Tuesday 07 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর হবে কবে?


১৩ মার্চ ২০১৯ ১৪:৪৬ | আপডেট: ১৩ মার্চ ২০১৯ ১৫:২০

।। রাজু আহমেদ ।।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোয় নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে বাড়ি ভাড়া। কোনো কারণ না দেখিয়েই বছর বছর ভাড়া বাড়িয়ে চলেছেন বাড়িওয়ালারা। জীবনযাত্রার সব ব্যয়ের সঙ্গে আবাসন খাতে দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানোর কারণে বিপাকে পড়ছেন লাখ লাখ ভাড়াটিয়া। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে দেশে সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও এর প্রয়োগ না থাকায় বাড়িওয়ালারা তাদের খেয়াল খুশিমতো ভাড়া নির্ধারণ করছেন।

কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা মহানগরীর ৭০ শতাংশ মানুষই তাদের মোট আয়ের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া খাতে ব্যয় করেন।

ক্যাবের তথ্যমতে, গত ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৪০০ শতাংশের বেশি। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ২৭৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে বেড়েছে ২৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০০০ সালে এ বাড়ার হার ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০০৩ সালে বাড়ি ভাড়া বেড়েছিল ১৮ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০০৫ সালে বাড়ি ভাড়া বাড়ে ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০০৬-২০০৮ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ি ভাড়া বাড়ে। ২০০৬ সাল থেকে গত ১০ বছরে ভাড়া বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

ক্যাবের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, রাজধানীতে ১৯৯০ সালে পাকা ভবনে দুই কক্ষের একটি বাসার ভাড়া ছিল ২ হাজার ৯৪২ টাকা। ২০১৫ সালে সেই ভাড়া দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১৫০ টাকা। বর্তমানে এই ভাড়া এসে ঠেকেছে ২১ হাজার ৩৪০ টাকায়।

বাড়িওয়ালারা সাধারণত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, হাউজ বিল্ডিংয়ের ঋণের প্রদেয় অর্থ, সিটি করপোরেশনের কর, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানিসহ পরিষেবা খাতের বিল বৃদ্ধির অজুহাতে ভাড়া বাড়িয়ে থাকে। তবে পরিষেবার খরচ বা কর যতটুকু বাড়ে, ভাড়া তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের আয় বাড়ার প্রশ্নটি থাকে উপেক্ষিত।

বিজ্ঞাপন

বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে এলাকাভেদে বাড়ি ভাড়ার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। উত্তরার কম ঘনবসতিপূর্ণ পর্যাপ্ত পরিষেবাপ্রাপ্ত এলাকায় বাড়িভাড়া তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরিষেবা অপর্যাপ্ত হলেও ভাড়া বেশি। বাড়ির আয়তন ও প্রাপ্ত পরিষেবার ভিত্তিতে ভাড়াটেদের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজধানীর বাড়িভাড়া সংক্রান্ত নীতিমালা সরকারের অবিলম্বে নির্ধারণ করা উচিত।

বিভিন্ন গবেষণায় রাজধানীতে বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়ার দু’টি মূল কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো— আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এবং চাহিদার তুলনায় ভাড়া বাড়ির সংখ্যা কম থাকা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হিসাবে ঢাকায় বাড়িঘরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ। এর সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার করে নতুন বাড়ি যোগ হচ্ছে। রাজধানীতে প্রতি বছর আবাসন সুবিধা বাড়লেও এখানকার জনসংখ্যা বাড়ছে তার চেয়ে বেশি হারে।

ভাড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ড নামে সরকারের একটি বিভাগ থাকলেও এর কোনো কার্যকারিতা নেই। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১’ এবং ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৬৪’ শীর্ষক দু’টি আইন বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু কোনো বাড়িওয়ালাই এ আইন মানেন না বলে ভাড়াটিয়াদের অভিযোগ। অর্থের বিনিময়ে সব রকম প্রাতিষ্ঠানিক সনদ ও অনুমতি সহজলভ্য বলে অধিকাংশ বাড়িওয়ালা এসব আইনের বিষয়ে আগ্রহী নয়। একইসঙ্গে ভাড়াটিয়াদের অজ্ঞতার কারণে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না।

আইন অনুযায়ী, জোরপূর্বক ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু ক্যাবের এক জরিপে দেখা গেছে, ভাড়া দিতে বিলম্ব হলে ২৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ১২ শতাংশ বাড়িওয়ালা পেশীশক্তি ব্যবহার করে ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করেন। ২ বছরের ব্যবধান ছাড়া ভাড়া বাড়ানো দণ্ডযোগ্য অপরাধ হলেও অনেক বাড়িওয়ালা একবছরে দু’বার বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কোনো ভাড়াটিয়া বাড়ি ভাড়া নিতে গেলেই বাড়িওয়ালা এক থেকে থেকে ছয় মাসের ভাড়া বা থোক অর্থ অগ্রিম দাবি করেন। অগ্রিম অর্থ প্রতিমাসের ভাড়া থেকে বাড়িওয়ালার ইচ্ছানুযায়ী কর্তন করা হয়। পরে এর চেয়ে বেশি অগ্রিম পেলে অথবা বেশি ভাড়ায় নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়া গেলে পুরানো ভাড়াটিয়াদের একমাসের নোটিশে উচ্ছেদ করা হয়। শুধু ভাড়া বাড়ানোর জন্য অনেক বাড়িওয়ালা ঘন ঘন ভাড়াটিয়া বদল করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাড়ি ভাড়া থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আয় করলেও অধিকাংশ বাড়িওয়ালাই কর ফাঁকি দেন। নিয়ম অনুযায়ী সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ওপর ১২ শতাংশ হারে সিটি করপোরেশনকে কর দিতে হয়। কিন্তু প্রায় সব বাড়িওয়ালাই বাড়ি ভাড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ কম দেখিয়ে থাকেন। তারা এ খাত থেকে ৬০ হাজার টাকা পেলে কগজে-কলমে ৬ হাজার টাকা দেখান। পরিষেবা খাতে প্রদেয় বিলের ক্ষেত্রেও তারা একই পথ অবলম্বন করে থাকে। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে প্রতি পাঁচ বছরে একবার বাড়িভাড়া মূল্যায়ন করার কথা থাকলেও ১৮ বছর ধরে তা হয়নি। এর ফলে শুধু সিটি করপোরেশনই নয়, সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

লাগামহীনভাবে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। মধ্যবিত্তের বাসযোগ্য বাড়ি ভাড়া প্রতিবছর বেড়ে যাওয়ায় তাদের জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হয়। মাসিক আয়ের বড় অংশ বাড়ি ভাড়ায় চলে যাওয়ায় খাদ্য, পোশাক ও সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় জোগাড় করতে অনেকেই বাধ্য হয়ে ছোট-খাটো দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এ কারণেই দেশে সর্বস্তরে দুর্নীতি নির্মূলের জন্য বাড়ি ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতের অতিরিক্ত ব্যয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি এবং ভাড়াটিয়াদের প্রতি বাড়িওয়ালাদের বিরূপ আচরণ বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি।

রাজু আহমেদ: প্রধান প্রতিবেদক, জিটিভি

সারাবাংলা/এমএনএইচ

বাড়ি ভাড়া রাজু আহমেদ

বিজ্ঞাপন

কিশোর অপরাধ, আমাদের করণীয়
৭ জানুয়ারি ২০২৫ ১৭:০১

আরো

সম্পর্কিত খবর