যেনতেন পাশ ফেলের পরীক্ষা নয়, চালু হোক সত্যিকারের পরীক্ষা
৬ মে ২০১৮ ১৪:০১ | আপডেট: ৬ মে ২০১৮ ১৪:০৭
এসএসসি ও সমমানে গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী। ১০ বোর্ডে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ জন। এর মধ্যে পাস করেছে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন।
আপাতত এটুকুই খবর। এখন এই ছেলেমেয়েদের নতুন লড়াই শুরু হবে পরবর্তী ধাপ অতিক্রম করার জন্য। প্রশ্নপত্র ফাঁস নামক এক আতঙ্কের ভেতর দিয়ে এই বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সময় কেটেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ফল গ্রহণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “আমি মনে করি এবার যেহেতু পরীক্ষার্থীর সংখ্যাও বেশি, তাই সংখ্যার হিসেবে কিছুটা আমাদের পাসের হার কম মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে বলবো, সেটা খুবই হতাশাজনক না। কারণ ৭৭ দশমিক ৭৭শতাংশ পাস করা এটাও কিন্তু কম কথা নয়”।
হ্যা কম কথা নয়। তবে ভাবনার বিষয় বটে। কারণ এই যে আমাদের সমাজ, এখানে শুধুই পরীক্ষায় পাশ করার মধ্য দিয়ে জীবনে পূর্ণতা খোঁজা হয়। আমাদের সাফল্যলিপ্সা এত প্রবল যে, তা যেনতেন প্রকারে হাতিয়ে নিতেও কুণ্ঠিত হই না। বরং কখনও কখনও কুৎসিতভাবেই মরিয়া হয়ে উঠি। আর সেজন্যই প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো জঘন্য কাজে এক শ্রেণির শিক্ষক আর অভিভাবকের যোগসূত্রও পাওয়া যায়। যে চিত্র আমরা দেখেছি গত কয়েক বছর ধরে।
প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত, পরীক্ষা যেন একটা প্রকল্প। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষের চেয়ে প্রাইভেট পড়ানো বেশি পছন্দ করেন, কোচিং নামের এক দানবের কাছে সকলেই অসহায়। ছেলেমেয়েদের জীবন তৈরি করে দিতে গিয়ে বাবা-মায়ের, বিশেষ করে মায়েদের জীবন হয়ে ওঠে ঘাম- চিটচিটে। সবাই ভাল ফল চায় – অভিভাকরা চায়, স্কুল, কলেজগুলো আরও বেশি করে চায়। কারণ যে প্রতিষ্ঠানের রেজাল্ট যত ভাল, সেখানকার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর চাহিদা তত বেশি।
এক মূল্যহীন কিন্তু অমূল্য পরীক্ষা-ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে শিক্ষা ব্যবস্থা। আমরা জানি, বুঝতে পারি শিক্ষার্থীরা মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে, যারা শিক্ষাদান করছেন, তাদের দায়িত্বপরায়ণতায় ও দায়বদ্ধতায় ফাঁকি আছে। নিজের প্রতিষ্ঠানেতো বটেই, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরির সাক্ষাতকারে উপস্থিত থেকে দেখেছি সাধারণ বাংলা বলতেই বহুবার হোঁচট খায়, যুক্তাক্ষরের উচ্চারণ জানে না। ইংরেজিতো দূর অস্ত। হাতে সার্টিফিকেট, অথচ তার নিজের বিষয়ে প্রশ্ন ধরলেই উত্তর আসেনা।
বড় নগরীর বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়া বাংলা মাধ্যমের অধিকাংশ স্কুলেরই সংকটময় অবস্থা। শহরাঞ্চলেতো বটেই, প্রান্তিক পর্যায়েও অভিভাবকদের মনে ধারনা হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যমে না পড়লে জীবন মাটি।
শিক্ষার্থীর মনে ভয়ের ছায়া দীর্ঘায়িত হবে— এমন পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাক। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হতে পারলেই, একদিকে যেমন পরিবারের মুখ উজ্জ্বল হয় সেই সঙ্গে আমার দেশের মুখও উজ্জ্বল হয়। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম তারা সুশিক্ষিত হবে। উচ্চশিক্ষিত হবে। তারা দেশের কর্ণধার হবে। সেটাই আমাদের কামনা। তারা যেন উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে, সেটাই আমরা চাই”।
এটাই আসল কথা। সবার সমান মেধা নয় ঠিকই, কিন্তু একটু যত্নবান হলেই নতুন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়। আগ্রহ-মনোযোগ বাড়লে, ভালোবাসা জাগলে সাফল্য যে নিশ্চিত, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জোর করে চাপিয়ে দিয়ে হয় না, পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা জাগাতে হয়—সে কাজে তৎপরতার অভাব এখন যথেষ্ট।
শিক্ষকদের অনেকেরই মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। অন্য জীবিকার সঙ্গে শিক্ষকতাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। মানুষ গড়ার কারিগর তিনি—এই বোধ ও ভাবনা জাগুক তাদের মনে, এমনটাই প্রত্যাশা।
তবে পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোর উন্নতি জরুরি। তার চেয়ে বেশি জরুরি পরিবেশ। খুশি খুশি মুখে ছোট শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীরা স্কুল কলেজে আসুক, হাসি হাসি মুখে পড়ুক-লিখুক এবং পরীক্ষা দিক। পরিবর্তন আসুক। যেনতেন পাশ ফেলের পরীক্ষার বদলে সত্যিকারের পরীক্ষা চালু হোক। ছাত্রজীবনের শুরুতেই সিরিয়াসনেস তৈরি হোক, এটাই চাই।
একটা কথা বলতেই হবে, সব শিক্ষার্থীই সম্ভাবনাময়। প্রয়োজন তাদের মধ্যে সম্ভাবনার যে বীজ আছে, সেই বীজে শিক্ষককুল জল সিঞ্চন করবেন, রাষ্ট্র শিক্ষাজগতে শুধু অর্থ নয়, একটু নীতিরও বিনিয়োগ করুক।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা.নেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি
সারাবাংলা/এমএম