Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীর নিরাপত্তা কোথায়?


৬ জানুয়ারি ২০২০ ১৬:৩৭ | আপডেট: ৭ জানুয়ারি ২০২০ ১৩:৩৮

ঢাকা সেনানিবাসের নিকটে রাজধানীর কুর্মিটোলা এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ওই শিক্ষার্থীর একজন সহপাঠী জানিয়েছেন, রোববার বিকেল সাড়ে ৫টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে ওই শিক্ষার্থী বান্ধবীর বাসায় যাচ্ছিলেন। কুর্মিটোলা বাস স্টেশনে নামার পর তাকে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি অনুসরণ করতে থাকে। মাঝপথে তাকে ধরে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করে। ঘটনাটি সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন

এই ঘটনায় তোলপাড় চলছে, ধর্ষকের গ্রেফতার ও বিচারে পথে নেমেছেন পড়ুয়া, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। স্লোগান উঠেছে দ্রুত বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই।

মাত্র ক’দিন আগে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে, বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতাও। কঠোর আইন, প্রচার-প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না৷ আসক-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২জন৷ অর্থাৎ, গত বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

আসক-এর রিপোর্টই শুধু বলছে না, এমনিতেও এমন এক ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে— ধর্ষণ একেবারে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এই মেয়েটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বলে সামাজিক মাধ্যমে, মূল ধারার মাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের সরকার, প্রশাসন হয়তো বুঝে উঠতে পারছে না ধর্ষণ কমাতে বা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে করণীয় কী?

খুন, ডাকাতি, অপহরণের চেয়েও যেন ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটছে। রাষ্ট্র নারীদের প্রশাসনে এবং রাজনীতিতে যোগদানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে, অর্থনীতিও উন্মুক্ত বাজারে নারীর শ্রম ও উৎপাদন কৌশলের মর্যাদা দিচ্ছে। কিন্তু সমাজ পীড়ন করে নারীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তা না হলে পুলিশ সপ্তাহের শুরুতে, সন্ধ্যা ৭টায় একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সেনানিবাসের কাছে ধর্ষণের শিকার হতে পারে?

আসক-এর প্রতিবেদন আমাদের চিন্তিত করে, ক্ষুব্ধ করে। আমাদের নাগরিক সমাজ রজপথে নামে, সামাজিক মাধ্যমে গলা চড়ায়, শহীদ মিনারে গিয়ে মোমবাতি প্রজ্বালন করে। কিন্তু ধর্ষকরা তাদের কাজটা ঠিকই করে যায়। ধর্ষণ কোনো পুরুষের শুধুমাত্র যৌন ইচ্ছা পূরণ নয়, এর একটি অন্য উদ্দেশ্য আছে। পুরুষতন্ত্র, ক্ষমতা প্রদর্শন, আধিপত্য বজায় রাখার একটি উপায় হলো নারীদের নির্যাতন করা, ধর্ষণ করা। এগিয়ে চলা নারীকে বুঝিয়ে দেওয়া যে তার ওপর পুরুষের নির্যাতন করার ‘ক্ষমতা’ আছে।

বিজ্ঞাপন

ধর্ষণ, নারীর প্রতি সহিংসতা বৃহত্তর সামাজিক অন্যায়ের বড় প্রকাশ। ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে তাই গুরুত্ব দেওয়া এবং তার প্রতিকার করা সরকারের জন্য অত্যন্ত জরুরি কাজ। রাষ্ট্র এ বিষয়ে তার কর্তব্য থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে এমনটা না বললেও কোথাও না কোথাও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা আছে, সে কথা বলতেই হবে। এটা এ কারণে বলছি যে একবছরে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

ধর্ষণের অভিযোগের বেশিরভাগই তদন্ত শেষ হয় না, আদালতেও নিষ্পত্তি হয় খুব কম। আমাদের উদ্বেগটা সেখানেই। প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য উপস্থিত করা কঠিন বলে প্রমাণের অভাবে বহু ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা মুক্তি পেয়ে যায়। কোনো কোনো এলাকায় অভিযুক্তরা ক্ষমতার প্রভাবে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করে রাখে। উল্টো যেটা হয়, ভিকটিমরাই তাদের করুণাপ্রার্থী হয়ে বেঁচে থাকে।

তদন্ত ও বিচারের স্তরেই অভিযোগ পৌঁছাতে না পারলে ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। সবাই বলছে, ধর্ষণের শাস্তি হতে হবে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আমরা বলতে চাই, শাস্তির কঠোরতার চেয়েও শাস্তির নিশ্চয়তা অপরাধীদের নিরস্ত করে বেশি। সেখানেই আমাদের সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা। তাই পরিস্থিতিকে সেই নিরিখে দেখতে হবে।

ধর্ষণ একটি গুরুতর শারীরিক নিগ্রহ, অমার্জনীয় নির্যাতন। দেহ বা শরীরের ওপর যে ব্যক্তি-অধিকার, সেই মৌলিকতম অধিকারটি নারীকে দিতে নারাজ এই সমাজ। সমাজকে সভ্য হতে হলে এই মৌলিক অধিকারটি নিশ্চিত করতেই হবে, এ ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর নাই।

সমাজে উদারতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া হাতে নিলে, ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কার না কমালে উপায় বের হবে না। অনেক জায়গায়ই প্রভাবশালীদের উদ্যোগে ধর্ষণের ক্ষেত্রে অত্যাচারের শিকার যে, তার সঙ্গে নিগ্রহকারীর বিয়ে দিয়ে বোঝাপড়া করা হয়। এটি যে নিগ্রহকারীর প্রতি কত বড় সংবেদনশীলতা, আর নিগৃহীতার প্রতি কী ভয়ংকর অসংবেদনশীলতা সেটা বুঝবার সঙ্গতি খুব কম লোকেরই আছে। অপরাধের সমাধান এভাবে হয় না। যিনি আক্রান্ত হন, নির্যাতিতা হন, ধর্ষণের শিকার হন, তাকে বা তার পরিবারকেও বুঝতে হবে তাদের যে অধিকার দলিত হয়েছে, তা কেবল ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা আর্থিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে পূরণযোগ্য নয়।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের চিত্রটি ভয়াবহ। বেশিরভাগ ঘটনায় অপরাধীদের সাজা হয় না এটাই সাধারণ ধারণা। এ ছবি বদলাতে হলে প্রশাসনিক সক্রিয়তার পাশাপাশি অদক্ষতাকে আগে চিহ্নিত করতে হবে। বিশেষ বিশেষ ঘটনায় নয়, নাগরিক সমাজের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে সব ঘটনায়, যেন রাজনৈতিক পর্যায়ে একটা অঙ্গীকার জন্ম নেয়।

লেখক: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ডটনেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি

কুর্মিটোলা টপ নিউজ ঢাবি শিক্ষার্থী ধর্ষণ মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর