আমরা তোমাদের ভুলিনি, ভুলবো না
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১১:১৫ | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:১৫
প্রভাষ আমিন ।।
চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। সন্তানের ছবি হাতে মায়ের আহাজারি, সবার চোখ ভিজিয়ে দিয়েছিল। ৭০টি লাশের মুখে পিতা খুঁজে ফিরছিলেন সন্তানের মুখ। কী ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য। যে কারও পক্ষেই আসলে চোখের পানি আটকে রাখা মুশকিল। সেদিনই পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় স্বজন হারানো একজনের সাথে কথা হচ্ছিল। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনের পরিস্থিতি টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে দেখতে তিনি ফিরে গেলেন ১০ বছর আগে। বিডিআর বিদ্রোহ অবসানের পর তিনিও স্বজনের খোঁজে পিলখানায় ঢুকেছিলেন। পিলখানাজুড়ে তাণ্ডবের চিহ্ন, ম্যানহোলে লাশ, গণকবরে লাশ- বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ১০ বছর কম সময় নয়। সময় শোক অনেক কমিয়েছে বটে, কিন্তু মনে হলেই ফিরে আসে শোকের সে ঢেউ। শুধু সেই স্বজনহারা জন নন, গোটা জাতির জন্যই দিনটি গভীর বেদনার।
শুরুতেই বলে নেই ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ এই টার্মের ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যা হয়েছে, তা মোটেই কোনো বিদ্রোহ নয়। বিদ্রোহ করে বিপ্লবীরা, মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহ এখনও আমাদের গর্বিত করে, অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তেমন কোনো ‘বিদ্রোহ’ ছিল না। কিছু ছেলেমানুষি ক্ষোভের কথা বলে তখনকার ‘বিডিআর’এর উশৃঙ্খল জওয়ানরা নির্বিচার হত্যাকান্ড চালিয়েছে। আমি একে ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ না বলে ‘বিডিআর তাণ্ডব’ লিখবো। বিডিআর জওয়ানরা যদি সত্যি সত্যি তাদের বঞ্চনা থেকে বিদ্রোহ করতো, তাহলে তারা ঊর্ধ্বতন কাউকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করতো। কিন্তু তারা সেটা না করে প্রথম সুযোগেই সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে। তার মানে দাবি আদায় করা নয়, তাদের আসল লক্ষ্য ছিল হত্যা। আমার এখনও মনে হয়, দেড়মাস বয়সী সরকারকে উৎখাত বা অস্থিতিশীল করতেই পিলখানায় এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র দেড়মাসের মাথায় এত বড় ঘটনা সামাল দিয়েছিলেন খুব ঠাণ্ডা মাথায় দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সাধে। আমার ধারণা সে ঘটনা সামাল দিতে পেরে তিনি যে আত্মবিশ্বাস পেয়েছিলেন, তা ভবিষ্যতে অন্য অনেক কাজে তাকে সাহসী করেছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ চালাচ্ছেন তিনি।
যিনি গেছেন, তিনি আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হলে স্বজনদের বেদনা কিছুটা হলেও উপশম হয়, শান্তি পায় শহীদদের আত্মা। কিন্তু ১০ বছরেও শেষ হয়নি বিডিআর তাণ্ডব বিচারকাজ। বিস্ফোরক মামলার বিচারকাজ এখনও চলছে। হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে রায় হলেও আটকে আছে উচ্চ আদালতে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর নিম্ন আদালতের রায়ে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। আরো ২৫৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদের সাজাসহ ৫৬৮ জনের সাজা হয়। তবে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্ট ১৫২ জনের মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসি বহাল রাখেন, যাবজ্জীবন হয় ১৮৫ জনের, ২০০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। কিন্তু হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় না পাওয়ায় দণ্ডিতরা আপিল করতে পারছে না, তাই আটকে আছে রায় কার্যকরের প্রক্রিয়াও। আসামি সংখ্যা ও সাক্ষীর সংখ্যা বিবেচনায় এটি গোটা বিশ্বেই একটি বৃহৎ মামলা। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে তাই বাড়তি সময় লাগবেই। তবুও আমি মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, তিনি যেন হাইকোর্টের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। যাতে মামলাটি শেষ ধাপে অর্থাৎ আপিল বিভাগে যেতে পারে। গোটা জাতি শোক বিহ্বলতা নিয়ে এই রায় কার্যকরের জন্য অপেক্ষা করছে।
বিডিআর তাণ্ডব বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনার একটি। সেদিন ৫৭ জন সেনা অফিসারসহ ৭৪ জন মারা গিয়েছিলেন। প্রতিটি মানুষের জীবনই মূল্যবান। কিন্তু একটি ঘটনায় ৫৭ জন সেনা অফিসারের মৃত্যুর ক্ষতি কোনোদিনই পূরণ হবার নয়। যখন আপনি জানবেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ৪৭ জন সেনা কর্মকর্তা শহীদ হয়েছিলেন, তখন বুঝবেন উশৃঙ্খল জওয়ানরা সেদিন আমাদের কতটা ক্ষতি করেছে। একজন সেনা কর্মকর্তা একদিনে তৈরি হন না। ‘বিডিআর’ এর নাম বদলে বিজিবি হয়েছে, ভাই হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে আরো দক্ষতার সাথে কাজ করছে সেনাবাহিনী। কিন্তু সেই শোক কোনোদিন ভুলবার নয়। ১০ বছর পরও তাই স্বজনরা, বন্ধুরা, এমনকি জাতি শোকাচ্ছন্ন থাকে। মেজর জেনারেল শাকিল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী, কর্নেল মজিবুল হক, কর্নেল আনিসউজজামান, কর্নেল মসীউর, কর্নেল কুদরত ইলাহী, কর্নেল গুলজারসহ উজ্জ্বল সেনা কর্মকর্তাদের জাতি ভোলেনি, কোনোদিন ভুলবে না।
প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক।
সারাবাংলা/পিএম
২৫ ফেব্রুয়ারি কর্নেল আনিসউজজামান কর্নেল কুদরত ইলাহী কর্নেল গুলজার কর্নেল মজিবুল হক কর্নেল মসীউর পিলখানা প্রভাষ আমিন বিডিআর বিদ্রোহ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাকির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী মেজর জেনারেল শাকিল শেখ হাসিনা সেনাকর্মকর্তা