চালে চালবাজ: ধানেও ধান্য
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:৩২
চালে, ধানেও কৃষকের সাফল্য আর সরকারের ভর্তুকি-প্রণোদনার সুফল লুটে খাচ্ছে সিন্ডিকেট। সোজা হিসাবে দেশে ধান-চাল কোনোটারই সঙ্কট নেই। উৎপাদন-মজুদ কোনোটাতেই ঘাটতি নেই। তারপর আমদানিও রয়েছে। এরপরও চালের বাজার গরম। হকদার হলেও গরমের এ তেজের ভাগীদার কৃষকরা হচ্ছে না। সব যাচ্ছে আড়তদার-মজুতদার মিলিয়ে সিন্ডিকেটের পকেটে। ধান-চাল সবদিকেই আছেন তারা।
স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রীও এ চক্রের কথা স্বীকার করেছেন। এরা অচেনাও নয়। সরাসরি সরকারের বিরোধীতাও করছে না। তবে, সরকারের পদক্ষেপকে মাঠে মেরে ছাড়ছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় গঠিত মনিটরিং টিমগুলোকে ব্যর্থ করে ছেড়েছে। সিন্ডিকেটের মারপ্যাঁচে কাবু টিমগুলো। এর জেরে এখন কেবল টিমের ব্যর্থতা নয়, ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন উঠেছে, বেড়ায়ও ক্ষেত খাচ্ছে কি-না? নইলে চেনাজানা হওয়ার পরও কেন এখন পর্যন্ত কারসাজিতে জড়িতদের খুঁজে বের করতে পারেনি মনিটরিং টিম? এর মধ্য দিয়ে চালের বাজার অবিরতভাবে চড়ছেই।
খুচরাবাজারে গত ক’দিন মানভেদে মোটা-চিকন সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত। তা বেশি বিপাকে ফেলেছে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে। এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেশি। এরইমধ্যে চালের বাড়তি দাম এই শ্রেণিটির চোখেমুখে অন্ধকার নামিয়ে আনছে। এ নিয়ে চলতি বছরে অন্তত চারদফা বাড়ল চালের দাম। কেন বাড়ছে চালের দাম-স্পষ্ট জবাব নেই এ প্রশ্নের। উপরন্তু ধান-চাল মিলিয়ে নতুন বিষয় সামনে আনেন। নানান কারণ দাঁড় করানোর পাশাপাশি কেউ দায় সারেন। কেউ দায় চাপান আরেকদিকে। পাল্টাপাল্টি দোষারোপের চাতুরিতে মিলারদের সাফ কথা, ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের দামও বাড়ছে। এছাড়া বন্যা ও বৃষ্টিপাতের কারণে চাতালে ধান শুকাতে না পারায় চালের উৎদন কম। তাই দাম বাড়ছে। পাইকারদের যুক্তি আরেকদিকে। তারা বলেছেন, বোরো মৌসুমের বেশিরভাগ ধান মিলাররা আগেই কিনে নিয়েছেন। তাই ফাঁকা হয়ে গেছে প্রান্তিক কৃষকদের গোলা।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বাঘা-বাঘা কিছু মিলারের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কানেকশন ওপেন সিক্রেটের মতো। তাদেরকে সরকারের মনিটরিং টিম বা আইনপ্রয়োগকারীদের খুঁজে না পাওয়ার কিছু জবাব এখানে বিদ্যমান। আবার চাতাল বা চালকল মালিকরা বলতে চান, এখানে চাতুরি বা চালবাজির কিছু নেই। ধানের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কারণেই বেড়েছে চালের দাম। পাইকার, মিলার, মজুতদার একেক কথা বললেও তাদের নানান কথার যোগফল বা অর্থ একই। কারসাজি-চালবাজি, ঠকবাজিই চালের দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির মূল কারণ। ঘাটতি-কমতি কোথাও নেই।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রির সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ধান-চালের উৎপাদন অব্যাহতভাবে বাড়ছেই। চালের উত্পাদন গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ দশমিক ৫৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বোরো ও আমন মৌসুমের উদ্বৃত্ত উত্পাদন থেকে হিসাব করে, জুন পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে ২০ দশমিক ৩১ মিলিয়ন টন চাল ছিল। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়ে দেশে আরো ৫ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। আর সরকারের গুদামে এখনো ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। তারওপর নভেম্বরের মধ্যে আসবে আউশ ও আমন। তাহলে সমস্যা কোথায়?
সমস্যা না থাকাটাও সিন্ডিকেটের কাছে একটা সমস্যা। তারা সমস্যা পয়দা করে নেয়। নানা যুক্তি-অজুহাত সামনে নিয়ে আসে। করোনা মহামারি, বন্যা, আম্পান-তুফান নানান ছুঁতায় এরা চালের দাম বাড়াচ্ছে। এই চক্রের একটি অংশই আবার সরকারের গুদামে চাল সাপ্লাইয়ার। চলতি বছর সরকারের ধান-চাল কেনার টার্গেট সাড়ে ১৯ লাখ টন বোরো ধান-চাল কেনার। সরকারের ধান-চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা বরবাদ করে দিয়েছেন এরাই। অজুহাত হিসেবে দেখিয়েছেন বন্যা, করোনা, ধানের বেশি দাম ইত্যাদি। দাম ধরা হয়েছিল কেজিপ্রতি বোরো ধান ২৬ টাকা ও সিদ্ধ বোরো চাল ৩৬ টাকা। ২৬ এপ্রিল থেকে ধান এবং ৭ মে থেকে বোরো চাল সংগ্রহ শুরু হয়। গত ৩১ আগস্ট সময় ঠিক করে দেওয়া হলেও ওই সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ধান-চাল সংগ্রহ না হওয়ায় ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। সেই সময়ও গত হয়েছে। এ সময়ে অর্ধেক পরিমাণ ধান-চালও সরবরাহ করা হয়নি। এ অবস্থায় সরকারকে এখন ঝুঁকতে হচ্ছে চাল আমদানির দিকে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন