হাঁটলেন খালেদা, জিতলেন সবাই
৭ এপ্রিল ২০১৮ ২০:৫৪ | আপডেট: ৮ এপ্রিল ২০১৮ ১২:৫৯
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ ছিল— ‘দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পরিত্যাক্ত কারাগারের যে কক্ষটিতে রাখা হয়েছে, সেটি স্যাঁতসেঁতে; বসবাস উপযোগী নয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেই তার সঙ্গে সরকারের এই আচরণ।’
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া ভালো নেই। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। অমন পরিবেশে টানা দুই মাস কারাবন্দি থাকার পর কারো পক্ষেই ভালো থাকা সম্ভব নয়।’
কারাকর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরাও সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘খালেদা জিয়া অসুস্থ। তার হাত ও হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কয়েক গজ পথ হাঁটতে তার অনেক সময় লেগেছে।’
বিএনপি নেতা ও সরকারি চিকিৎসকদের এমন বক্তব্যের পর সবাই ধরে নিয়েছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আনা হবে। তাকে ধরে তুলতে হবে, ধরে নামাতে হবে। তার সেই পরিপাটি পোশাক, মার্জিত অবয়ব, বনিয়াদি সাজগোজ, দৃঢ়চেতা চলন-বলন আর দেখা যাবে না। মলিন চেহারা, ব্যথায় কাতর শরীর এবং মানসিকভাবে অস্বস্তিতে থাকা এক খালেদা জিয়াকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিএসএমএমইউতে আনবে কারাকর্তৃপক্ষ।
কিন্তু শনিবার (৭ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১১টায় বিএসএমএমইউ’র কেবিন ইউনিটের সিঁড়ির গোড়ায় মিতসুবিসি জিপ থেকে যে খালেদা জিয়াকে নামানো হলো, তিনি এক অন্য খালেদা জিয়া। মানুষের ধারণার ‘খালেদা জিয়ার’ সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়েছিলেন খালেদা জিয়া। সেই থেকে যে কোনো উচ্চতার গাড়িতে ওঠা-নামার জন্য কাঠের একটি অতিরিক্ত সিঁড়ি বা টুল ব্যবহার করেন তিনি। কারাকর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বিষয়টি মাথায় রেখে খালেদা জিয়ার জন্য কাঠের সিঁড়ি প্রস্তুত রেখেছিল।
গাড়ি থেকে নামার পরই বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রি. জেনারেল আব্দুল্লাহ আল হারুন সালাম দিয়ে তাকে হুইল চেয়ারে বসার অনুরোধ জানান। কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে সে অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে হাসিমুখে ধীর ধীরে লিফটের দিকে এগোতে থাকেন খালেদা জিয়া।
দুই মাস পর এই প্রথম মানুষের ভিড়ের মধ্যে হাঁটছেন তিনি। চেহারায় নেই ক্লান্তির ছাপ। পরিপাটি পোশাক, যত্নে পাট করা চুল, মার্জিত সাজগোজ, মুখে বনিয়াদি হাসি— যেমনটি মানায় একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা বড় একটি দলের চেয়ারপাসনকে ঠিক তেমনটিই!
তাহলে দলের সিনিয়র নেতারা এত করে যে বললেন, তাদের নেত্রী অসুস্থ! দাবি তুললেন বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানোর। চিকিৎসকরাও তো বলেছিলেন, খালেদা জিয়া হাঁটতে পারছেন না। হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে! তাহলে সবাই অসত্য কথা বলেছেন?
বোধ হয় না! সবগুলো মুখ এক সঙ্গে অসত্য বলতে পারে না! বিএনপির শীর্ষ নেতা, সরকারি চিকিৎসক— সবাই মিলে অসত্য বলতে যাবেন কেন?
শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও সেটি নেতা-কর্মী, সমর্থক ও দেশবাসীকে বুঝতে দিতে চাননি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি তার অসুস্থ শরীরটাকেই মনের জোরে সোজা রেখেছেন, যাতে করে সারা দেশের নেতা-কর্মী সমর্থক সর্বপরি দেশবাসী বুঝতে পারে খালেদা জিয়া সুস্থ আছেন। প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
অর্থাৎ খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার জয় হয়েছে বিএসএমএমইউতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময়। এক্স-রে করার জন্য কেবিন ব্লক থেকে পাশের বিল্ডিংয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তিনি শুধু শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দেননি— দিয়েছেন রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরচিয়ও।
শুধু তাই নয়, অনেকটা রিজার্ভ থাকতে অভ্যস্ত খালেদা জিয়া এদিন হাসপাতাল থেকে বেড়োনোর সময় হাসপাতাল ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী জনতার ‘হাত নাড়া’ অভিভাদন হাত নেড়েই গ্রহণ করেছেন।
এ তো গেল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক বিজয়। সরকার কি জেতেনি খালেদা জিয়ার এই স্বস্তিদায়ক দুই ঘণ্টার স্বাস্থ্য পরীক্ষায়? বিএনপি নেতারা যেখানে ক্রমাগত বলছিলেন, বসবাস অযোগ্য স্যাঁতসেঁতে কক্ষে রাখায় খালেদা জিয়া মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েছেন। তার সুস্থতা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে বিএনপি এবং গোটা দেশ!
বিএনপি নেতাদের ওই শঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে সরকার তো এখন বলতেই পারে খালেদা জিয়া বেশ আছেন। তার তেমন কোনো সমস্য নেই। বিএনপি নেত্রীর স্বাভাবিক চলন-বলন, পরিপাটি পোশাক, মার্জিত সাজগোজ প্রমাণ করে, কারাগারে যথাযথ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন খালেদা জিয়া। সুতরাং বিএনপি নেতারা যে অভিযোগগুলো করছেন, তা সত্য নয়। রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যই বিএনপি নেতারা ভিত্তিহীন বক্তব্য দিচ্ছেন।
অর্থাৎ গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে লিফটে উঠে এবং কেবিন ব্লক থেকে রেডিওলজি বিভাগে গিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন নিজের দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের চাঙ্গা রাখার রাজনীতিতে সফল হয়েছেন। আবার খালেদা জিয়ার এই দুই ঘণ্টার স্বাভাবিক মুভমেন্টে ক্ষমতাসীন দলও রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হয়েছেন। তারা অন্তত দেখাতে পেরেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা পাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
কিন্তু মুখ তো আর বন্ধ থাকে না। নয়াপল্টনে তো বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সব সময় প্রস্তুত। তিনি তার বৈকালীন ‘সংবাদ বিবরণি’তে বলে দিয়েছেন, ‘একজন পর্দানশীন মুসলিম নারী হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়াকে ওড়না ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি।’
এ রকম আরও অনেক ইস্যু নিয়ে কথা বলতে পারবেন বিএনপি নেতারা। যে কথার সঙ্গে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন মিলবে না। বিএনপি নেতারা হয়তো বলবেন, তাদের নেত্রী মারাত্মক অসুস্থ। তিনি হাঁটতে চলতে পারছেন না। আর খালেদা জিয়া হয়তো অসুস্থ থাকা সত্বেও দল ও নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা রাখতে সোজা পায়ে হেঁটে চলবেন।
লেখক: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, সারাবাংলা.নেট