Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ, থরে-থরে ভুতুড়ে বিল


২৮ আগস্ট ২০২০ ১৮:২৩ | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২০ ১৯:০৮

পরিমাণে অনেক বেশি ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের অভাব কাটিয়ে এনেছে সরকার। যার সুবাদে বিদ্যুতের আসি-যাই অভিশাপ থেকে অনেকটা মুক্ত বাংলাদেশ। কিন্তু এই ভর্তুকি কতো দিন দেওয়া সম্ভব? তাই বিদ্যুৎ ব্যবহারে দেশবাসীকে বরাবরই মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত কয়েক বছরে সরকার কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেনি, সঞ্চালন ব্যবস্থাও করে যাচ্ছে। পল্লী বিদ্যুতের সম্প্রসারণও ব্যাপক। বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেশি হওয়ার বিষয়টি গোপন নয়। ওপেন সিক্রেট। এর সঙ্গে দুঃখজনকভাবে যোগ হয়েছে বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলের ওপেন সিক্রেট কাণ্ডকারখানা। করোনার সময় তা আনুষ্ঠানিকতার মতো আরও ডালপালা ছাড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালের মধ্যে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনার টার্গেট রয়েছে সরকারের। এ টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে দেশে এরইমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হয়েছে চাহিদার চেয়েও বেশি। এক হিসাবে বলা হয়েছে, মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়, বাকি ৫৭ শতাংশই অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। এতে বাংলাদেশে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থ বছরে অলস বসিয়ে রেখে এসব বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। এ কারণে নতুন করে আর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করার সুপারিশ এসেছে বিভিন্ন মহল থেকে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনোমিকস ফাইনান্সিয়াল অ্যানালিসিস-আইইইএফএ নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য অশুভ হবে বলে সতর্ক করেছে। চাহিদা না থাকার পরও যে কোনো প্রকল্প ক্ষতি ডেকে আনে –এটাই স্বাভাবিক।

বিজ্ঞাপন

অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া ছাড়াও ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা বা জ্বালানির খরচ বিশাল। কোনো কেন্দ্র থেকে সরকার বিদ্যুৎ না নিলেও কেন্দ্রভাড়া ও রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। একটি ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রকে বছরে শুধু কেন্দ্র ভাড়াই দিতে হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। সে কারণে বিদ্যুতের প্রয়োজন না থাকলে কেন্দ্র অলস বসে থাকলে বিপুল পরিমাণ লোকসান গুনতে হয় সরকারকে। দেশে এখন বিদ্যুৎখাতের সর্বমোট উৎপাদন সক্ষমতা ১৯ হাজার ৬৩০মেগাওয়াট। গড়ে এ সময় উৎপাদন হচ্ছে সাত থেকে আট হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা না থাকায় বাকি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। অথচ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে সারা দেশে বিশেষত গ্রাম ও মফস্বলে বিদ্যুৎ এখনো অনেক লোডশেডিং হয়। একদিকে সরকারের লোকসান, আরেকদিকে জনগণকে কাহিল করা হচ্ছে ভুতুড়ে বিলে। তা-ও আবার ভুলে নয়, ঠাণ্ডা মাথার কুবুদ্ধিতে। করোনার দুর্যোগ সময়ে এই ‘হারামিপনার’ কিছু ঘটনা ধরা পড়েছে। ভুতুড়ে বিলই বিদ্যুৎ খাতে একমাত্র দুর্নীতি নয়। বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণেও ভয়াবহ দুর্নীতি ও অপচয় হয়ে আসছে।

করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাসের আবাসিক গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল নেওয়া বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। গত তিন মাসের যে বকেয়া বিল গ্রাহকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা দেখে অনেক গ্রাহক এখন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত তিন মাসে কোনো গ্রাহকের বিল দশ গুন, বারো গুন পর্যন্ত বেশি এসেছে। যে গ্রাহকের বিল আসতো মাসে ৩০০ টাকা তার এসেছে ২৫০০ টাকা, যার বিল আসতো ৩ হাজার টাকা তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকার বিল। সিদ্ধান্ত নিয়েই ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড-ডিপিডিসির বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল করেছে। এ নিয়ে ত্রাহি অবস্থা রাজধানীর বিদ্যুৎ গ্রাহকদের। সিস্টেম লস নামের প্রথাগত চুরি গোপন করা ও বাড়তি রাজস্ব দেখিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারফরম্যান্স বোনাসের মতলবেই না-কি এটি করা হয়েছে।

