Thursday 09 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’; আশার আলো দেখাবে ‘ডায়াগনস্টিক কিট’


১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৪৮ | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৭:২৮

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী চলছে চতুর্থ প্রজন্মের শিল্প বিপ্লব। আমরা যখন তার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই হানা দিয়েছে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। এখন শিল্প বিপ্লব নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে আমাদের।

করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশে। কিভাবে করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করা যায় তার পথ খুঁজছে সবাই। করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক এখন তাকিয়ে আছে ডায়াগনস্টিক কিটস, ড্রাগস, ভ্যাক্সিন ডেভেলপমেন্টের দিকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যতো দ্রুত এগুলো উন্নত হবে ততো দ্রুত কোভিড-১৯’কে পরাজিত করতে পারবে মানুষ।

বিজ্ঞাপন

শিল্প বিপ্লবের প্রসঙ্গ টেনে বলতে হয়, প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল সতের শতকে, যার চালিকা শক্তি ছিল পানি ও স্টিম ইঞ্জিন। শুরু হয় যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ আবিষ্কারের মাধ্যমে যা উৎপাদন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে। এরপর শুরু হয় তৃতীয় শিল্প যার ভিত্তি হলো ইলেক্ট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি, যা উৎপাদন ব্যবস্থাকে স্বংক্রিয় করে তুলেছে। এখন আসি চতুর্থ শিল্প বিপ্লব প্রসঙ্গে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো তৃতীয় শিল্প বিপ্লবকে ভিত্তি করে ডিজিটাল বিপ্লব যা ফিজিক্যাল, ডিজিটাল ও বায়োলজিক্যাল প্রযুক্তির একটি ফিউশন।

এই শিল্প বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, থ্রি-ডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, এনার্জি স্টোরেজ, ন্যানোটেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি প্রভৃতি। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, চতুর্থ প্রজন্মের শিল্প বিপ্লবের একটি অন্যতম প্রধান উপাদান হলো বায়োটেকনোলজি বা বায়োলজিক্যাল প্রযুক্তি যা নতুন ডায়াগনস্টিক কিট ডেভেলপমেন্ট, ড্রাগস, ভ্যাক্সিন, জিন এডিটিং, পার্সোনালাইসড ও প্রিসিশন মেডিসিন প্রভৃতি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে।

বিজ্ঞাপন

যেসব ইন্ডাস্ট্রি ডায়াগনস্টিক কিট ম্যানুফেকচার করে সেসব ইন্ডাস্ট্রিকে সাধারণত বায়োটেক বা ইনভিট্র ডায়াগনস্টিক বলে। সামগ্রিকভাবে যাকে মেডিক্যাল ডিভাইস ইন্ডাস্ট্রি বলা হয়ে থাকে। কোন রোগ নির্ণয়ের জন্য ল্যাবরেটরিতে যখন টেস্ট করা হয় তখন দরকার হয় ডায়াগনস্টিক কিট। ডায়াগনস্টিক কিটকে প্রফেশনাল ভাষায় বলা হয় রি-এজেন্ট। কিন্তু শুধু কিট বা রি-এজেন্ট থাকলেই হয় না, এর সাথে দরকার হয় মেশিন বা অ্যানালাইজার। রোগীর নমুনার সাথে কিটের ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে কোন রোগ সৃষ্টকারী উপাদান আছে, কি নাই বা থাকলে কি পরিমাণ আছে তা মেশিনের মাধ্যমে পরিমাপ করা হয়। এই কিট ও মেশিনগুলো খুবই সেনসেটিভ এবং হাইটেক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি। তবে কিছু টেস্ট আছে যেগুলো করতে কোন মেশিনের দরকার হয় না। কিটের প্রধান উপাদান সাধারণত তৈরি হয় বিভিন্ন রকমের কেমিক্যাল, এনজাইম, এন্টিজেন, এন্টিবডি, নিউক্লিক এসিড প্রভৃতির কম্বিনেশনে যা নির্ভর করে ঐ টেস্টের প্রয়োগ ও পদ্ধতির উপর।

ডায়াগনস্টিক টেস্টিংয়ের অনেক ভাগ, সাব ক্যাটাগরি ও স্পেসিয়ারাইজেশন আছে, যার উপর ভিত্তি করে কিট ও কিটের সাথে সম্পর্কিত মেশিনের প্রযুক্তি আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। এটাকে বলা হয় টেস্ট মেথড বা পরীক্ষা পদ্ধতি। যেমন- রক্তের সুগার বা কোলেস্টেরল টেস্ট করা হয় বায়োকেমিস্ট্রি টেস্ট পদ্ধতিতে, আবার হরমোন টেস্ট করা হয় ইম্যুনোলজি বা ইম্যুনোঅ্যাসে টেস্ট পদ্ধতিতে, রক্তের কনিকা গণনা করা হয় হেমাটোলজি এনালাইজার দিয়ে।

