Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নিরাপত্তাহীন নারী, উদাসীন রাষ্ট্র!


৮ মার্চ ২০২০ ১২:০৫ | আপডেট: ৮ মার্চ ২০২০ ১৩:০৭

একটি সমাজের উন্নয়নের প্রমাণ দেয় তার নারী ও শিশুর নিরাপত্তাব‌্যবস্থা। সমাজে নারী ও শিশু যদি স্বাচ্ছন্দ‌্য চলাচল করতে না পারে, তাহলে ওই সমাজের নিরাপত্তব‌্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ এ দেশ কৃষি-শিল্পসহ বেশকিছু খাতে উন্নয়ন করলেও নারীর নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ‌্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। বরং আপাতত নিরাপদ স্থানেও নারী-শিশু ধর্ষণ-যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

শুধুই কি ধর্ষণ-যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারী? এর বাইরেও আছে বহুমুখী মানসিক-শারীরিক নিপীড়ন। সেই নির্যাতন ঘর থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত সব জায়গায়ই চলে। ঘরে পরিবারে সদস‌্যদের হাতে যেমন, তেমনি কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী বা ঊর্ধ্বতনদের হাতে নির্যাতনের শিকার হতে হয় নারীকে। অথচ রাষ্ট্র তার অর্ধেকের বেশি নাগরিক, এই নারীর নিরাপত্তায় সচেতনতা সৃষ্টিতে ব‌্যর্থ হয়েছে।

নারীর নিরাপত্তাহীনতার প্রসঙ্গ উঠলে প্রথমে আসে তার ঘরের কথা। বিয়ের আগে নারী তার ঘরের অন‌্য সদস‌্যদের হাতে নিগ্রহের শিকার হয়। বিষয়টি এতই সূক্ষ্ণ যে, অনেকেই স্বীকারও করতে রাজি নন। কারণ, খাদ‌্যাভ‌্যাস-পোশক নির্বাচন, ঘর পছন্দ, চলাফেরার ক্ষেত্রে নারীকে নানামুখী বাধার মুখে পড়তে হয়। তার ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে গেলে নির্বিঘ্ন জীবনযাপনে নেমে আসতে পারে হুমকি। সেই হুমকি প্রকট নাও হতে পারে। হতে পারে প্রচ্ছন্নভাবেও। অর্থাৎ মা-বাবা থেকে শুরু করে বাড়ির অন‌্য অভিভাবকরাও মেয়ে সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন নন। তারা বরং কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেন মেয়ে সন্তানদের জন‌্য। ওইসব বিধিনিষেধ মেনে চলতে গেলে ছেয়ে সন্তানরা যেমন বেপরোয়া চলার প্ররোচনা পায়, তেমনি মেয়ে সন্তানরা পায় স্বাভাবিক-স্বাচ্ছন্দ‌্যে চলার পথেও বাধা। এর ওপর বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলে মেয়ে সন্তানকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু তার জন‌্য যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা বিচার করা হয় না।

ঘরের বাইরে গেলে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম। ঘরের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও থাকে নারীর জন‌্য নানা ধরনের শেকল। একই বিষয়ে পুরুষ যে ভঙ্গিতে মতপ্রকাশ করতে পারে, একই বিষয়ে নারী পারে না। পুরুষের সমান্তরালে নারী চলতে গেলেই তাকে হতে হচ্ছে ব‌্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার। এর প্রতিবাদ করতে গেলে তার ওপর নেম আসছে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের খড়গ। এছাড়া, প্রতারণা-হুমকি দিয়ে নারীকে তার সহপাঠী থেকে শুরু করে পুরুষ শিক্ষকের হাতে ধর্ষণের শিকারও হতে হচ্ছে। শিক্ষকের হাতে ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পরিমাণ এত বেশি যে বিষয়টি এখন বহুল পরিচিত অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পর নারীকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হতে হয় তার কর্মক্ষেত্রে। কর্মস্থলে পুরুষ সহকর্মী থেকে শুরু ঊর্ধ্বতনের হাতে নারীর মানসিক-শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা এখন বহুলশ্রুত বিষয়। কর্মস্থলে নারীর উপযুক্ত পারিশ্রমিক-পদ-পদোন্নতির বিষয় স্বাভাবিকভাবে হয় না। এ জন‌্য তাকে অনেক সময়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

গণপরিবহনকে আজও নিরাপদ বাহনে পরিণত করতে পারেনি রাষ্ট্র। এই নিত‌্যদিনের যানবাহনকে নারীর জন‌্য নিরাপদ করার জন‌্য দৃশ‌্যমান কোনো  উদ‌্যোগও নেই। না সরকারিভাবে, না বেসরকারি পর্যায়ে। অথচ কেবল রাষ্ট্রের সচেতনতার অভাবে গণপরিবহনে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারীকে হতে হচ্ছে ধর্ষণের শিকার। হারাতে হচ্ছে প্রাণ। কখনো কখনো প্রাণ নিয়ে বেঁচে গেলেও শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন থেকে  মুক্তি মিলছে না। তারা পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রে যেমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতেও শারীরিক-মানসিক নিপীড়নের পাশাপাশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কখনো কখনো প্রতিপক্ষের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে প্রাণও হারাতে হচ্ছে তাদের।

নিজের ঘর থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চলার পথ থেকে শুরু করে কর্মস্থল— কোথাও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি রাষ্ট্র। অথচ  সংবিধানের ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, ‘নারী-পুরুষভেদে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না।’ কিন্তু রাষ্ট্র তার সংবিধান মেনে তার প্রতি বৈষম‌্য দূর করতে পারেনি। পারেনি নারীকে নিরাপত্তা দিতেও।

নারীর ও পর নির্যাতন রোধে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০ (সংশোধনী ২০০৩)’-এর ১০ ধারায় যৌনপীড়নের শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর, নিচে ৩ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সঙ্গে অর্থদণ্ডও রয়েছে। এছাড়া, যদি নারীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা কিংবা তাকে অশোভন অঙ্গভঙ্গি করে, তাহলে সর্বোচ্চ সাত বছর কিংবা নিচে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে অর্থদণ্ডের বিধানও। আর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত‌্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইন থাকলেও প্রমাণের অভাবে অনেক অপরাধীই পার পেয়ে যায়। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয় না।

এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না যে কেবল আইন করে কিংবা আইনের প্রয়োগের মাধ‌্যমেই অপরাধ বন্ধ করা যাবে না। অপরাধ বন্ধের জন‌্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। আর তাতে নাগরিকদের উৎসাহ-প্রণোদনা রাষ্ট্রকেও দিতে হবে। তাহলেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে— সমাজ নারী-পুরুষের মধ‌্যে বৈষম‌্য তৈরি করবে না। একইসঙ্গে শিক্ষাব‌্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। পাঠ‌্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে নারী-নিপীড়নবিরোধী বিষয়।

পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল ও চলার পথকে নারীর জন‌্য নিরাপদ করতে হলে রাষ্ট্রকে বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। এর আগে, উদ‌্যোগ বাস্তবায়নে গঠন করতে হবে একটি বিশ্বস্ত কমিটি। ওই কমিটি নারীর প্রতি সহিংসতার সম্ভাব‌্য কারণ নির্ণয় করবে, সমাধানের পথ বাতলে দেবে। সমাধানের জন‌্য প্রয়োজনীয় সুপারিশমালা পেশ করবে। তবে, কমিটির সুপারিশের পাশাপাশি যে বিষয়টি রাষ্ট্রকে করতে হবে, সেটি হলে সমাজে সচেতনতা তৈরি করা। পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল থেকে শুরু করে যাতায়াতের পথ ও যানবাহন, সবক্ষেত্রের সংশ্লিষ্টদের সচেতন করে তুলতে হবে। এই জন‌্য প্রয়োজনে একটি সেল গঠন করে লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। ওই সেলের সংশ্লিষ্টরা সতেনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে কাজ করবেন।

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ‌্য করা হয়েছে ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’। এই প্রতিবাদ‌্য সফল করতে হলে পরিবারের সদস‌্য থেকে শুরু করে সহপাঠী ও সহকর্মীদের বোঝাতে হবে নারীর সম্মান-মর্যাদার বিষয়টি। না হলে এবারের প্রতিপাদ‌্যটি কেবল স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে, বাস্তবতার মুখ কখনোই দেখবে না। এজন‌্য রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। দূর করতে হবে রাষ্ট্রের উদাসীনতা। তবেই নিশ্চিত হবে নারীর নিরাপত্তা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

ধর্ষণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন নারীর নিরাপত্তা যৌন হয়রানি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর