‘ শিক্ষকদের কেন যেনো আপন মনে হতো’
৫ জানুয়ারি ২০১৮ ২২:০৭
মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: ২৬-শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা। অফিস থেকে বের হওয়ার পাঁয়তারা করছি। বার্তা সম্পাদকের কাছে বলতে গিয়েই ধরা খেয়ে গেলাম। তিনি তার মোবাইলটি হাতে দিয়ে বললেন ‘এই নম্বরে ফোন দিয়ে দেখ লোকটি কে? কী বলতে চায়। ‘ সঙ্গে সঙ্গে ফোন দিলাম। ‘হ্যালো, মাহমুদুন্নবী ডলার বলছেন? জী, বলছি। এরপর যেটা জানলাম তা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির দাবিতে তারা সারাদেশ থেকে শিক্ষকরা এসেছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। এখানে তারা অবস্থান কর্মসূচী পালন করবেন। আমরা গণমাধ্যম যেনো তাদের পাশে দাঁড়াই। সেসময় বিষয়টি ততোটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।
পরদিন ১১টার পরপর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে কিছুটা বিস্মিত হই। যা ভেবেছিলাম তা নয়। এরা সংখ্যায় অনেক। তবে সে তুলনায় মিডিয়া কম। দুপুরের দিকে একটা সাদামাটা স্টোরি লিখলাম। এরপর থেকে প্রতিদিন নিয়মিত ফলোআপ করতে থাকলাম তাদের আন্দোলনটি।
আন্দোলনের সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি তা হলো সারাদেশ থেকে যে শিক্ষকরা এসেছেন তারা বেশ শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন। শীতের রাতে শতশত শিক্ষক রাস্তায় ঘুমাচ্ছেন। না খেয়ে কষ্ট করছেন তারপরও তবুও আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার কথা মুখেও আনেননি। ধীরে ধীরে মিডিয়ার উপস্থিতি বাড়তে থাকে। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার শুরু করে। সারাবাংলায়ও গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হতে থাকে শিক্ষকদের সংবাদ।
৩১ ডিসেম্বর, প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে। বাসা থেকে একটু দেরি করে বের হয়েছিলাম। মনের মধ্যে শঙ্কা ছিল এই বুঝি অফিসের ফোন এলো। নিউজরুম থেকে কেউ হয়তো ফোন করে বলবেন, ‘ শিমুল ভাই শিক্ষকদের আন্দোলনের কী খবর, ছবি দেন, ভিডিও পাঠান’। এমন উদ্বেগে গুলিস্তানের চিরচেনা ফুটপাত দিয়ে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে প্রেসক্লাব এলাকায় আসলাম। ভাগ্য ভাল অফিসের কোনো ফোন আসেনি।
প্রেসক্লাবের পূর্ব গেট দিয়ে ঢুকে সামনে যতো এগোচ্ছি ততোই স্পষ্ট বুঝতে পারছি আন্দোলন আজ যেনো আরো উত্তাল হয়েছে। যেতে যেতে ব্যাগ থেকে ট্যাবটা বের করে অন করলাম। ঝটপট ছবি তুললাম। ভিডিও করলাম। এরপর জানতে পারলাম আজ থেকে অবস্থান কর্মসূচী আমরণ অনশনে রূপ নিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে শিক্ষক নেতারা এমন ঘোষণা দিয়েছেন। মিডিয়ার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো। বেড়ে গেলো সারাবাংলার কাভারেজও।
সেখান থেকে ফিরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আসলাম। মূল খবরের সঙ্গে লিখলাম একটা সাইড স্টোরি। শিরোনাম দিলাম, ‘মেয়েডারে বলে আসিছি, আমি আর ফিরবো না’। খুলনার শিক্ষিকা সাগরিকা মজুমদারের কষ্টগুলো তুলে ধরেছিলাম সে লেখায়। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে দু:খ থাকে। তবে বেতন ছাড়া চাকরি করা শিক্ষকদের মনে যে দু:খের পাহাড় তা সাগরিকা মজুমদারের প্রতিটি কথায় যেন উঠে আসে। অভাব-অনটন আর পারিবারিক-সামাজিক বঞ্চনাকে কী করে রাষ্ট্র দীর্ঘায়িত করে তার একটা ক্ষুদ্র ইতিহাস যেনো সাগরিকা।
পরদিন শিক্ষকদের সঙ্গে আবারো কথা বলি। প্রত্যেকটি শিক্ষক যেনো দু:খের একেকটি অন্ধকার কূপ। যেখান থেকে উঠতে চাইলেও ওঠা সম্ভব নয়। কেবল রাষ্ট্রই সে কূপ থেকে তুলে আনতে পারে। অসহায় এসব শিক্ষকের কাউকে চিনিনা। আমার এলাকার কাউকেও দেখলাম না। তারপরও অসহায় এসব শিক্ষকদের দেখে কেনো যেনো আপন মনে হতে শুরু করলো। অনেক শিক্ষকের চোখের পানি দেখিছি। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কী অকপটে নিজের ঘরে খবর, হাঁড়ির খবর বলে দেন শিক্ষকরা। কী খান, কীভাবে চলেন, সন্তানদের পড়ালেখা কী করে চলে, পরিবারে-সমাজে কতভাবে হেনস্থা হন তারা সবকিছুই কত আপন ভেবে বলেন তারা। তাদের সে বঞ্চনা আর কথা শুনতে শুনতে কখনো আবেগী হয়ে পড়েছি। আবার কখনোবা সাহস যুগিয়েছি।
২ ডিসেম্বর। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বক্তব্য দিচ্ছেন। সামনে টিভি ক্যামেরাগুলো জটলা করে আছে। সংবাদকর্মীতে ঠাসা। ভীড় ঠেলে ভেতরে গেলাম। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার গায়ে ধাক্কা লাগায় তিনি কিছুটা ক্ষিপ্ত হলেন আমার ওপর। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে অফিস থেকে দেওয়া ট্যাবলেটের সদ্বব্যবহার করলাম।
তখনো ভাবিনি, কাজ আরো বাকি। একটু পরই শিক্ষামন্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন শিক্ষকরা। বুঝলাম ভালো নিউজ হবে। ছবি ভিডিও দুটোই নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ফোনে অফিসে জানালাম, ‘ শিক্ষামন্ত্রীকে প্রত্যাখান করেছে শিক্ষকরা’। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো লাইভে ব্যস্ত হয়ে উঠছে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে কোনফাঁকে যেনো কেটে পড়লেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
পরে সারাবাংলায় নিউজ লিখলাম ‘নাহিদের আশ্বাস, মানিনা মানবো না’ এ শিরোনামে। প্রথমে এ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। একটু পরেই অফিসে ফোন করলাম আমার দেওয়া শিরোনামেই সংবাদ প্রকাশিত হলো। এরপর থেকে প্রতিটা নিউজই প্রত্যাশা অনুযায়ি প্রকাশ করেছে টিম সারাবাংলা। এরমধ্যে সাতক্ষীরার রাবেয়া বসরীকে নিয়ে লেখা ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো পাঠক মহলে ভালোই সাড়া ফেলেছে।
প্রতিদিন ভোরে অফিসের ফোন আসে। আমি বিছানায় শুয়েই একটা ভাব নিয়ে ফোন রিসিভ করি। যাতে অফিস বুঝতে পারে আমি অলস নই। প্রেসক্লাব এলাকায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। এরপর ফোনে নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারি ফেডারেশনের সভাপতি না হয় সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে একটু খোঁজ খবর নেই। সে অনুযায়ী নিউজরুম একটি ফলোআপ প্রতিবেদনও তৈরি করে। কিছুটা নির্ভার হয়ে পরে অনশন স্থলে আসি।
সোমবার আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। নিজ থেকেই সেটি নেইনি। আজ শুক্রবার সেটি পুষিয়ে দেওয়ার কথা ছিলো সেটিও হলো না। বৃহস্পতিবার রাতে ফোন করি অফিসে। ও পার থেকে জানানো হল‘ শিমুল রাগ করিস না ভাই, শনিবার ডে-অফ নিস’। রাগ করাতো হলোই না বরং উল্টো বললাম ঠিক আছে, আমি আছি। সময়মতো প্রেসক্লাবে থাকবো।
সকালে একটি মিটিং ছিল। সেটা করে আসতে প্রায় দুপুর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভাগ্য বরাবরের মতো ভাল যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরি মাত্র বক্তব্য শুরু করেছেন। তার ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে দিয়ে নিউজ রুমে ফোন দিলাম। ডেস্কের সহকর্মীদের হাত হয়ে যেভাবে বলেছিলাম ঠিক সেভাবেই একটা নিউজ বের হয়ে আসলো। তবে বিপত্তি বাঁধলো ছবি আর ভিডিও নিয়ে। অফিস থেকে বলা হলো সেগুলো নাকি যায়নি। একটু রাগও হলাম। কিন্তু ওভার ফোনে সেটা প্রকাশের যথাযথ সুযোগ পেলাম না হয়তো। আমাকে অনুরোধ করা হলো আবার পাঠানোর জন্য।
বিকেলে বাসায় গেলাম। একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। কিছুক্ষণ পর অফিসের ফোন শিমুল, শিক্ষকদের ওখানে নাকি শিক্ষা সচিব ও অন্যরা গেছে। আবার একটু যেতে পারবো কিনা? আমি বললাম, ঠিক আছে , আশপাশে কে আছে তাকে একটু পাঠান আমি এক্ষুনি বের হচ্ছি। দেরি না করে বের হলাম। রামাপুরা ডিআইটি রোড হয়ে গাড়ি পল্টনে আসতে যতটুকু সময় কেবল সেটুকুর অপেক্ষা। এর মধ্যে ফেডারেশনের সভাপতির সঙ্গে কথা বলে নিউজ দিলাম অফিসে। এরপরের ঘটনা অনেক ভাল লাগার। এাতদিন যে শিক্ষকরা ছিলেন এতিমের মতো। নির্জীব, অসহায়ের মতো কেবল একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। এখন তারা আনন্দে ভাসছেন। স্লোগান দিচ্ছেন, কোলাকুলি করছেন। কেউ কেউ হাতে ব্যাগ-বোচকা গুছিয়ে বাড়ির পথ ধরছেন।
অনেক শিক্ষকের সঙ্গে কথা বললাম। যাদের সবাই স্বীকার করলেন ‘মিডিয়া’ যদি তাদের সঙ্গে না থাকতো তবে এবারও খালি হাতে ফিরতে হতো তাদের। তাদের বঞ্চনার এ পথ আরো দীর্ঘ হতো। অনেক শিক্ষককেই খুশিতে কাঁদতে দেখেছি।
দেখা হলো সেই রাবেয়া বসরীর সঙ্গে। যাকে নিয়ে প্রতিদিনই সারাবাংলায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ও… আপনার বাড়ি পিরোজপুর! তালিতো আপনি আমার ভাই। খুলনা আমার বাবার বাড়ি। স্বামীর বাড়ি তালায়। আপনি আমাগের বাড়িতে বেড়াতি যাবেন। যাবেন কিন্তু’। যাওয়া হবে কি না তার ভাবার চেয়ে আমি কেবল ভাবছিলাম কী অসম্ভব সরল আর আন্তরিক এই শিক্ষকরা।
সারাবাংলা/এমএস/জেডএফ