Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গণরুম: বন্ধুত্ব বনাম ছারপোকা


১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৩:২০ | আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৬:৫০

প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিশব্দ হতেই পারে ‘স্বপ্ন’। কারণ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের হাজারও শিক্ষার্থীর একমাত্র স্বপ্নই থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা।

এসব স্বপ্নবাজদের কারও ভালোবাসা থাকে লাল ইটের কার্জন হলের ঘাসে বা সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আড্ডাবাজি। কেউ চায় মধুর ক্যান্টিন বা টিএসসিতে বসে দেশ-রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্কে মশগুল থাকতে। অনেকে আবার সেন্ট্রাল লাইব্রেরির আর্কাইভে খুঁজে বেড়ায় দেশ-বিদেশের নানা বই। এমন নানান হাতছানি আর স্বপ্নের হাত ধরেই শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু বা নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের পথচলা।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সবচেয়ে বড় আলোচনা-সমালোচনার বিষয়বস্তু হয় ‘গণরুম’। কি হয় এই গণরুমে? কেনই বা তা আলোচনা সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে?

তিন দশক পর গেল মার্চে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নির্বাচনের ইশতেহারের অন্যতম ইস্যু ছিল গণরুম প্রথা বিলুপ্তকরণ। প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম হলো- হলগুলোতে আবাসন সংকটের কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কোনো এক রুমে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর অবস্থান।

গণরুম  নিয়ে কেন এত আলোচনা-সমালোচনা? কারণটা মূলতঃ রাজনৈতিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের আগে কোনো বৈধ সিট পাওয়া যায় না। প্রশাসনের এমন ব্যর্থতাকে এড়িয়ে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য গণরুম পদ্ধতিতে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছে। সেটা নিয়েই এত আলোচনা।

বিজ্ঞাপন

মতামতের ভিন্নতা থাকতে পারে- কারও কারও কাছে এটি একটা পরিবার ও আনন্দঘন স্থান, যেখানে এক বালিশে তিন-চারজন ঘুমান। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- এই এক বালিশে গাদাগাদি করে ঘুমানোর কারণেই গড়ে ওঠে এলাকা, বিভাগ নির্বিশেষে এক স্বার্থহীন বন্ধুত্ব। এক খাবার ভাগ করে খেয়ে হয়তো দশজনের পেট ভরে, তারপরও মুখে থাকে অমলিন হাসি ও পরিতৃপ্তি। পরিবার ছেড়ে আসা, অচেনা অজানা শহরে বিপদে বা  অসুস্থতায় পরম ভরসা হয়ে হাত ধরে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া সে সব বন্ধুরাই। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের একমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে যায় গণরুম যা ধনী-গরীব-মধ্যবিত্ত বা সকল ডিপার্টমেন্টের সবাইকে এক সূতায় বাঁধে।

গণরুমের এত ভালো দিক শুনে অনেকে রেগেও যেতে পারেন, সেটা খুব স্বাভাবিক। কারণ এই রুমে প্রচণ্ড গরমে আট জনের জায়গায় ৩০ জন গাদাগাদি করে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে ঘুমায়। কখনো পালা করেও ঘুমাতে হয় রাতে। ছারপোকার কামড় বা একের শরীরের এলার্জি ছড়িয়ে পড়ে আরেকজনের শরীরে। প্রচণ্ড শীতের রাতে সিঙ্গল লেপের মধ্যেই তিনজন গা গলিয়ে দেয়।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মশার কামড়, শীত বা গরমের দাপটে অনেক সময় সারারাত না ঘুমিয়ে সকালের ক্লাস মিস হবে এখানে। এটাও গণরুমের বাসিন্দাদের জন্য খুব স্বাভাবিক ঘটনা। কিংবা ক্লাসে বের হওয়ার সময় সামনে একজোড়া স্যান্ডেলের একপাটি পাওয়া গেলো এবং শেষ পর্যন্ত দুপায়ে দুজোড়া স্যান্ডেলের দুপাটি পরে  ক্লাসে যাওয়া। কখনো কখনো ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় ক্লাসের লেকচার শোনার বৃথা চেষ্টা চলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ছাত্র রাজনীতির প্রাণভোমরা হলো এই গাদাগাদি, ঠাসাঠাসির ছোট ছোট গণরুম। আদর্শের চর্চার পাশাপাশি এখানকার রাতজাগা তমুল আড্ডায় কি না থাকে? ক্লাস, সমাজ, সংস্কৃতি, দেশ, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক অঙ্গণসহ আরও কত কিছু। কারও ব্যক্তিগত সমস্যা, কষ্ট, অভিমানও থাকে গণরুমেরে এই চার দেয়ালের মাঝে। এখানে কার টি-শার্ট কে পরছে বা কার স্যান্ডেল কে দখলে রাখছে সে ব্যাপারে সকলেই উদার।

রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্য কথাটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহুল কথিত বিষয়। অনেক সময় রাজনৈতিক অসৎ উদ্দেশ্যের শিকার হয় গণরুমের শিক্ষার্থীরা। যা বেশ লক্ষ্যণীয়।

আবাসন সমস্যা সমাধান ও পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়া পর্যন্ত গণরুমপ্রথা বাতিল হয়তো হবে না। কিন্তু এ প্রথা পরিমার্জন করা সম্ভব।

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এসব শিক্ষার্থীর স্বপ্নের নামই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে খেয়াল রাখতে হবে সেসব শিক্ষার্থীদের স্বপ্নগুলো যেনো অঙ্কুরেই বিনষ্ট না হয়।

মো. সামিউজ্জামান: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

গণরুম ছারপোকা ডাকসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢা‌বি