৭১-এর নির্যাতিতারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা
২৬ মার্চ ২০১৮ ১৫:৩১ | আপডেট: ৫ নভেম্বর ২০১৮ ২০:৪০
মালেকা খান। একাত্তরে নির্যাতিতা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে নিজেকে নিবেদিত করে দেওয়া এক অনন্য নারী। এর আগে যুদ্ধকালে পুরো ৯টি মাস জুড়েই ছিলো তার যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ততা। পূর্ব পাকিস্তান গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। সেই অবস্থানে থেকেও যুদ্ধের দিনগুলোতে নিয়েছেন নানা ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেননি বটে, তবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহায়ক শক্তি হয়ে কাজ করেছেন রাজধানী ও তার আশে পাশে। তবে মূল যুদ্ধটা তার শুরু হয় যুদ্ধের পরে, দেশ স্বাধীনতা লাভের পরে, বিজয়েরও পরে। তখন তিনি খুঁজে খুঁজে বের করতে থাকে যুদ্ধকালে নির্যাতিত নারীদের। ‘৭১ এর ডিসেম্বরে প্রথম উদ্যোগটি নেন কবি সুফিয়া কামাল ও বদরুন্নেসা আহমাদ। মাঠ পর্যায়ে এই কাজে মালেকা খানের ওপরই সবচেয়ে বেশি ভরসা করেন তারা। এরপর শুরু হয় তার আসল লড়াই। পরিত্যক্ত বাড়ি, কসাইখানা, হানাদারদের ক্যাম্প, রেলের বগি, ধানের ক্ষেত থেকে উদ্ধার করে আনতে থাকেন বস্ত্রহীনা, ছিন্নবস্ত্রা জীর্ণ-শীর্ণ-বিদীর্ণ সেই সব নারীদের যারা দেশের জন্য হারিয়েছেন তাদের সবকিছু। তাদেরই পুনর্বাসনের গুরুদায়িত্ব হাতে নেন মালেকা খান। জীবনের জন্য তাদের জাগিয়ে তুলতে কাজ শুরু করেন। সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ ছিলো এটি। ৭২-এর জানুয়ারিতে গঠিত হয় কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা। স্বাধীনতাযুদ্ধে পাক সেনাদের হাতে নির্যাতিত মেয়েদের সাহায্যের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক এই উদ্যোগের গোড়া থেকেই প্রধান স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন মালেকা খান। ১৯৭৩ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকও ছিলেন। জাতির জন্য সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজের কথা, একাত্তরের ভয়াল দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ততার কথা, আর তারও অনেক আগে জাগ্রত চেতনায় স্কুল পালিয়ে যোগ দেওয়া ভাষা আন্দোলনের কথা সারাবাংলাকে জানিয়েছেন দীর্ঘ আলাপচারিতায়।
প্রথম অংশ: একাত্তরের নির্যাতিতাদের পুনর্বাসন
https://youtu.be/TxvegBzBC5w?t=2
একেবারে প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধারা নানা জায়গা থেকে খবর আনছিল কোথায়, কোন বাড়িতে, কোন বাংকারে নির্যাতিতা নারীরা বন্দী আছে। কবি সুফিয়া কামালের প্রধান সহযোগী ছিলেন বদরুননেছা আহমাদ। আর স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ছিলেন মেহের কবির, আয়েশা নোমান, লুৎফুননেছা, হাসনা হাজারী, বেগম শামসুন্নাহার, শিল্পী সুফিয়া শহীদ, ড. হালিমাসহ আরও অনেকে। সঙ্গে ছিলেন সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালক বজলুর মজিদ। স্বাধীনতার পরপরই এভাবে মেয়েদের উদ্যোগেই শুরু হয় যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের উদ্ধার আর পুনর্বাসনের কাজ।
প্রথম দিনের উদ্ধারকাজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় মালেকা খান বলেন, সুফিয়া কামাল খালাম্মা আমাকে ডেকে বললেন, নির্যাতিত নারীদের উদ্ধারের দ্বায়িত্ব নিতে হবে তোকে। তখন ক্যান্টনমেন্ট ছিলো ভারতীয় সেনাদের অধীনে। একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার জিপে চড়ে ক্যান্টনমেন্ট গেলাম। সাথে ছিলেন আরেক মুক্তিযোদ্ধা। সেনানিবাসের একটি বাড়ি থেকে মেয়েদের বের করা হলো।
‘ওদের দেখে সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সে যে কি বিভৎস অবস্থা! ওদের চুলগুলো ছেঁটে দেওয়া হয়েছে, গায়ে কাপড় আছে কি নেই, ধুলোতে শরীর মাখামাখি। অনেকদিন গোসল, খাওয়া হয়নি। তাড়াতাড়ি কিছু কাপড়ে ওদের পেঁচিয়ে দিলাম। সবাই যেন স্তব্ধ, কারও মুখে কোনো কথা নেই, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ওরাও নির্বাক, আমিও নির্বাক। চলৎশক্তিটুকুও নেই কারো কারো। অনেকেই সন্তান সম্ভবা। সে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি’
যাই হোক নিজেকে সামলিয়ে কাজে নেমে পড়লাম। এভাবে চারদিনে প্রায় ৫-৬টি জায়গা থেকে নির্যাতিতাদের উদ্ধার করলাম। নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলও বিভিন্ন ব্যাঙ্কার থেকে মেয়েদের উদ্ধার করা হলো। ঢাকা ও বিভিন্ন জেলা থেকে খবর আসতে লাগল। ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা তথ্য দিতে থাকে। রেলওয়ের খালি বগি, ধানক্ষেত, খোলামাঠ থেকে মেয়েদের উদ্ধার করতে থাকি আমরা। তবে এ সব বিষয়ে বাড়িতে বা পরিচিতদের কিছু বলা নিষেধ ছিল।
কিছুদিন পর সরকার থেকে কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থাকে ৮৮ ও ২০ ইস্কাটনে দুটি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হলো। এখানেই নির্যাতিতদের তথ্য লিখে ভর্তি করা হতে লাগলো। এরপরের ধাপটি ছিল আরও কঠিন। যদিও সে সময় অনেক মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে সংস্থাকে নানা জায়গা থেকে নির্যাতিত মেয়েদের বিষয়ে জানিয়েছেন,পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
উদ্ধারের পরের ধাপটি ছিল আরও কঠিন। কেউ কথা বলে না, হাসে না, প্রায় মাস দুয়েক তারা নির্বাক! যেন কারও কোনো অনুভূতিই নেই। এবার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় কিভাবে এসব মেয়েদের সুস্থ করে তোলা যায়। অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। সব থেকে বড় সমস্যায় পড়তে হয় যুদ্ধশিশু আর গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে।
এমনি এক সংকটের সময় সুফিয়া কামাল খালাম্মা আমাকে পাঠালেন ইসলামপুরে মাদার তেরেসার কাছে। মাদার তেরেসা বললেন, ‘বাচ্চাদের জন্মাতে দাও! ওরা তো কোনো দোষ করেনি। সবাইকে পৃথিবীতে আসতে দাও।’ কিন্তু কুমারী মায়েরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে থাকলে এই জটিল অবস্থা থেকে রেহাই পেতে সরকার দুটি অধ্যাদেশ জারি করে। তার মধ্যে একটি হলো- আন্তর্জাতিক দত্তক আইন ও গর্ভপাত আইন।
মালেকা খান স্মৃতি হাতড়ে বলেন, মনে আছে একদিনেই সংস্থা থেকে ৪০জন শিশুকে দত্তক দেওয়া হয়। সে সময় অস্ট্রেলিয়া থেকে গর্ভপাত করানোর জন্য আনা হয় ডা. জিওফ্রে ডেভিসকে। যিনি ফিরে গিয়ে বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের ধর্ষিত নারীদের কথা তুলে ধরেন। পাশে দাঁড়ায় রেডক্রস আর সরকারি কর্মকর্তারা।
এই জিওফ্রে ডেভিস তার একটি লেখায় বলেছিলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে নির্যাতীত নারীর সংখ্যা দুই লাখ নয়, চার লাখ ছাড়িয়ে যাবে, বলেন মালেকা খান।
নানা সংকট মোকাবেলা করে মেয়েদের যখন পুনর্বাসন আর প্রশিক্ষণের কাজ চলছে, তাদের মানসিক ট্রমা থেকে বের করার চেষ্টা চলছে। এমন এক সময়ে একদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। বঙ্গবন্ধু তখন আমাদের কাছে অনেক কিছু, স্বাধীনতার ঘোষক, যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহান একজন, আমাদের জাতির পিতা। কিছুদিন আগেই তিনি দেশে ফিরেছেন। তাই কেন্দ্রে তার আগমনকে ঘিরে অন্যরকম উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। বঙ্গববন্ধু এলেন। পিনপতন নীরবতা। সবাই চুপ। হঠাৎ করে পেছন থেকে কেউ একজন ডুকরে কেঁদে উঠল। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন তার কাছে। মেয়েটি বলল, আমাদের কেউ নিতে চায় না। পরিচয় দিতে চায় না । বাবারাও মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে প্রত্যাখান করছে।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কেউ পরিচয় দিতে না চাইলে সবাই বলবে, আমার বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’
মালেকা খান বলেন, বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যে যেনো শক্তি ফিরে এলো। কেবল মেয়েদেরই নয়, আমরাও যেনো একটা পথ খুঁজে পেলাম। আমার মনে আছে পরে অনেক মেয়েই তাদের বিভিন্ন ফর্ম ফিল-আপ করতে গিয়ে বাবার নামের জায়গায় লিখেছে শেখ মুজিবুর রহমান।
মালেকা খানের মনে আছে, তিনি নিজের হাতে প্রায় ৫ হাজার মেয়ের কেস হিস্ট্রি যত্ন করে তুলে রেখে ছিলেন সংস্থার অফিসে। ৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। একাত্তর পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনে যে কাজ হয় তার ইতিহাস সব নষ্ট করে দেওয়া হয়। ভেস্তে যায় সোনারগাঁও মহিলাদের পুনর্বাসন প্রকল্পটির পরিকল্পনা। এ সময় এই সংস্থার দ্বায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মালেকা খান।
‘একাত্তরে নির্যাতিতারা এখন সমাজে নানভাবে মিশে গেছে। বেশির ভাগই পরিচয় গোপন করে ভালো থাকার চেষ্টা করছে। অনেকেই ভাল নেই। কিন্তু এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। একটি কমিশনের মাধ্যমে (যেখানে বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট, সুশীল সমাজ) তাদের কাছে যেতে হবে ভিন্নভাবে। তুলে ধরতে হবে তাদের ত্যাগ, আর দিতে হবে প্রাপ্য মর্যাদা।
চলবে…
সারাবাংলা/জেডএফ