ডিপিডিসির ৩৬টি কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে বেশি বিল করার নির্দেশের তথ্য গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। ওই নির্দেশে এলাকাভেদে ১০ থেকে ৬১ শতাংশ বেশি বিল করতে বলা হয়। কেবল ডিপিডিসি নয়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-আরইবির অধীনে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড-ডেসকো, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডসহ ওজোপাডিকো দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থার গ্রাহকেরা করোনাকালে ভুতুড়ে বিলের খপ্পরে পড়েছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংস্থা আরইবি। ডিপিডিসি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ কোম্পানি হলেও তারা বিদ্যুৎ দেয় মূলত ঢাকার দক্ষিণ ও নারায়ণগঞ্জে। বিদ্যুৎ বিভাগের দাবি, ছয়টি বিতরণ সংস্থার মোট ৬৫ হাজার গ্রাহককে বাড়তি বিল দেওয়া হয়েছিল, যা পরে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু বিতরণ সংস্থাগুলোর নথিপত্র বলছে, এ সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি।

কোথায় আছি আমরা? মানুষকে কতো বেকুব মোয়াক্কেল পেয়েছে বিদ্যুৎ বেপারিরা? খোদ বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুসহ বিদ্যুৎ বিভাগের কয়েক বড় কর্মকর্তার বাসা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের ‘ভুতুড়ে বিল’ গিয়েছে। এ নিয়ে তখন তোলপাড় দেখা দেয়। দায়ীদের শনাক্ত করতে গঠন হয় টাস্কফোর্স।

এ সংক্রান্ত কমিটি পাঁচটি সংস্থার প্রায় ৩শ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে ডিপিডিসির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ চার কর্মকর্তা সাময়িক বরখাস্ত হন। এ ছাড়া ৩৬টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রত্যেক নির্বাহী প্রকৌশলীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে নোটিশ দেওয়া হয়। বদলি করা হয় দুই প্রধান প্রকৌশলীকে। রীতিমতো তামাশা। যে বা যারা এসব কর্মকর্তাকে বাড়তি বিল করার নির্দেশদাতারা অধরাই থাকলেন। বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল এবারই প্রথম নয়। কেবল প্রেক্ষিত ভিন্ন। সাধারণ মানুষের করোনার সর্বনাশের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের একটি চক্রের পৌষ মাস কার্যকর এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রীসহ বড় কর্তাদের ওপর ভুত আরোপ করায় তালগোল পাকিয়ে গেছে। বিদ্যুতের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। যেখানে বেশি মাত্রায় ভর্তুকি দিয়েও ধ্যানে-জ্ঞানে তিনি মানুষকে বিদ্যুতে স্বস্তি দিতে চান, সেখানে কী হচ্ছে এসব? তার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের স্লোগানকে তারা ঘরে-ঘরে ভুত চাপানোর সাহসটা পেলেন কোথায়? করোনার কঠিন সময়ে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে মিটার রিডাররা গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়ে মিটার পরীক্ষা করেননি বা করতে পারেননি। একে সুযোগ হিসেবে নেওয়ার বুদ্ধিটা উদয় হলো কাদের মস্তিষ্কে?

বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো অর্থবছরের শেষ দিকে আয় বেশি দেখানোর জন্য বরাবর বাড়তি বিল করলেও এবার সেই বাড়তি বিলের পরিমাণটা হয়ে গেছে কয়েক গুণ। এতে গ্রাহকেরা ক্ষুব্ধ হলেও প্রতিকার মিলবে না ভেবে অভিযোগ করেননি অনেকে। হৈচৈ পড়ায় এক পর্যায়ে কিছু গ্রাহক অভিযোগ করেছেন। অনেকে যাকে চুরি না বলে বলতে হয় ডাকাতি। প্রতিমন্ত্রী ভুতুড়ে বিলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও ইস্যুটা চাপা পড়ে গেছে প্রায়। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সবগুলো বিতরণ সংস্থার প্রধানকে গ্রাহকদের যেন বাড়তি বিল দিতে না হয়- এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। পরে বিদ্যুৎ বিভাগ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গ্রাহককে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে জানিয়েছে, প্রকৃত বিল থেকে যাদের বেশি বিল এসেছে আগামীতে তা সমন্বয় করে নেওয়া হবে। বাস্তবে, ভুতুড়ে বিল বাতিল করে নতুন করে গ্রাহকদের বিল পাঠানোর কোনো তথ্য আজতক পাওয়া যায়নি। কারো বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার খবরও নেই। এই ভৌতিক চোর-ডাকাতরা গাছাড়া বা অধরাই থেকে যাবেন? কেবল হুকুম পালনকারী কর্মীদের দোষী সাজিয়ে হুকুমদাতা কর্তাদের আড়াল করে রাখা হবে কেন?

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

টপ নিউজ বিদ্যুৎ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর