিপি’। অর্থনীতির মারপ্যাঁচে লুকিয়ে থাকা মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বুঝতে ‘জিডিপি’ নামের সূচকটির মান এবং দণ্ড নিয়ে কথার কোনো শেষ নেই। দুনিয়া যতদিন থাকবে ততদিনেও সেটার নিষ্পত্তি হবে কি-না, কে জানে। পিকে হালদার, মাননীয় এমপি পাপলু, শাহেদ, সাবরিনা, সম্রাট, পাপিয়াদের হাজার-হাজার কোটি টাকা হাতানোর রেসে জিডিপির হারের মিল খুঁজলেই বা কী? এই লীলাভূমে কিছু ভাগ্যবান মানুষের জীবন এমনই উচ্ছল-মত্ত প্রবাহে ধাবমান। তাদের ধন-জন-মান, সুখ- সম্ভোগ-আস্ফালন কেবল বাড়ে। বাড়তেই থাকে। এর বিপরীতে অকথ্য কষ্টে থাকা বেশুমার মানুষকে মিলিয়ে বা তুলনা করে জিডিপির হিসাব মেলে না। দু’টা ভিন্ন বিষয়।
চুরি, লুটপাট, হরিলুট যতই হোক—কৃষক, গার্মেন্ট শ্রমিক আর বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা কাজ করবেই। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পথে নিজের কর্মসংস্থান করবে। করছেও। পথটি বৈধ-অবৈধ যেটাই হোক। মুটে, মজুর, চায়ের দোকানি, সাইকেল-রিকশা-হোন্ডা-গাড়ির মেকানিক, রিকশাওয়ালা, সেলস-কর্মীদের অলস বলার সুযোগ নেই। করোনা আর কলেরা যাই হোক বাংলাদেশের জিডিপি ঈর্ষণীয় জায়গায় যাবে, তা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবিসহ বিভিন্ন মহল আগেই আভাস দিয়ে রেখেছে। তা করোনায় মানুষের আয়-উৎপাদন কমলেও। দারিদ্র বাড়লেও। গোটা বিশ্ব বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও। শেষমেশ তা-ই হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস সাময়িক হিসাবে, বিদায়ী অর্থবছরে (২০১৯-২০) ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে। চলতি অর্থবছরে সেটা ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মহামন্দায় বড় বড় অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলো বিপাকে পড়েছিল। দশকজুড়ে চলে মহামন্দা। নব্বইয়ের দশকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতিতে আসে দুর্যোগ। আর ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন খাত থেকে শুরু হওয়া মন্দা উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু করোনার মতো এমন সর্বজনীন মন্দা আর দেখা যায়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই প্রভাব পড়েছে। কিন্তু ম্যাজিক বাংলাদেশের।
জাতিসংঘ অঙ্ক কষে দেখিয়ে দিয়েছে, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল বাংলাদেশের জিডিপি বাড়ছে। করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে ২০২০ সালে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে সামান্য হলেও বাংলাদেশের মোট জিডিপি বাড়ছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে কাজ করা বিভাগ ইউএন ডেসার (ইউনাইটেড ন্যাশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়ে শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের জিডিপি বাড়লেও ২০১৯ সালের পঞ্জিকা বছরের তুলনায় তা অনেক কমেছে। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল আট দশমিক চার শতাংশ। যেখানে ভারতের জিডিপি ৯ দশমিক ৬ শতাংশ এবং পাকিস্তানের ২ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে বলেও আভাস রয়েছে রিপোর্টটিতে। হবে বলে ধরেও নেওয়া যায়। আর ভিন্ন কিছু ভাবলে এ নিয়ে বিতর্ক করা যাবে।
গত এক দশক ধরেই বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিবিধি নির্ধারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির বিষয়টি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডিসহ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এতে বাগড়া বাধায়। জিডিপি নির্ণয়ের পদ্ধতিগত জিলাপির প্যাঁচে সংস্কার চায় তারা। প্রবৃদ্ধির হারের গুণগত ও বিতরণ সম্পর্কিত বিষয়গুলো বেশি নাড়াচাড়া করতে চায়। করোনার প্রেক্ষাপটে বিশ্বাসযোগ্য জিডিপি হার নির্ধারণের বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে। কয়েক বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হার নিয়ে সাংবাৎসরিক বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এতে বলা হচ্ছে—সরকার ঘোষিত প্রবৃদ্ধি হারের সঙ্গে বেশ কিছু সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন পরিস্থিতি বা সূচক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বেসরকারি খাতের ঋণ, রাজস্ব সঞ্চালন, মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি ব্যয় পরিশোধ, জ্বালানি ভোগ, আমদানি আয়, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ অনেক ক্ষেত্রের পরিস্থিতির সঙ্গে সরকারঘোষিত প্রবৃদ্ধি হারের মিল থাকছে না।
এই প্রসঙ্গে মার্কিন পরিবেশবিদ পল হওফেনের একটি চমৎকার মন্তব্য আছে। তিনি বলেছেন—ভবিষ্যতকে চুরি করে বর্তমানের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার নাম জিডিপি। এই তত্ত্বের সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বীরা বলতে চান—যাদের বর্তমানই নেই, তাদের আবার ভবিষ্যত কোথায়? বর্তমান-ভবিষ্যত কোনোটা না থাকলে ব্যাংক লুট, দুর্নীতি, নৈরাজ্য-অনিয়ম-মিথ্যাচার, হিরোইন আর ইয়াবার কারবার কোনো ঘটনা নয়। এতে বর্তমান-ভবিষ্যতের অপকার-উপকার দু’টাই আপেক্ষিক। উন্নতি-অবনতিও যার যার হিসাবের ব্যাপার। যে যেভাবে তথ্য-সাবুদ জোগাড় বা তৈরি করে পরিসংখ্যান দাঁড় করাবে সেটাই সঠিক। আবার চেপে ধরতে পারলে সেটাই বেঠিক। প্রতিযোগিতা ছাড়া ওপরের পদ মিললে কোয়ালিটির দরকার পড়ে না।
গড়পড়তা বুঝ হচ্ছে—জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানেই দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে আছে। আবার মাথাপিছু জিডিপি দিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বা ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করা হলে একজন কোটিপতি ভোক্তা, বিনিয়োগকারীর কারণে সাধারণ মানুষ সহজেই হিসেবের বাইরে চলে যান। অর্থাৎ, এই গড়ের তুলনা দিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কিংবা বিনিয়োগের ক্ষমতার চিত্র পাওয়া যাচ্ছে না কোনোভাবেই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকেই উন্নয়ন মনে করা হতো। উন্নয়নের এই ধারণা সত্তরের দশকেই বাতিল করেছেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ, প্রবৃদ্ধি যত বাড়ে, আয়বৈষম্য বাড়ে তার চেয়ে বেশি। জিডিপি প্রবৃদ্ধির নিয়ে বিতর্ক যাই থাক, সাধারণ মানুষের কাছে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নির্ণায়ক হলো তাদের দৈনন্দিনের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য। ফলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির বদলে সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য হ্রাস ও আয় বৈষম্য নিরসনের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পেলে কমে আসবে এ নিয়ে বিতর্কের ধূম্রজাল তৈরি হওয়ার সুযোগ।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, বার্তা সম্পাদক; বাংলাভিশন
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি করোনাভাইরাস জিডিপি টপ নিউজ প্রবৃদ্ধি বাংলাভিশন মোস্তফা কামাল