Monday 06 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমাদের সম্প্রচার ভাষা


২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৪:৪৮

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ আছে। প্রবন্ধে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষত এফএম রেডিও ও বেসরকারি টেলিভিশনে বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলায় উদ্বেগ জানিয়ে লিখেছিলেন, ভাষাদূষণ হচ্ছে প্রধানত দুটি ক্ষেত্রে: উচ্চারণে ও শব্দব্যবহারে।

এই অভিযোগ অনেকদিনের। কারও কারও অভিমত এমন যে, এসব দূষণ ঠেকাতে দেশে একটি ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বেতার বা টেলিভিশনে আমরা যে বাক্য লিখি বা বলি তা যে ভাষায় কবিতা বা সাহিত্য লেখা হয়, যে ভাষায় সংবাদপত্রে বড় বড় প্রবন্ধ লেখা হয়, সেই ভাষা নয়। সম্প্রচার সাংবাদিকতার সময় এই ভাষা এড়িয়ে চলতে হয়, কারণ ওই ভাষা এই ধরনের সংবাদমাধ্যমে প্রয়োগ করলে দর্শক বা শ্রোতা বুঝবেনা। কঠিন ও জটিল ভাষা প্রয়োগ হলে তা সাধারণত জনমানসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে না। আমরা বলি আমাদের ভাষা একদম আলাপের ভাষা, তবে ব্যাকরণে সিদ্ধ। সহজ করে বলা, কিন্তু ব্যাকরণের বাইরে গিয়ে নয়।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের সম্প্রচার জগতে গত দুই দশকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের সম্প্রচার জগত বলতে ছিল রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার। একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে বেসরকারি সম্প্রচার জগতের যে যাত্রা শুরু হয় তা এখন অনেক বিকশিত। আমাদের জনগণ ব্যাপক হারে ভারতীয় চ্যানেল দেখে। তবুও, বাংলা অনুষ্ঠান, সিনেমা, নাটক ও সংবাদ সম্প্রচার দেখতে আমাদের চ্যানেল তাদের পছন্দ। বর্তমানে আছে তিরিশটিরও বেশি চ্যানেল। আছে অনেকগুলো এফএম রেডিও। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশে আমাদের চ্যানেলগুলো সম্প্রচারিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে এবং যুক্তরাষ্ট্রে লন্ডনে কয়েকটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবী জুড়ে রকমারি কাণ্ডকারখানা ঘটছে, বিজ্ঞান ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রসরমাণ, নিত্য-নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক আদান-প্রদানের সূত্রে অনেক নতুন নতুন শব্দের ভিড়। স্বাধীন দেশ বাংলাদেশও ব্যস্ত আন্তর্জাতিক ভূমিকায়। প্রতিনিয়তই অনেক নতুন বিদেশি শব্দের মুখোমুখি হচ্ছি। সেই ভাষা কতটুকু প্রয়োগ করব নিজের ভাষার সাথে সে এক বড় জিজ্ঞাসা। কিন্তু ভাষা ব্যবহারে সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীদের অসাবধানতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা আছে।

আলাপের ভাষা ব্যবহার করতে হয়, সহজ করে বলতে হয়, কিন্তু ঠিক করে বলতে হবে। এই চ্যালেঞ্জটা একজন সম্প্রচার মাধ্যমের কর্মীর প্রতিদিনের। মুখের ভাষা আর লেখার ভাষা প্রায়ই একরকম হয় না। সম্প্রচার মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটি মনে রাখা লাগে তাহলো সহজ করে বলা যেন যারা শুনছে বা দেখছে, তারা যে শ্রেণিরই হোক, যে শিক্ষাগত যোগত্যাই থাকুক, যেন বুঝতে পারে। দ্রুত সহজ করে বলতে হবে বিধায় সবকিছুই করতে হয় একদম সংক্ষেপে। বাক্য আর শব্দ, সবই শোনার জন্য, তাই আলাপের মত করে লিখতে হয় যেন বলতে সুবিধা হয়।

বাংলাদেশে গত দশকে সম্প্রচার মাধ্যমের ব্যাপক বিকাশের সাথে সাথে এই মাধ্যমে উচ্চারিত ভাষা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে বেসরকারি এফএম রেডিওগুলোর আরজে নামের উপস্থাপকরা যে উচ্চারণে, যে টানে বাংলা বলেন তা ঠিক বাংলা ভাষা নয়। কিছু কিছু টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও সেই ভাষা প্রয়োগ হতে দেখছি। যারা এটি করছেন বা এই টানকে গ্রহণ করছেন, তারা হয়তো বলবেন তারা নতুন একটি ভাষা নির্মাণের চেষ্টা করছেন। তারা হয়তো বলবেন এটি নাগরিক জীবনের ভাষা। বিতর্ক না করে শুধু এটুকুই বলা যে, ভাষা এগুবে, এগিয়ে যাবে, তবে তার শুদ্ধ রূপ নিশ্চয়ই হারিয়ে যাবেনা।

সম্প্রচার মাধ্যমে প্রমিত বাংলার চর্চা একটু কঠিনই হয়ে যায় অভ্যাস না থাকলে, কারণ এই মাধ্যমে সংবাদ বা যেকোন তথ্য মুখে বলতে হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা দর্শক বা শ্রোতার সামনে নিয়ে আসতে হয়। এই তাৎক্ষণিকতায় শুদ্ধতা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু মনে রাখতেই হয়, সম্প্রচার মাধ্যমে শুদ্ধতার কোন বিকল্প নেই।

গণমাধ্যম অনেক বেশি মানুষের দোরগোড়ায়। তাই এর ভাষা অবশ্যই প্রভাব ফেলছে মানুষের কথা বলায়। অনেকের সাথে একমত হয়েই বলতে হচ্ছে প্রকৃতির মত ভাষা বদলাবে ঠিকই, তবে তার মধ্যেও একটা স্বাভাবিকতা থাকতে হবে। ভাষার পথ চলাটি যেন মানুষকে, সমাজের অনেকদিন ধরে চলা উচ্চারণকে আঘাত না করে। সম্প্রচার মাধ্যম গণমানুষের মুখের কথাই বলে, তবে শুদ্ধতার সাথে। মানুষকে তথ্য আর বিনোদন দিয়ে দিয়ে সম্পচার মাধ্যম হয়ে উঠছে মানুষের জীবনযাত্রার অন্যতম অংশ এখন।

যেহেতু সংখ্যায় বেড়েছে, তাই মানুষের কথা বলায় এর প্রভাবও পড়ছে অনেক। তাই আমাদের সম্পচার মাধ্যম নিজস্ব সংস্কৃতি জেনে বোঝে ভাষার ব্যবহার করবে এটা প্রত্যাশিত। জগাখিচুড়ি বা শঙ্কর ভাষা আমরা শুনতে চাইনা সম্প্রচার মাধ্যমে। আইতাছি, যাইতাছি বলে যে ভাষা ব্যবহার করে একটা ভাষা তৈরি করলেন কিছু নাট্যকার, তারা সেই ভাষা সাধারণ মানুষ থেকে নেননি। ইচ্ছে মতো তৈরি করা সেই ভাষা আজ চেপে বসেছে সমাজে।
আমাদের সম্প্রচার মাধ্যমে সবচেয়ে খারাপ ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে বিজ্ঞাপনে আর কিছু কমেডি নাটকে। প্রমিত, আঞ্চলিক, দেশি, বিদেশি সব এক করে যা উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিদিন তা এক কথায় অতি নিম্নমানের ভাষা।

আমরা নিশ্চয়ই বিদেশি ভাষা শিখব, তবে প্রাণের ভাষা মাতৃভাষা বাংলাকে আমাদের বিকাশ আর উন্নয়নের ভাষা হিসেবে সাথে করে এগুতে চাই। সম্পোচার মাধ্যম দ্রুততার সাথে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। তাই এখানে সম্প্রচার মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারে যত্নবান না হলে ভাষার সৌন্দর্য হারায়। শুদ্ধতার মাধ্যমে শুদ্ধ থাকাটাই প্রত্যাশিত

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, প্রধান সম্পাদক, সারাবাংলা ও জিটিভি

লেখকের আগের নিবন্ধ: চা, সিঙ্গারা, সমুচা

সারাবাংলা/এমএম

অমর একুশে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস একুশে বাংলা ভাষা ব্যকরণ ভাষা শহীদ সম্প্রচার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর