Saturday 04 Jan 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আইএমওতে গোল্ড পাওয়া জাওয়াদের চিন্তা এখন এইচএসসির গোল্ড নিয়ে


১৬ জুলাই ২০১৮ ১৭:০৭ | আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৮ ১০:৫৩

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।।

১৯ তারিখ এইচএসসির ফল প্রকাশ পাবে।  শিক্ষার্থীদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা করছে কে এমন ফল আনতে পারবে। এই ফলই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের পরিচয়। গোল্ডেন ফাইভ বা সব বিষয়ের এ প্লাস পাওয়ার জন্য সবাই যখন খুব আশা করে বসে আছে তখন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী রুমানিয়া থেকে নিয়ে এসেছেন একটি গোল্ড মেডেল। এই মেডেলটা আবার শুধু তার একার নয়। এই মেডেলটা সারা বাংলাদেশের। জাওয়াদ আন্তর্জাতিক ম্যাথ অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম প্রতিযোগী যে স্বর্ণ জিতেছে।

বিজ্ঞাপন

এত বড় একটি পদক পাওয়ার পরে জাওয়াদ মজা করেই বলে, এইচএসসিতে যদি কোনো বিষয়ে এ প্লাস মিস হয়ে যায়, সবাই কী বলবে? জাওয়াদ গোল্ড জিতে আসলো অথচ গোল্ডেন এ প্লাস পেলো না। বলেই হেসে দেয় সে।

আন্তর্জাতিক ম্যাথ অলেম্পিয়াডে পদজয়ীদের জন্য খোলা থাকে পৃথিবী বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার। জাওয়াদ মানুষটাও এমন নন যে কোনো কিছুর জন্য তার জীবন থমকে যাবে। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপণে উঠে আসে ভীষণ বুদ্ধিমান, খুব অনুভূতিশীল এই নবীন গণিত জয়ীর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা, ম্যাথ অলেম্পিয়াডের ভবিষ্যত এমনকি, মেয়েদের ম্যাথ অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহনের অসুবিধার কথাও।

গোল্ড পাওয়ার পরে জাওয়াদের দর্শন পাওয়াই ভার।  বাংলাদেশ ম্যাথ অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসানকে ১৪ জুলাই  ফোন দেওয়া হলো জাওয়াদের সাক্ষাতকারের জন্য। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন আজকেই বলা সম্ভব নয় কাল তাকে কখন পাওয়া যেতে পারে। এরপর আবার ১৫ তারিখ সকালে ফোন। কোথায় জাওয়াদ? কোথায় গেলে পাওয়া যাবে তার সাক্ষাৎ? অবশেষে বিকেল চারটায় সময় দেওয়া হলো, জাওয়াদ থাকবেন প্রথম আলোর অফিসে। সেখানেই পাওয়া যাবে তাকে।

বিজ্ঞাপন

তখনও অনেক কিছু জানার বাকি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সাক্ষাৎ পাওয়া আর সাক্ষাৎকার পাওয়া এক কথা নয়। শুরু হলো আবার জাওয়াদের জন্য অপেক্ষা, এক সাক্ষাতকার থেকে আরেক সাক্ষাতকার। ফেসবুক লাইভ, প্রথম আলো থেকে চ্যানেল ২৪, সেখান থেকে চ্যানেল আই, কোথায় পাওয়া যাবে জাওয়াদকে? তার দাঁড়াবার সময় তো নাই!

অবশেষে মুনির হাসান দিলেন সহজ সমাধান। জাওয়াদের ইন্টারভিউ পাওয়া যাবে গাড়িতে বসে। সব ইন্টারভিউ মাঝে মধ্যে যখন জাওয়াদ একটু সময় পাবে, তখনই সারাবাংলা করবে তার ইন্টারভিউ।

জাওয়াদকে প্রথমেই প্রশ্ন রাখা হলো, আচ্ছা জাওয়াদ, এত সাক্ষাৎকার দিচ্ছো, এখন এমন একটা প্রশ্ন বল তো যেটা তুমি জবাব দেওয়ার জন্য প্রায় মরেই যাচ্ছো…

কারওয়ান বাজার প্রথম আলো অফিস থেকে গাড়ি রওণা হয়েছে চ্যানেল ২৪-এর দিকে।  হেঁটে গেলেও মোটে ১০ মিনিট লাগে সে পথ পাড়ি দিতে।  প্রশ্ন শুনে চিন্তিত হয়ে উঠলো জাওয়াদ। দুদিন ধরে এত প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে আদৌও এমন কোনো প্রশ্ন বাকি আছে যেটা তাকে করা হয়নি!

ধন্যবাদ ঢাকার ট্রাফিককে, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই জাওয়াদ জবাব খুঁজে পেলো।  “আমি ভেবেছিলাম সবাই আমাকে জিজ্ঞেস করবে আমি বাসায় কীভাবে জানালাম গোল্ড পাওয়ার কথা। কেউ করেনি। আমি ভেবেছিলাম আমি বাড়িতে জানাবো, কিন্তু আমি শহরের বাইরে এক জায়গায় ছিলাম বাসে করে ফিরছিলাম। সেখানেই শুনলাম রেজাল্ট হয়ে গিয়েছে, যখন অবশেষে রেজাল্ট জানতে পারলাম তখন বাড়িতে ফোন করতে পারছিলাম না।

অনেক পরে যখন বাড়িতে যোগাযোগ করতে পারলাম, ততক্ষণে বাড়িতে খবর পৌঁছে গেছে। সবাই আনন্দ উৎসব করছে, মনে হচ্ছিলো ঠিক সেই মুহূর্তটায় আমি উপস্থিত থাকতে পারলে বেশ হতো!

জাওয়াদের আন্তর্জাতিক ম্যাথ অলিম্পিয়াড জয়ের গল্পটা মোটেই গেলাম জয় করলাম চলে এলাম এমন নয়।  ২০১১ সাল থেকে জাওয়াদ লেগে আছে হাইস্কুল লেভেলে গণিতের সর্বোচ্চ এ পদ জয়ে। ২০১১ সালে জাওয়াদ যখন ডাচ বাংলা ব্যাংক- প্রথম আলো গণিত অলিম্পিয়াডের জুনিয়ার বিভাগে অংশ নিয়েছিল তখন সে মাত্র ক্লাস সিক্সের ছাত্র।  সেবছরই সে চ্যাম্পিয়নস অব দ্যা চ্যাম্পিয়ন হয়। সেদিনটাই কি আজকের দিনের সূর্য দেখিয়েছিল?

জাওয়াদ বলে, এরপরেও তাকে পেরুতে হয়েছে অনেকটা পথ, পরপর অনেকগুলো জাতীয় পর্যায়ের গণিত অলিম্পিয়াড কোনোটায় রানার্স আপ, কোনোটায় চ্যাম্পিয়ন এভাবে সে পর্যায়ক্রমে অংশ নিয়েছে এক একটা অলিম্পিয়াডে। শুধু তাই নয়। ২০১১ তে তাদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল গণিত ক্যাম্প। এমন অনেকগুলো ক্যাম্প পার হয়ে গত তিন বছর ধরে সে লেগে আছে আন্তর্জাতিক ম্যাথ অলিম্পিয়াডে।

গাড়ির একদম সামনে বসা জাওয়াদের মা সৈয়দা ফারজানা খানম।  যোগ দিলেন তিনিও, এটা আইএমও’তে জাওয়াদের তৃতীয় বছর।  প্রথম বছর জাওয়াদ জিতেছিল ব্রোঞ্জ। মাত্র দুই নম্বরের জন্য সেবার রূপা পায়নি সে।  পরের বছর এলো রূপা। এবছর যাওয়ার আগে জাওয়াদের বাবা বলেছিলেন, এবার সোনা পাবে। ঠিক ছেলে সোনা নিয়েই ফিরেছে, গর্ব মায়ের গলায়।

জাওয়াদকে প্রশ্ন রাখা হয়, তুমি এতদিন একটা ম্যাথ অলিম্পিয়াডে পদক পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলে এখন তোমার লক্ষ্যটা কী?

দক্ষ গণিতবিদের মতো পুরো প্রশ্নটাকেই নিজের মতো হিসেব করে নেয় সে। বলে,

আমরা অনেকসময় একটা পদকের পেছনে ছুটি, কারণ সেগুলো দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সবার এমন একটা কাজ করা উচিত যেটার সুফল সবাই ভোগ করে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই কাজগুলো আসলে করতে দীর্ঘ সময় লাগে, এগুলোর ফলাফলও সব সময় দেখা যায় না, তারপরও এগুলা একটা কাজ যেটা করে যেতেই হবে।

১৯ জুলাই এইচএসসির রেজাল্ট হবে তা নিয়ে দারুণ শঙ্কায় জাওয়াদ। বার বার বলছে, বাংলাটা… কী যে হবে বাংলায়? ঘুরে ফিরে শুধু বাংলার চিন্তা। জাওয়াদের মা জানান এইচএসসিতে কোনো কোচিং-ই দৌড়ায়নি জাওয়াদ।  শুধু ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি একজনের কাছে পড়েছি। তাও দ্রুত সিলেবাস শেষ হওয়ার জন্য। বাংলাটাকে বেশ ভয় লাগে, তাই এটাও একজনে একটু দেখিয়ে দিতেন।  কোনোক্রমে বাংলার ফাঁড়া কাটলেই খুশি জাওয়াদ।

অবশ্য রেজাল্টের পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে এখন আর ভাবছে না জাওয়াদ। ম্যাথ অলিম্পিয়াডে স্বর্ণজয়ীকে ঘরে টেনে নেয় অনেক বড় বিশ্ববিদ্যালয়ই। জাওয়াদের আক্ষেপ বাংলাদেশে এই সুবিধা দেয় শুধু শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদ। বিশ্বে অন্য অনেক দেশ যারা ম্যাথ অলিম্পিয়াডে পদক জয়ীদের জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে এই সুযোগ সীমিত। তাতে জাওয়াদ খুশি, অন্তত দেশের অন্যতম ভালো একটি কম্পিউটার সায়েন্স অনুষদে তো ঢোকা যাবে!

জাওয়াদকে প্রশ্ন করা হয় এই যে এত বিষয়ে পড়তে হয়, এগুলো সমস্যা মনে হয় না? একজন মানুষকে কেন এত বিষয়ে পারদর্শী হতে হবে? তবে জাওয়াদ তো জাওয়াদই। পড়ার এই চাপ নিয়ে কোনো আপত্তি নেই তার।  সোজাসাপ্টা জবাব,

যত বেশি শেখা যায়, জানা যায় ততই না ভালো।

এমনকি বাংলাদেশের সিলেবাস নিয়েও খুব অভিযোগ নেই তার। বরং আমাদের সিলেবাসের জ্যামিতি, বীজগণিত প্রস্তুতি নিতে অনেক সহায়ক এটাও ধারণা জাওয়াদের। তবে গণিত বইগুলোর ধারা নিয়ে আপত্তি তার।  জানালো,

সমস্যাগুলো যেন কেমন ধারার! গণিত শেখার চেয়ে নির্দিষ্ট একটা সমস্যা সমাধানেই জোর দেওয়া হয় আমাদের বইগুলোতে।  পরীক্ষায়ও ঠিক সেই গণিতগুলো আসে যেগুলো বইয়ে ছিল।

বোর্ড পরীক্ষার আগ দিয়ে সবাই শুধু রেজাল্টটা দেখতে পান।  কেউ এটা ভাবেন না শিক্ষার্থীর শরীরের উপরে যাচ্ছে অথবা তার মনে কোনো চাপ পড়ছে কি না। শুধু ভালো করাই এখানে মুখ্য।

সে প্রসঙ্গ টেনেই প্রশ্ন করা হয়, তোমার বাড়িতে কি বিষয়টা এমন? জবাব দেন জাওয়াদের মা।  আমরা চেষ্টা করি ওর পাশে থাকতে, ওর চাওয়াগুলোতে ওকে সহায়তা করতে, কখনও যদি সেটা না পায় তাহলে সাহস দিতে।  জাওয়াদ মায়ের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে। তবে মানসিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টা জাওয়াদদের পরিবারে কত গভীরে প্রথিত তা বোঝা যায় অন্য একটা প্রশ্নের জবাবে।

জাওয়াদকে প্রশ্ন করি, ম্যাথ অলিম্পিয়াড পর্যন্ত আসতে তুমি কেমন বাধার সম্মুখীন হয়েছ?  বলে, আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে তাল রেখে ম্যাথ অলিম্পিয়াডের ক্যাম্পে যোগ দিতে বেশ সমস্যা হয় এই দেখা যায় স্কুলে মডেল টেস্ট ঐ দেখা যায় কোনো স্পেশাল ক্লাস। সব মিলিয়ে ক্যাম্পে আসাটাই একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়।

কিন্তু জাওয়াদ ছেলে বলে তাও ক্যাম্পে আসতে পারে ম্যাথ অলিম্পিয়াডে তো এখনও মেয়েদের সংখ্যা অনেক কম। এটা নিয়ে বাংলাদেশের একমাত্র সোনা জয়ী কী ভাবছে? কথাটা মেনে নেয় জাওয়াদ।  বরং সে যোগ করে অনেক তথ্য,

জেলা পর্যায়ে যখন জাতীয় অলিম্পিয়াড হয় তখন প্রায় ৪০ শতাংশ মেয়ে থাকে।  প্রতিযোগিতা আগায়, ক্যাম্পের সময় আসে, এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়ার বিষয় আসে তখনই একে একে ঝরে পড়ে মেয়েরা। এমনকি চট্টগ্রামে জাওয়াদদের গণিতের একটি ক্লাব আছে সেখানেও মেয়েদের আনা দায়!

জাওয়াদকে প্রশ্ন করা হয়, আচ্ছা তোমার তো সাত আট বছরের একটা বোন আছে। ও যখন এসব ক্যাম্প, ক্লাবে যাবে ওকে সেসব জায়গায় পাঠানর বিষয়ে কি তুমি সাহায্য করবে।? জাওয়াদ জবাব দেয়, আমি ওকে গণিত করার বিষয়ে কোনো চাপ দিবো না। তাহলে এটাও আসলে একটা অন্যায় হবে।  তবে সে অন্য কোনো কাজে যদি এগিয়ে যেতে চায় তবে অবশ্যই সে সহযোগিতা সে পাবে।

বোঝা গেল জাওয়াদ শুধু মেধায় নয়, বেড়ে উঠেছে মননেও। চমৎকার ব্যক্তিত্বের এই তরুণ বড় হোক আরও শতগুণে। এই প্রত্যাশা।

সারাবাংলা/এমএ

বিজ্ঞাপন

না ফেরার দেশে অঞ্জনা
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৫৪

এই তাসকিনকে সমীহ করবেন যে কেউ
৪ জানুয়ারি ২০২৫ ০১:৪৭

আরো

সম্পর্কিত খবর