‘জয়বাংলা স্লোগানে মনে হতো, সামনে যা পাব উড়িয়ে দেব’
৬ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৭:৪৫ | আপডেট: ৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৯:২৮
আসাদ জামান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছিল চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল এরইমধ্যে শত্রুমুক্ত হয়েছে। সেখানে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। আবার কোনো কোনো জায়গায় চলছে তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এ যুদ্ধ দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার, প্রিয় স্বদেশকে স্বাধীন দেখার।
কিন্তু, সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে শত্রু পক্ষের এলএমজি’র ব্রাশফায়ারে কনুই, পাঁজর, পেট, উরু, হাঁটুসহ শরীরের ডান পাশ ঝাঝরা হয়ে যাওয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে চূড়ান্ত বিজয়ের ১০ দিন আগে স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যাওয়ার স্বপ্নপূরণ কঠিন বৈকি। শত্রুর গুলিতে আহত পাঁজরের কোঠরে ধুক ধুক করতে থাকা হৃদস্পন্দন থেমে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে…।
কিন্তু না, ‘বুক যার বাংলাদেশের হৃদয়’ ‘স্বাধীন’ বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন পূরণের পথে তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি শত্রুর বুলেট। এরপর যুদ্ধাহত শরীরে স্বাধীন স্বদেশ দেখতে দেখতে কাটিয়েছেন ৪৬ বছর! কিন্তু কোথায় পেলেন এই সঞ্জিবনী শক্তি? বিজয়ের ৪৬তম বর্ষে দাঁড়িয়ে গোলাম মোস্তফা বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক সারাবাংলাকে বলেন, ‘জয়বাংলা স্লোগানেই লুকিয়ে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সঞ্জিবনী শক্তি। জয়বাংলা স্লোগান দিলে মনে হতো, আমাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আছেন! সামনে যা কিছু পাব উড়িয়ে দেব!
পাকিস্তান সরকার তো আমাদের ওপর জুলুম অত্যাচার চালাচ্ছিল। আমাদের যা ছিল অধিকার— সেটা তারা দেয়নি। তারা চেয়েছিল রাষ্ট্রভাষা উর্দু করবে। আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের দাবি ছিল রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা। এ নিয়ে আমাদের ছাত্র সমাজ ও তারুণ্যে ভরা যুবকরা ৫২ সালে রক্ত দিল। পৃথিবীতে কোনো দেশ মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়নি।
বিনয়বশত গোলাম মোস্তফা কথা বলার শুরুতেই বলছিলেন, ‘আমার শিক্ষা-দীক্ষা নেই। কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারব না। ঠিক করে নিয়েন।’ কিন্তু সত্তরের কোঠায় পা রাখা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কম কথায় পরিষ্কার একটা ধারণা দিয়ে দিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১ এর পঞ্চম তলায় হুইল চেয়ারে বসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণের সময় বার বার তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন একাত্তরে। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। সে হিসেবে তারাই সরকার গঠন করবে। কিন্তু পাকিস্তান টালবাহানা শুরু করল। তখন ৭মার্চের ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি মনে করি, ৭ মার্চের ভাষণে আমাদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ঘোষণা ও দিক নির্দেশনা ছিল।
রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চলাইট’র সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন গোলাম মোস্তফা। তার অবস্থান ছিল জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে।
সে দিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে তারা (পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী) নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর আমাদের কাছে যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে তাদেরকে মোকাবেলা করি। এখানে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় ছিল না। যারা যুদ্ধে যাবেন, তারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমাদের সেকেন্ড ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯ মার্চ থেকেই প্রতিরোধ গড়েছে। আমরা জানতাম, তারা আমাদের এমনিতে ছাড় দেবে না। আমাদের ওপর আক্রমণ করবে।’
‘শত্রুর ডেরা থেকে প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসা যুদ্ধ জয়ের প্রথম ধাপ! পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে থাকা বাঙালি সেনারা এ ধাপ অতিক্রম করেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রাণ নিয়ে বের হয়ে আসা কঠিন ছিল। তারপরও আমরা বেরিয়ে এসেছি। আমাদের ওপর আক্রমণ চলছিল। আমরা জয়দেবপুর থেকে বের হয়ে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ হয়ে ভৈরব গেছি। ভৈরব থেকে নরসিংদীতে ফিরে আশুগঞ্জ। এর পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফিরে শাহবাজপুর হয়ে মাধবপুর গিয়ে ডিফেন্স নিই। এখানে হানাদার বাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়।’
‘১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা সমবেত হয় মাধবপুরে। আমরা জানতে পারি, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান উদ্যাপন শেষে একদল পাকিস্তানি সেনা যাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে। আলফা কোম্পানির অধিনায়ক আমাদের নির্দেশ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওই দলকে অ্যাম্বুশ করার। এ জন্য রাতের অন্ধকারে আমিসহ ১৫-১৬ জন মাধবপুর উপজেলার গোপালপুরে যাই। সেখানে সড়কের একটি মোড়ে অ্যাম্বুশ করি। এর মধ্যে ওই সড়ক দিয়ে একটি দুটি করে গাড়ি যাওয়া-আসা করে। সেগুলোতে আক্রমণ না করে অপেক্ষায় থাকলাম একসঙ্গে কয়েকটি গাড়ি আক্রমণ করার জন্য। এই সিদ্ধান্ত আমাদের বিপদ ডেকে আনল। এর মধ্যে দুজন অপরিচিত লোক সেখানে আসে। তারা সামনে যেতে চাইলে আমরা তাদের সামনে যেতে নিষেধ করি। এরপর তারা পেছন দিকে চলে যায়।’
‘সকাল হওয়ার পর আমরা দেখি, পাকিস্তানি সেনারা আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। ওই অপরিচিত লোক দুজন ছিল আসলে রাজাকার। তারা পাকিস্তানিদের খবর দিয়েছে। তখন পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্মুখ লড়াই করা মানে জীবন বিলিয়ে দেওয়া। এ অবস্থায় আমরা সামনে এগিয়ে বিরাট এক পাটক্ষেতে যাই। তার পাশেই ছিল একটি খাল। সেখানে অবস্থান নিয়ে গুলি শুরু করি। পাকিস্তানিরাও পাল্টা গুলি শুরু করে। কয়েক ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পর আমরা পেছনে সরে আসি। সেদিন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, আর বুঝি বাঁচব না।’
মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের নেপথ্যে ছিল বাঙালিদের অফুরান্ত দেশপ্রেম। দেশের প্রতি অপরিমেয় মমত্ববোধ। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল বাঙালি সেনাদের সাহস ও কৌশল! গোলাম মোস্তফার মতে, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সেনাবাহিনীতে তো আমরাও ছিলাম। বাঙালি সেনা নিয়েই তো পাকিস্তান সেনাবাহিনী। আমাদের যে কলাকৌশল, তাদেরও সেই কলাকৌশল। তবে যুদ্ধটা যেহেতু আমাদের ভূ-খণ্ডে সেহেতু আমরা মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জ্ঞান দিয়ে মেধা দিয়ে সহজেই তাদেরকে পরাস্ত করেছি।’
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ যে দশ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ২টি করে খেতাব পেয়েছেন, তাদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা অন্যতম। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট মাধপুর যুদ্ধে জীবন বাজি রেখে সহযোদ্ধাদের নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পথ তৈরি করার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন ‘বীরবিক্রম’ খেতাব। আর ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চান্দুয়ার যুদ্ধে অভাবনীয় অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব।
চান্দুয়ার যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। আমরা মাদবপুরের শেষ সীমানায় চান্দুয়ার ডাকবাংলোর সোজাসুজি সিএন্ডবি রোডে উঠব। আমাদের উদ্দেশ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অ্যাডভান্স হওয়া। কিন্তু খবর পেলাম, শাহবাজপুর ব্রিজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ডিফেন্স নিয়েছে। আমাদের ব্যাটেলিয়ান কমান্ডার ছিলেন জেনারেল নাসিম (বীরবিক্রম) এবং কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল নজরুল ইসলাম (বীরপ্রতীক)। ওদিকে আমাদের আরেকটা কোম্পানি ছিল। মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়া সেই কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন। তো ওই ফাঁক দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটা ট্রাক ও একটা জিপ ঢুকে গেছে। আমরা তখন চান্দুয়া ব্রিজে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ফায়ারের শব্দ। ব্রিজ থেকে মাথা উঠিয়ে দেখি, আমার থেকে ১০/১২ হাত দূরে হানাদারদেরএকটা ট্রাক। তখন আমার কাছে একটা এসএমজি ছিল। আমি জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে ট্রাকের ওপর ব্রাশ ফায়ার করি। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ হয়।’
একটু থেমে গোলাম মোস্তফা ফের স্মৃতিচারণ শুরু করেন, “ব্রিজের কোণা থেকে এলএমজির ফায়ার আসছে। সেভেন প্লাটুনের অ্যাকটিং কমান্ডার ছিলাম আমি। ওখানে আমাদের সৈনিকরা পার হতে পারছিল না। আমার পাশে সিপাহী ফজলু ছিল। ওর কাছ থেকে এলএমজি নিয়ে আমার এসএমজি ওর কাছে দিলাম। দাঁড়িয়ে গেলাম ‘জয় বাংলা’ বলে। শুরু করলাম ব্রাশফায়ার। এরমধ্যে কোন ফাঁকে যে আমার এক পাশে গুলি লেগে গেছে, আমি টের পাইনি। ফায়ার বন্ধ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধরা ব্রিজের ওপর উঠল। ছেলেরা সবাই কাঁদছে। ময়মনসিংহের একটি ছেলে ছিল আদম আলী নাম। সে বলল, ‘স্যার গো আপনার পেটে গুলি লাগছে!’ তখনও আমি সাহস হারাইনি। আস্তে করে বাম হাতটা পেটের ডান পাশে দিয়ে দেখি আঠা আঠা লাগে। তখন বাম সাইডে হাতটা পড়ে গেল। এলএমজির বাট নাই। আমিও বাম সাইডে কাইত হয়ে পড়ে গেলাম। সবাই আমাকে ঘেরাও করে ফেলল। বললাম, ‘আমার কিছু হয়নি, তোমরা ওদের (হানাদার বাহিনী) সারেন্ডার করাও।’”
চান্দুয়ার ওই ভয়াবহ যুদ্ধে হাবিলদার রফিক ও সিপাহী মুজিবুর শহীদ হন। গোলাম মোস্তফাসহ ১৭ জন আহত হন। সেখান থেকে তাদেরকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেক্টর কমান্ডার শফিউল্লাহ বীর-উত্তম তাঁদেরকে ভারতে নিয়ে যান।
বিজয়ের ৪৬ বছর পর এসে গোলাম মোস্তফার আবেগী উচ্চারণ, ‘ওই সময় মনে হয়েছিল, আর মনে হয় দেশটাকে দেখতে পারব না। ওই যুদ্ধের পর অনেক দিন অজ্ঞান ছিলাম। ১৯৭২ সালের আগস্টে বাংলাদেশে আসি। স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখে আনন্দে চোখে জল এসে যায়।’
সারাবাংলা/এজেড/আইজেকে