বর্তমানে করোনাভাইরাস টেস্ট করা হচ্ছে মলিকুলার ডায়াগনস্টিক টেস্ট পদ্ধতিতে যার প্রধান প্রযুক্তি রিয়েল টাইম পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (RT-PCR)। এই পদ্ধতিতে সংক্রমণকারী ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল তথা ডিএনএ/ আরএনএ সনাক্ত করে তার উপস্থিতি আছে কি নাই তা জানা যায়। আরো আছে ‘পয়েন্ট অফ কেয়ার’ কিট ও ডিভাইস, যেগুলোকে সাধারণত বলা হয় ‘র‍্যাপিড টেস্ট’।

কিছুদিন আগে আমরা দুটি সংক্রমনের মুখোমুখি হয়েছিলাম- চিকনগুনিয়া ও ডেঙ্গু। তখন বহুমানুষের টেস্ট করতে হয়েছে। সেই সময় আমরা দেখেছি টেস্ট কিটের সংকট। যদিও কিট আমদানি করে সেই সংকট মোকাবিলা করেছিল বাংলাদেশ সরকার। বর্তমানে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে নতুন ভাইরাস কোভিড-১৯। দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে খুব কম সংখ্যক মানুষের টেস্ট করা হচ্ছিল। এরপর টেস্টিং সক্ষমতা বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার যা সত্যিই প্রশংসার। ফলে বেড়েছে টেস্টিং সক্ষমতা।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমরা সফল হব এই আশা রাখি। তবে করোনা মোকাবিলা করে বসে থাকলে আমাদের চলবে না, এটা মনে রাখতে হবে যে, ভবিষ্যতে আমরা করোনার চেয়ে কম-বেশি আরো অনেক ধরনের সংক্রমণের মুখোমুখি হতে পারি। এজন্য আমাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের কাছে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। তাদের কয়েকটি পলিসির মধ্যে একটি অন্যতম পলিসি হলো- টেস্টিং। এই টেস্টিং কিটের রসদ যুগিয়েছে তাদের কয়েকটি বায়োটেক কোম্পানি।

আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার হৃদপিণ্ড বলা হয় ডায়াগনস্টিক টেস্টিংকে। উন্নত বিশ্বে মেডিক্যাল ডিসিশন বা চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের ৭০ ভাগই নির্ভর করা হয় ডায়াগনস্টিক টেস্টিংয়ের উপর।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা বলাই বাহুল্য। দেশ যতো উন্নত হবে চিকিৎসা ব্যবস্থার ততো উন্নতি হবে এবং টেস্টিং কিটের ব্যবহার ততো বেড়ে যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাময়িক সংক্রমণে টেস্টের কথা বাদই দিলাম, আমাদের কাছে নিয়মিত টেস্টেরই কোন ডেটা নেই। জানা নেই পাবলিক, প্রাইভেট হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি সবাই মিলে প্রতি বছর গড়ে কতগুলো টেস্ট করে। তবে ধারনা করা যায় যে, প্রতি বছর কয়েকশ মিলিয়ন টেস্ট করা হয়। এই মিলিয়ন মিলিয়ন টেস্ট করার জন্য যেসব কিট ও ইন্সট্রুমেন্ট দরকার হয় তার প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয় আমাদের। ফলে ব্যয় হয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার।

এবার আসি এই ইন্ডাস্ট্রির কারিগর প্রসঙ্গে। ডায়াগনস্টিক কিট ম্যানুফেকচারিং বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রির প্রধান কারিগর মূলত লাইফ সাইন্স গ্রাজুয়েট, যেমন- বায়োকেমিস্ট্রি ও মলিকুলার বায়োলজি, বায়োটেকনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি প্রভৃতি ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষ করে বায়োমেডিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের দেশে প্রতিবছর অনেক লাইফ সাইন্স গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে অথচ তাদেরকে সঠিক কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে না। ফলে মেধার অপচয় হচ্ছে, হচ্ছে মেধাপাচার।

বাংলাদেশে ডায়াগনস্টিক কিট ম্যানুফেকচারিং বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রির বিকাশ হলে দেশে যেমন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, সেই সাথে টেস্টিং কিটের খরচও কমে আসবে। যা আমাদের স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদান রাখবে।

চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ও ভারত কিট ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক এগিয়ে গেছে। আমাদেরও এই ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো কিছু করার সুযোগ আছে। দেশীয় বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করে বিলিয়ন ডলার আয় করার সুযোগ আছে আমাদের।

তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও ভবিষ্যৎ সংক্রমণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বায়োটেক ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমরাও কিট ম্যানুফেকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতে আমাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করতে পারব।

প্রসঙ্গত, গণস্বাস্থ্য ও আর. এন. এ বায়োটেকের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ও টেস্ট কিট ডেভেলপমেন্ট আমাদের আশার আলো দেখায়।

লেখক: বায়োকেমিস্ট; ডায়াগনস্টিক প্রডাক্টস, কোয়ালিটি ও অ্যাপ্লিকেশন এক্সপার্ট

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর